হাজার হাজার ফিলিস্তিনির রক্ত যাঁর হাতে, তাঁর আবার ‘মান-অপমান’। তবু জাতিসংঘের মতো বিশ্বমঞ্চ বলে কথা।
বক্তৃতামঞ্চে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উঠতেই প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা গণহারে ওয়াকআউট করেন। অধিবেশনকক্ষ প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়।
‘গাজার কসাই’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া নেতানিয়াহু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মাথা ইতিউতি করেন। যেন কিছুই হয়নি—এমনটা বোঝাতে চাইলেন তিনি। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর অস্বস্তি চাপা থাকে না।
ভরা মজলিশে এমন ‘অপমান’ ঢাকতে কী করতে হয়, তা ধূর্ত রাজনীতিক নেতানিয়াহুর চেয়ে আর কারও ভালো জানার কথা নয়।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সৃষ্ট এমন পরিস্থিতির মধ্যে ভাষণ দেন নেতানিয়াহু। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘অনেক বিশ্বনেতা প্রকাশ্যে আমাদের নিন্দা করেন, আবার তাঁরাই গোপনে আমাদের ধন্যবাদ জানান।’
এখন প্রশ্ন হলো, নেতানিয়াহুর এই কথা কি সত্যি?
আরও পড়ুনপ্রকাশ্যে নিন্দা করলেও অনেক নেতাই গোপনে আমাদের ধন্যবাদ দেন: জাতিসংঘে নেতানিয়াহু২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫নেতানিয়াহু যে দাবিটি করলেন, তার পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করেননি। আবার ঠিক কোন কোন বিশ্বনেতা এমন দ্বিচারী আচরণ করেন, তাও তিনি বলেননি।
নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।
প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নেতানিয়াহুর। অপমান ঢাকার কৌশল তাঁর ঢের জানা। যাঁরা গণহারে ওয়াকআউট করেছেন, তাঁদের নিশানা করে পাল্টা আঘাত হানতে এমন কথা বলে থাকতে পারেন নেতানিয়াহু।
সে ক্ষেত্রে অনেকটা ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’ হলো।
এক.
দুই. নেতানিয়াহু নিজের অপমান সহজেই ঢাকতে পারলেন। গণহারে প্রতিবাদী ওয়াকআউটের প্রসঙ্গ ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে নেতানিয়াহুর বিতর্কিত বক্তব্য।
আরও পড়ুনজাতিসংঘে নেতানিয়াহু ভাষণ দিতে এলেই শুরু হয় প্রতিবাদ, বেরিয়ে যান অনেক প্রতিনিধি২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫নেতানিয়াহুর এমন কৌশল অবশ্য নতুন নয়। তিনি তাঁর সমালোচক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, এমনকি ‘প্রতিকূল’ বিচারপতিদের মোকাবিলায় এভাবে আক্রমণ করে থাকেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় কৌশলী বাগ্মিতা (রেটোরিক) ব্যবহার করে বিরোধীদের প্রশ্নবিদ্ধ করেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নেতানিয়াহুর দেওয়া একাধিক ভাষণ বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। এসব বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ন্যারেটিভ (বয়ান) নির্মাণ, নিজের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গঠন, দর্শক প্রভাবিত করা, জনমত নিয়ন্ত্রণ, বিভাজন তৈরির মতো উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহু তাঁর ভাষণে কৌশলী শব্দ, বাক্য, প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেছেন।
শুধু তা-ই নয়, নেতানিয়াহু ঘরে-বাইরে দেওয়া বক্তৃতায় দেদার ডাহা মিথ্যা বলে থাকেন। এর মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যু অন্যতম।
আরও পড়ুন৭৭ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর যেভাবে নেমে এসেছিল মহাবিপর্যয়১৪ মে ২০২৫২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা চলছে। এই হামলার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫)।
দুই বছরে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি। গাজার লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
গত মাসের মাঝামাঝি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। এর জন্য নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দায়ী করা হয়।
গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায়, রক্তনদী বয়ে যাওয়ায় খোদ মিত্র দেশগুলোও এখন ইসরায়েলের সমালোচনায় সরব। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো প্রভাবশালী দেশ। এসব ঘটনায় বৈশ্বিকভাবে চাপে আছেন নেতানিয়াহু। এই চাপ উপেক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর নানান কৌশলের মধ্যে আছে বাগ্মিতার ব্যবহার।
আরও পড়ুনগাজায় জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল: জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫তবে জাতিসংঘে নেতানিয়াহু যে দাবিটি করেছেন, সেটিকে কেবল বাগ্মিতা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে পর্দার আড়ালে, খুব গোপনে অনেক কিছুই ঘটে, যেগুলো সাধারণত প্রকাশ পায় না। ফলে নেতানিয়াহুর দাবিটিকে পুরোপুরি নাকচ করাও কঠিন।
এই যেমন সম্প্রতি চ্যানেল ৪-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চলমান জাতিগত নিধন অভিযানের মধ্যে গত আগস্টে যুক্তরাজ্য থেকে ইসরায়েলে ১ লাখ ১০ হাজার বুলেট সরবরাহ করা হয়েছে। একই মাসে ইসরায়েলে পাঠানো অন্যান্য চালানের মধ্যে ছিল ট্যাংকের যন্ত্রাংশ, শটগান বা রাইফেলের যন্ত্রাংশ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ।
অথচ এই যুক্তরাজ্যই গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আসছে। আর দেশটি গত ২১ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আরও পড়ুনগাজায় জাতিগত নিধনের মধ্যেই এক মাসে ইসরায়েলে ১ লাখ বুলেট পাঠিয়েছে যুক্তরাজ্য০১ অক্টোবর ২০২৫যুক্তরাজ্য সরকার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির ২৯টি লাইসেন্স স্থগিত করেছে। কারণ, এসব অস্ত্র আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হতে পারে। সে সময় যুক্তরাজ্য সরকার বলেছিল, তারা গাজায় বর্তমান সংঘাতে ব্যবহৃত হয় এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে যায় এমন পণ্যের বিক্রি আটকে দিচ্ছে।
তবে এটাও আবার ঠিক, যুক্তরাজ্যে এখনো প্রায় ৩৫০টি লাইসেন্স সক্রিয় রয়েছে। যার মধ্যে ১৬০টির বেশি ‘সামরিক’ লাইসেন্স হিসেবে তালিকাভুক্ত।
গাজা যুদ্ধ বন্ধে গত ২৯ সেপ্টেম্বর নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কার্যত ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষার চাতুর্যপূর্ণ এই পরিকল্পনাটিকে তাড়াহুড়া করে অনুমোদন দিয়েছে মুসলিমবিশ্বের বেশ কিছু প্রভাবশালী দেশ।
আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণার পর এখন কী হবে০২ অক্টোবর ২০২৫সম্প্রতি মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইতিহাসবিদ ও ফিলিস্তিনবিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা হাসান বোখারি মুসলিম দেশগুলোর এই পদক্ষেপকে ফিলিস্তিনের প্রতি বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
হাসান বোখারির মতে, এই বিশ্বাসঘাতকতা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এ পরিকল্পনাকে সমর্থন দিয়ে মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ও তার গণহত্যাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।
প্রকাশ্যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে অস্ত্র বিক্রি, গোয়েন্দা সহায়তা, বাণিজ্যিক চুক্তি বজায় রাখা কিংবা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থনকে এক অর্থে ‘গোপন ধন্যবাদ’ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু সম্ভবত এই ‘ধন্যবাদের’ কথাই বলেছেন।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্কার, ফোর্বস, রয়টার্স।
আরও পড়ুনগাজার সঙ্গে ৮ মুসলিম দেশ কি বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল০২ অক্টোবর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর জ য স প ট ম বর য় ইসর য় ল ইসর য় ল র প রক শ য ত হয় ছ কর ছ ন র জন ত ব যবহ অপম ন
এছাড়াও পড়ুন:
উৎপত্তিস্থল মাধবদীতে এপাশ-ওপাশ দুলছিল উঁচু ভবনগুলো, মাটিতে ফাটল
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদীর সবচেয়ে বড় ভবন জে অ্যান্ড জে টাওয়ার। ১৪ তলা টাওয়ারটির দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থতলাজুড়ে একটি বেসরকারি হাসপাতাল। পঞ্চম থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত ৪৮টি ফ্ল্যাটে লোকজনের বসবাস।
হাসপাতালটির চেয়ারম্যান সনেট মো. নোমান ভূমিকম্পের সময় হাসপাতালেই ছিলেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরো ভবনটি এপাশ-ওপাশ দুলছিল। হাসপাতালের রোগীসহ সবাই হুড়োহুড়ি শুরু করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাতে স্যালাইনসহ কয়েকজন রোগীকে নিচে নেমে যেতে দেখা যায়। ভবনটির চারটি এক্সিট পয়েন্ট থাকায় ভালোভাবে সবাই নেমে যেতে পারেন।’
ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক ইয়াসির আরাফাত ও নিরাপত্তা প্রহরী মো. ফালু মিয়া জানান, এমন ভূমিকম্প তিনি আগে কখনো দেখেননি। কম্পন শেষ হলে সবাই আবার বাসাবাড়ি ও হাসপাতালে ফিরে যান।
মারাত্মক ভয় পেয়েছিলাম, দোকানে লোকজনের সঙ্গে আমি নিজেও সব রেখে সড়কের মাঝখানে বের হয়ে পড়ছিলাম।পৌরসভাসংলগ্ন চা–দোকানি বজলু মিয়ানরসিংদী সদর হাসপাতাল, ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে ভূমিকম্পে আহত এ পর্যন্ত ৮০ জন ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ভূমিকম্পের সময় নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি সাবস্টেশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে সাবস্টেশনটির যন্ত্রাংশ পুড়ে গেলে পলাশ ও ঘোড়াশালের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
পলাশ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. আবদুল শহিদ জানান, তাঁদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. এনামুল হক জানান, ভূমিকম্পে এ আগুনের সূত্রপাত। বেলা দুইটার পর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।
ঘোড়াশাল ঈদগাহ রোডের মারকাসুল সুন্নাহ তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি সালাউদ্দিন আনসারী বলেন, ‘আমাদের মাদ্রাসার ছয়তলা ভবনের চার-পাঁচটি জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা সবাই আতঙ্কিত।’
ফজলুল হক বলেন, ভূমিকম্পের সময় বাড়ির বাসিন্দাদের অন্তত ৮০ জন অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলে অধিকাংশই হুড়োহুড়ি করে নিচে নেমে আসেন। সবাই এতটাই আতঙ্কিত ছিলেন যে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে কেউ কেউ হাত–পায়ে আঘাত পেয়েছেন। কপাল ভালো, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।‘এত ভয় কখনো পাইনি’ছোট মাধবদী এলাকার একটি পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলার বাসিন্দা জসিম মিয়া স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বের হয়ে রাস্তায় চলে আসেন। তিনি বলছিলেন, ‘ভূমিকম্পের এমন ঝাঁকুনি আমার জীবনে আর কখনো দেখি নাই। সব বাড়িঘরের ভেতর থেকে লোকজন রাস্তায় চলে আসছিলেন। আতঙ্কে শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম।’
পৌরসভাসংলগ্ন চা–দোকানি বজলু মিয়া বলেন, ‘মারাত্মক ভয় পেয়েছিলাম, দোকানে লোকজনের সঙ্গে আমি নিজেও সব রেখে সড়কের মাঝখানে বের হয়ে পড়ছিলাম।’
গৃহবধূ সালমা আক্তার (৩৫) গরুরহাট এলাকার একটি সাততলা ভবনের পাঁচতলায় চার বছর বয়সী শিশুসন্তান নিয়ে থাকেন। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ভবনের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পান। তিনি বলেন, ‘এত ভয় কখনো পাইনি।’
বিরামপুর এলাকার ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন (৫২) বলেন, জীবনে তিনি এমন ভয়ংকর ভূমিকম্প আগে কখনো দেখেননি।
মাধবদীর নওয়াপাড়া এলাকার ছয়তলা ভবনের মালিক ফজলুল হক। তাঁর বাড়ির ২০টি ফ্ল্যাটে শতাধিক মানুষের বসবাস। ফজলুল হক বলেন, ভূমিকম্পের সময় বাড়ির বাসিন্দাদের অন্তত ৮০ জন অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলে অধিকাংশই হুড়োহুড়ি করে নিচে নেমে আসেন। সবাই এতটাই আতঙ্কিত ছিলেন যে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে কেউ কেউ হাত–পায়ে আঘাত পেয়েছেন। কপাল ভালো, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
নরসিংদীতে যাঁদের মৃত্যুভূমিকম্পের প্রভাবে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নরসিংদী সদর উপজেলায় পার্শ্ববর্তী বহুতল ভবনের নির্মাণসামগ্রী ধসে বাবা-ছেলে দুজন, পলাশ উপজেলায় মাটির ঘরের দেয়াল ধসে একজন ও স্ট্রোক করে একজন এবং শিবপুর উপজেলায় গাছ থেকে পড়ে একজন নিহত হয়েছেন।
সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলী এলাকায় ভূমিকম্পের সময় পার্শ্ববর্তী এক বহুতল ভবনের নির্মাণসামগ্রী ছিটকে একতলা ভবনের ছাদ ধসে বাবা-ছেলে নিহত হয়েছেন। দুপুরে ঢাকায় নেওয়ার পথে ছেলের ও বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাবার মৃত্যু হয়। নিহত বাবা-ছেলে হলেন, মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৭) ও মো. ওমর ফারুক (৯)। দেলোয়ার হোসেন গাবতলী এলাকার মৃত আবদুল আজিজের ছেলে। বাবা-ছেলের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেন নিহত দেলোয়ারের ভাই জাকির হোসেন।
পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর ইউনিয়নের মালিতা গ্রামের পশ্চিমপাড়া এলাকার মাটির ঘরের দেয়াল ধসে নিহত ব্যক্তির নাম কাজম আলী ভূঁইয়া (৭৫)। তিনি ওই এলাকার মৃত বশর উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে। দুর্ঘটনার সময় দুই নাতি-নাতনিকে নিয়ে ওই মাটির ঘরটিতে অবস্থান করছিলেন তিনি।
পলাশ উপজেলার অন্তত দুটি স্থানে ভূমিকম্পের প্রভাবে মাটিতে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি পৌর এলাকার দড়িহাওলাপাড়ার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের কাঁচা রাস্তায় ফাটল দেখা দিয়েছে।পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজীরচর গ্রামের নয়াপাড়ায় ভূমিকম্পের সময় স্ট্রোক করে মারা যাওয়া ব্যক্তির নাম নাসির উদ্দীন (৬৫)। ওই সময় ঘরের ভেতরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি।
এ ছাড়া শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের আজকিতলা গ্রামে ভূমিকম্পের সময় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে ফোরকান মিয়া (৩৫) নামের একজনের মৃত্যু হয়। সন্ধ্যায় নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
ভূমিকম্পে তাঁর মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করে শিবপুর থানার ওসি আফজাল হোসেন জানান, ভূমিকম্পের সময় ফোরকান মিয়া গাছের ওপরে ছিলেন। তীব্র ঝাঁকুনিতে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যান। পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা তাঁকে হাসপাতালে নেন। সন্ধ্যায় নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
ভূমিকম্পে মাটিতে ফাটলপলাশ উপজেলার অন্তত দুটি স্থানে ভূমিকম্পের প্রভাবে মাটিতে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি পৌর এলাকার দড়িহাওলাপাড়ার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের কাঁচা রাস্তায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই স্কুল অ্যান্ড কলেজটির পরিচালক আরিফ পাঠান জানান, তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার রাস্তা হিসেবে সড়কটি ব্যবহৃত হয়। গতকাল সকালে ভূমিকম্পের সময় তীব্র ঝাঁকুনিতে কাঁচা সড়কটিতে ফাটল দেখা দেয়।
এ ছাড়া পৌর এলাকার লেবুপাড়ার ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্ম নামের একটি গরুর খামারে দীর্ঘ ফাটল দেখা দিয়েছে। খামারের আঙিনার মাঝবরাবর এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একাধিক ফাটল দেখা দেয়। ভূমিকম্পের সময় এসব ফাটল দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মরত শ্রমিকেরা।