Prothomalo:
2025-10-07@08:33:54 GMT

নেতানিয়াহুর এই কথা কি সত্যি

Published: 7th, October 2025 GMT

হাজার হাজার ফিলিস্তিনির রক্ত যাঁর হাতে, তাঁর আবার ‘মান-অপমান’। তবু জাতিসংঘের মতো বিশ্বমঞ্চ বলে কথা।

বক্তৃতামঞ্চে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উঠতেই প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা গণহারে ওয়াকআউট করেন। অধিবেশনকক্ষ প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়।

‘গাজার কসাই’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া নেতানিয়াহু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মাথা ইতিউতি করেন। যেন কিছুই হয়নি—এমনটা বোঝাতে চাইলেন তিনি। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর অস্বস্তি চাপা থাকে না।

ভরা মজলিশে এমন ‘অপমান’ ঢাকতে কী করতে হয়, তা ধূর্ত রাজনীতিক নেতানিয়াহুর চেয়ে আর কারও ভালো জানার কথা নয়।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সৃষ্ট এমন পরিস্থিতির মধ্যে ভাষণ দেন নেতানিয়াহু। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘অনেক বিশ্বনেতা প্রকাশ্যে আমাদের নিন্দা করেন, আবার তাঁরাই গোপনে আমাদের ধন্যবাদ জানান।’

এখন প্রশ্ন হলো, নেতানিয়াহুর এই কথা কি সত্যি?

আরও পড়ুনপ্রকাশ্যে নিন্দা করলেও অনেক নেতাই গোপনে আমাদের ধন্যবাদ দেন: জাতিসংঘে নেতানিয়াহু২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নেতানিয়াহু যে দাবিটি করলেন, তার পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করেননি। আবার ঠিক কোন কোন বিশ্বনেতা এমন দ্বিচারী আচরণ করেন, তাও তিনি বলেননি।

নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।

প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নেতানিয়াহুর। অপমান ঢাকার কৌশল তাঁর ঢের জানা। যাঁরা গণহারে ওয়াকআউট করেছেন, তাঁদের নিশানা করে পাল্টা আঘাত হানতে এমন কথা বলে থাকতে পারেন নেতানিয়াহু।

সে ক্ষেত্রে অনেকটা ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’ হলো।

এক.

ওয়াকআউট করা নেতাদের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করা গেল। রটিয়ে দেওয়া গেল, ওয়াকআউট আসলে লোকদেখানো। ওয়াকআউটকারীরা গোপনে ঠিকই ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। শুধু যোগাযোগই রাখেন না, গোপনে বাহবাও দেন। অর্থাৎ, গাজায় হামলাসহ অন্যান্য ইসরায়েলি পদক্ষেপকে তাঁরা গোপনে সমর্থন করেন।

দুই. নেতানিয়াহু নিজের অপমান সহজেই ঢাকতে পারলেন। গণহারে প্রতিবাদী ওয়াকআউটের প্রসঙ্গ ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে নেতানিয়াহুর বিতর্কিত বক্তব্য।

আরও পড়ুনজাতিসংঘে নেতানিয়াহু ভাষণ দিতে এলেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বেরিয়ে যান অনেক প্রতিনিধি২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নেতানিয়াহুর এমন কৌশল অবশ্য নতুন নয়। তিনি তাঁর সমালোচক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, এমনকি ‘প্রতিকূল’ বিচারপতিদের মোকাবিলায় এভাবে আক্রমণ করে থাকেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় কৌশলী বাগ্মিতা (রেটোরিক) ব্যবহার করে বিরোধীদের প্রশ্নবিদ্ধ করেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসেন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নেতানিয়াহুর দেওয়া একাধিক ভাষণ বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। এসব বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ন্যারেটিভ (বয়ান) নির্মাণ, নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গঠন, দর্শক প্রভাবিত করা, জনমত নিয়ন্ত্রণ, বিভাজন তৈরির মতো উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহু তাঁর ভাষণে কৌশলী শব্দ, বাক্য, প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেছেন।

শুধু তা-ই নয়, নেতানিয়াহু ঘরে-বাইরে দেওয়া বক্তৃতায় দেদার ডাহা মিথ্যা বলে থাকেন। এর মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যু অন্যতম।

আরও পড়ুন৭৭ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর যেভাবে নেমে এসেছিল মহাবিপর্যয়১৪ মে ২০২৫

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা চলছে। এই হামলার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫)।

দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি। গাজার লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।

গত মাসের মাঝামাঝি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। এর জন্য নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দায়ী করা হয়।

গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায়, রক্তনদী বয়ে যাওয়ায় খোদ মিত্র দেশগুলোও এখন ইসরায়েলের সমালোচনায় সরব। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো প্রভাবশালী দেশ। এসব ঘটনায় বৈশ্বিকভাবে চাপে আছেন নেতানিয়াহু। এই চাপ উপেক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর নানান কৌশলের মধ্যে আছে বাগ্মিতার ব্যবহার।

আরও পড়ুনগাজায় জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল: জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তবে জাতিসংঘে নেতানিয়াহু যে দাবিটি করেছেন, সেটিকে কেবল বাগ্মিতা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে পর্দার আড়ালে, খুব গোপনে অনেক কিছুই ঘটে, যেগুলো সাধারণত প্রকাশ পায় না। ফলে নেতানিয়াহুর দাবিটিকে পুরোপুরি নাকচ করাও কঠিন।

এই যেমন সম্প্রতি চ্যানেল ৪-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চলমান জাতিগত নিধন অভিযানের মধ্যে গত আগস্টে যুক্তরাজ্য থেকে ইসরায়েলে ১ লাখ ১০ হাজার বুলেট সরবরাহ করা হয়েছে। একই মাসে ইসরায়েলে পাঠানো অন্যান্য চালানের মধ্যে ছিল ট্যাংকের যন্ত্রাংশ, শটগান বা রাইফেলের যন্ত্রাংশ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ।

অথচ এই যুক্তরাজ্যই গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আসছে। আর দেশটি গত ২১ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

আরও পড়ুনগাজায় জাতিগত নিধনের মধ্যেই এক মাসে ইসরায়েলে ১ লাখ বুলেট পাঠিয়েছে যুক্তরাজ্য০১ অক্টোবর ২০২৫

যুক্তরাজ্য সরকার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির ২৯টি লাইসেন্স স্থগিত করেছে। কারণ, এসব অস্ত্র আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হতে পারে। সে সময় যুক্তরাজ্য সরকার বলেছিল, তারা গাজায় বর্তমান সংঘাতে ব্যবহৃত হয় এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে যায় এমন পণ্যের বিক্রি আটকে দিচ্ছে।

তবে এটাও আবার ঠিক, যুক্তরাজ্যে এখনো প্রায় ৩৫০টি লাইসেন্স সক্রিয় রয়েছে। যার মধ্যে ১৬০টির বেশি ‘সামরিক’ লাইসেন্স হিসেবে তালিকাভুক্ত।

গাজা যুদ্ধ বন্ধে গত ২৯ সেপ্টেম্বর নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কার্যত ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষার চাতুর্যপূর্ণ এই পরিকল্পনাটিকে তাড়াহুড়া করে অনুমোদন দিয়েছে মুসলিমবিশ্বের বেশ কিছু প্রভাবশালী দেশ।

আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণার পর এখন কী হবে০২ অক্টোবর ২০২৫

সম্প্রতি মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইতিহাসবিদ ও ফিলিস্তিনবিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা হাসান বোখারি মুসলিম দেশগুলোর এই পদক্ষেপকে ফিলিস্তিনের প্রতি বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

হাসান বোখারির মতে, এই বিশ্বাসঘাতকতা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এ পরিকল্পনাকে সমর্থন দিয়ে মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ও তার গণহত্যাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।

প্রকাশ্যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে অস্ত্র বিক্রি, গোয়েন্দা সহায়তা, বাণিজ্যিক চুক্তি বজায় রাখা কিংবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থনকে এক অর্থে ‘গোপন ধন্যবাদ’ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু সম্ভবত এই ‘ধন্যবাদের’ কথাই বলেছেন।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্কার, ফোর্বস, রয়টার্স।

আরও পড়ুনগাজার সঙ্গে ৮ মুসলিম দেশ কি বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল০২ অক্টোবর ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর জ য স প ট ম বর য় ইসর য় ল ইসর য় ল র প রক শ য ত হয় ছ কর ছ ন র জন ত ব যবহ অপম ন

এছাড়াও পড়ুন:

নেতানিয়াহুর এই কথা কি সত্যি

হাজার হাজার ফিলিস্তিনির রক্ত যাঁর হাতে, তাঁর আবার ‘মান-অপমান’। তবু জাতিসংঘের মতো বিশ্বমঞ্চ বলে কথা।

বক্তৃতামঞ্চে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উঠতেই প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা গণহারে ওয়াকআউট করেন। অধিবেশনকক্ষ প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়।

‘গাজার কসাই’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া নেতানিয়াহু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মাথা ইতিউতি করেন। যেন কিছুই হয়নি—এমনটা বোঝাতে চাইলেন তিনি। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর অস্বস্তি চাপা থাকে না।

ভরা মজলিশে এমন ‘অপমান’ ঢাকতে কী করতে হয়, তা ধূর্ত রাজনীতিক নেতানিয়াহুর চেয়ে আর কারও ভালো জানার কথা নয়।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সৃষ্ট এমন পরিস্থিতির মধ্যে ভাষণ দেন নেতানিয়াহু। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘অনেক বিশ্বনেতা প্রকাশ্যে আমাদের নিন্দা করেন, আবার তাঁরাই গোপনে আমাদের ধন্যবাদ জানান।’

এখন প্রশ্ন হলো, নেতানিয়াহুর এই কথা কি সত্যি?

আরও পড়ুনপ্রকাশ্যে নিন্দা করলেও অনেক নেতাই গোপনে আমাদের ধন্যবাদ দেন: জাতিসংঘে নেতানিয়াহু২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নেতানিয়াহু যে দাবিটি করলেন, তার পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করেননি। আবার ঠিক কোন কোন বিশ্বনেতা এমন দ্বিচারী আচরণ করেন, তাও তিনি বলেননি।

নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।

প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নেতানিয়াহুর। অপমান ঢাকার কৌশল তাঁর ঢের জানা। যাঁরা গণহারে ওয়াকআউট করেছেন, তাঁদের নিশানা করে পাল্টা আঘাত হানতে এমন কথা বলে থাকতে পারেন নেতানিয়াহু।

সে ক্ষেত্রে অনেকটা ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’ হলো।

এক. ওয়াকআউট করা নেতাদের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করা গেল। রটিয়ে দেওয়া গেল, ওয়াকআউট আসলে লোকদেখানো। ওয়াকআউটকারীরা গোপনে ঠিকই ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। শুধু যোগাযোগই রাখেন না, গোপনে বাহবাও দেন। অর্থাৎ, গাজায় হামলাসহ অন্যান্য ইসরায়েলি পদক্ষেপকে তাঁরা গোপনে সমর্থন করেন।

দুই. নেতানিয়াহু নিজের অপমান সহজেই ঢাকতে পারলেন। গণহারে প্রতিবাদী ওয়াকআউটের প্রসঙ্গ ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে নেতানিয়াহুর বিতর্কিত বক্তব্য।

আরও পড়ুনজাতিসংঘে নেতানিয়াহু ভাষণ দিতে এলেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বেরিয়ে যান অনেক প্রতিনিধি২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নেতানিয়াহুর এমন কৌশল অবশ্য নতুন নয়। তিনি তাঁর সমালোচক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, এমনকি ‘প্রতিকূল’ বিচারপতিদের মোকাবিলায় এভাবে আক্রমণ করে থাকেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় কৌশলী বাগ্মিতা (রেটোরিক) ব্যবহার করে বিরোধীদের প্রশ্নবিদ্ধ করেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসেন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নেতানিয়াহুর দেওয়া একাধিক ভাষণ বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। এসব বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ন্যারেটিভ (বয়ান) নির্মাণ, নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গঠন, দর্শক প্রভাবিত করা, জনমত নিয়ন্ত্রণ, বিভাজন তৈরির মতো উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহু তাঁর ভাষণে কৌশলী শব্দ, বাক্য, প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেছেন।

শুধু তা-ই নয়, নেতানিয়াহু ঘরে-বাইরে দেওয়া বক্তৃতায় দেদার ডাহা মিথ্যা বলে থাকেন। এর মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যু অন্যতম।

আরও পড়ুন৭৭ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর যেভাবে নেমে এসেছিল মহাবিপর্যয়১৪ মে ২০২৫

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা চলছে। এই হামলার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫)।

দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি। গাজার লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।

গত মাসের মাঝামাঝি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। এর জন্য নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দায়ী করা হয়।

গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায়, রক্তনদী বয়ে যাওয়ায় খোদ মিত্র দেশগুলোও এখন ইসরায়েলের সমালোচনায় সরব। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো প্রভাবশালী দেশ। এসব ঘটনায় বৈশ্বিকভাবে চাপে আছেন নেতানিয়াহু। এই চাপ উপেক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর নানান কৌশলের মধ্যে আছে বাগ্মিতার ব্যবহার।

আরও পড়ুনগাজায় জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল: জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তবে জাতিসংঘে নেতানিয়াহু যে দাবিটি করেছেন, সেটিকে কেবল বাগ্মিতা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে পর্দার আড়ালে, খুব গোপনে অনেক কিছুই ঘটে, যেগুলো সাধারণত প্রকাশ পায় না। ফলে নেতানিয়াহুর দাবিটিকে পুরোপুরি নাকচ করাও কঠিন।

এই যেমন সম্প্রতি চ্যানেল ৪-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চলমান জাতিগত নিধন অভিযানের মধ্যে গত আগস্টে যুক্তরাজ্য থেকে ইসরায়েলে ১ লাখ ১০ হাজার বুলেট সরবরাহ করা হয়েছে। একই মাসে ইসরায়েলে পাঠানো অন্যান্য চালানের মধ্যে ছিল ট্যাংকের যন্ত্রাংশ, শটগান বা রাইফেলের যন্ত্রাংশ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ।

অথচ এই যুক্তরাজ্যই গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আসছে। আর দেশটি গত ২১ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

আরও পড়ুনগাজায় জাতিগত নিধনের মধ্যেই এক মাসে ইসরায়েলে ১ লাখ বুলেট পাঠিয়েছে যুক্তরাজ্য০১ অক্টোবর ২০২৫

যুক্তরাজ্য সরকার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির ২৯টি লাইসেন্স স্থগিত করেছে। কারণ, এসব অস্ত্র আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হতে পারে। সে সময় যুক্তরাজ্য সরকার বলেছিল, তারা গাজায় বর্তমান সংঘাতে ব্যবহৃত হয় এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে যায় এমন পণ্যের বিক্রি আটকে দিচ্ছে।

তবে এটাও আবার ঠিক, যুক্তরাজ্যে এখনো প্রায় ৩৫০টি লাইসেন্স সক্রিয় রয়েছে। যার মধ্যে ১৬০টির বেশি ‘সামরিক’ লাইসেন্স হিসেবে তালিকাভুক্ত।

গাজা যুদ্ধ বন্ধে গত ২৯ সেপ্টেম্বর নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কার্যত ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষার চাতুর্যপূর্ণ এই পরিকল্পনাটিকে তাড়াহুড়া করে অনুমোদন দিয়েছে মুসলিমবিশ্বের বেশ কিছু প্রভাবশালী দেশ।

আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণার পর এখন কী হবে০২ অক্টোবর ২০২৫

সম্প্রতি মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইতিহাসবিদ ও ফিলিস্তিনবিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা হাসান বোখারি মুসলিম দেশগুলোর এই পদক্ষেপকে ফিলিস্তিনের প্রতি বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

হাসান বোখারির মতে, এই বিশ্বাসঘাতকতা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এ পরিকল্পনাকে সমর্থন দিয়ে মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ও তার গণহত্যাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।

প্রকাশ্যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে অস্ত্র বিক্রি, গোয়েন্দা সহায়তা, বাণিজ্যিক চুক্তি বজায় রাখা কিংবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থনকে এক অর্থে ‘গোপন ধন্যবাদ’ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু সম্ভবত এই ‘ধন্যবাদের’ কথাই বলেছেন।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্কার, ফোর্বস, রয়টার্স।

আরও পড়ুনগাজার সঙ্গে ৮ মুসলিম দেশ কি বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল০২ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ