জয়াগ গান্ধী আশ্রম নিয়ে কিছু স্মৃতি
Published: 7th, October 2025 GMT
২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে উদ্যাপন করেছেন, যাঁরা এই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের মানবতার অবদানে শ্রদ্ধাশীল।
বাংলাদেশের নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একটি দূরবর্তী গ্রাম জয়াগে, একটি গান্ধী আশ্রম রয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্থানীয় দানশীল ব্যারিস্টার হেমন্ত ঘোষ কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যারিস্টার ঘোষ তাঁর সম্পূর্ণ সম্পত্তি মহাত্মা গান্ধীর নামে একটি ট্রাস্ট হিসেবে দান করেছিলেন, যাতে গান্ধীজির নোয়াখালী সফরের পর সেখানে কল্যাণমূলক কার্যক্রম চালানো যায়।
১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর গান্ধী চার মাস নোয়াখালীতে অবস্থান করেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পদযাত্রায় পরিদর্শন করেন এবং উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অহিংসার বার্তা প্রচার করেন।
গান্ধী আশ্রমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আকস্মিকভাবে। একটি সরকারি গেজেটে আমি জানলাম যে সরকার (তখন খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েছেন একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে) নোয়াখালীর জয়াগ গ্রামে অবস্থিত গান্ধী আশ্রমের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করেছে।
আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ ও জাতি হিসেবে এটি একটি গর্বের বিষয় যে আমাদের দেশে এমন একটি স্থান রয়েছে, যেখানে আমরা মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর মানবতার জন্য করা কাজকে স্মরণ করতে পারি।আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে ট্রাস্টের একজন সদস্য। ট্রাস্টের সভাপতি হাইকোর্টের বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচাযে৴র বাবা) এবং আরও কয়েকজন সদস্য, যার মধ্যে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বাংলাদেশ শাখার পরিচালক, আর জয়াগের বাসিন্দা চারু চৌধুরী যাঁকে ট্রাস্টের সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল।
আমি তখন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে সদ্য গিয়েছি (১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে), তাই জেলা সম্পর্কে (তখন নোয়াখালী জেলা ভাগ হয়নি) আমার সম্পূর্ণ জানা নেই। জয়াগ গ্রাম বেগমগঞ্জ থানায়, যা নোয়াখালীর মাইজদী শহরের খুব কাছে। আমি সেখানে প্রায়ই গিয়েছি; কিন্তু জয়াগ গ্রাম বা সেখানে একটি গান্ধী আশ্রম আছে, আমাকে কেউ বলেনি। বলা বাহুল্য আশ্রম মোটামুটি খুব একটা পরিচিত ছিল না শুধু স্থানীয় লোক ছাড়া।
গেজেটটি প্রকাশিত হয় গান্ধীজির জন্ম তারিখে (২ অক্টোবর) ইচ্ছাকৃতভাবে। কারণ, তখন খোন্দকার মোশতাক ভারত সম্পর্কে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। গান্ধীর জন্মদিনে গান্ধী আশ্রম পুনরুজ্জীবিত করে একটি সরকারি উদ্যোগে ট্রাস্ট করে ভারতকে কিছু সন্তুষ্ট করার প্রয়াস ছিল এটা। আমি অবাক হলাম না, তবে আমি তৎপর হলাম জয়াগ আশ্রম সম্পর্কে আরও তথ্য বের করতে আর চারু চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হতে।
আরও পড়ুনবর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন এবং ক্লাইভ, চার্চিল ও গান্ধী১৭ জুন ২০২০জয়াগ ও আশ্রমের অবস্থান সম্পর্কে আমার কর্মীদের কাছ থেকে খোঁজখবর নেওয়ার সময়, গেজেট প্রকাশের পরদিন চারু চৌধুরী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি ছিলেন হালকা গড়নের, ফরসা চেহারার একজন ব্যক্তি । তখন ৭১ বছর বয়সী ছিলেন। আমরা বসে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা কথা বলি—একটি মুগ্ধকর আলাপচারিতা।
চারু চৌধুরী ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ শিষ্য। তিনি গান্ধীর সঙ্গে দাঙ্গার পর নোয়াখালী সফরে এসেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমি আশ্রমের ইতিহাস শুনি—কীভাবে এটি অবহেলা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয়ে অসামাজিক মানুষদের দ্বারা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তিনি আমাকে জানান, গান্ধীজির নির্দেশে তিনি কখনো আশ্রম ছেড়ে যাননি, যদিও তাঁর জীবন হুমকির মুখে পড়েছিল, সম্পত্তি হারিয়েছেন, এবং পাকিস্তান সরকারের হাতে বারবার কারাবরণ করেছেন।
পরদিন তিনি আমাকে জয়াগে নিয়ে যান আশ্রম পরিদর্শনে, যা প্রায় ১৫ থেকে ২০ মাইল দূরে। দৃশ্যটি ছিল করুণ—একটি ছাঁচ ধরা, শেওলাবৃত ভবন, যা একসময় সবজির বাগান ছিল, এখন ঝোপঝাড়ে ঢাকা। ভবনের ছাদে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ার চিহ্ন ছিল। ভেতরে ছিল চরকা, একটি তাঁত মেশিন এবং কিছু হস্তশিল্প তৈরির সরঞ্জাম। কয়েকজন নারী সেখানে কাজ করছিলেন। চারু চৌধুরী জানান, তাঁরা স্থানীয় নারী, যাঁরা নিয়মিত তাঁত ও সুতা কাটার প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। তিনি তখনো সম্পদহীন অবস্থায় দরিদ্রদের জন্য একটি কেন্দ্র পরিচালনা করছিলেন। তাঁর আশা ছিল, সরকার ট্রাস্ট গঠন করায় এখন অর্থায়ন আসবে।
আরও পড়ুন'বর্ণবাদী' গান্ধী এবং আফ্রিকার প্রতিশোধ০২ জানুয়ারি ২০১৯দুঃখজনকভাবে, চারু চৌধুরীর সেই আশা বা স্বপ্ন যে আশ্রম পুনরুজ্জীবিত হবে, তা তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের সহিংস অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা সরকার গান্ধী ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশকে খুশি করার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছিল, আশ্রম পুনর্গঠনের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না। এটি আমরা দুজনই বুঝতে পারি, যখন আশ্রমে কোনো নতুন তহবিল আসেনি। তখন স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা (জেলা বোর্ডের তহবিলসহ) এবং চারু চৌধুরীর বুদ্ধিমত্তায় কেন্দ্রের পুনরুদ্ধারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
এই প্রচেষ্টায় সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি অনেক সহায়ক হয়। চারু চৌধুরী, ট্রাস্টের সচিব হিসেবে আদালতে ট্রাস্টের জমি পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করতে সক্ষম হন। আদালত ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় জমি উদ্ধার হয় এবং ভবিষ্যতের অনধিকার প্রবেশ রোধ করা যায়। কিছু সংস্কার কাজ শুরু হয় এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা আসতে শুরু করেন।
আশ্রমের প্রাণ ফিরে পেতে আবারও কয়েক বছর সময় লাগে। চারু চৌধুরী এবং তাঁর সহযোগীদের (যাদের মধ্যে বর্তমান সচিব ঝর্ণা চৌধুরীও রয়েছেন) নিরলস পরিশ্রমে আশ্রম পুনর্গঠিত হয়। আজ আশ্রমটি শুধু একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নয়; বরং একটি জাদুঘর—যা সেই মহান আত্মার স্মৃতিকে উৎসর্গ করা হয়েছে, যিনি নিজের চেয়ে অন্যদের কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
আরও পড়ুনগান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসের উত্থান-পতন০৪ নভেম্বর ২০১৭আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ ও জাতি হিসেবে এটি একটি গর্বের বিষয় যে আমাদের দেশে এমন একটি স্থান রয়েছে, যেখানে আমরা মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর মানবতার জন্য করা কাজকে স্মরণ করতে পারি। জয়াগের গান্ধী আশ্রম আমাদের সবার জন্য একটি শান্ত বার্তা—জীবনের প্রতিকূলতা কখনোই গান্ধীর প্রকৃত শিষ্যদের তাঁর আদর্শ অনুসরণ থেকে বিরত রাখতে পারে না। চারু চৌধুরী কখনোই ভুলে যাননি গান্ধীর সেই বাণী, ‘মানবতার প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না। মানবতা একটি মহাসাগর; যদি মহাসাগরের কয়েকটি বিন্দু নোংরা হয়, তাতে মহাসাগর নোংরা হয়ে যায় না।’
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র দ শ ম নবত র র জন য জয় গ গ অবস থ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৪৯তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মিতা, এ পর্যন্ত আসতে কত কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়েছে তাঁকে
মিতা তখন খুবই ছোট। একদিন শুনলেন, তাঁর বাবা মাহাবুল ইসলাম হারিয়ে গেছেন। বাড়ির সবাই পাগলপ্রায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল মিতার বাবা ঢাকায় আছেন। রিকশা চালাচ্ছেন। বার্তাবাহকের মাধ্যমে মিতাদের চিন্তা করতে নিষেধ করে বলেছেন, ঢাকায় গিয়ে কী করবেন, কোথায় উঠবেন, কিছুই ঠিক ছিল না। তাই কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম কাপড়চোপড়ের ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে এখানে-সেখানে ঘুমিয়েছেন। তারপর রিকশা চালানোর সুযোগ পেয়েছেন।
মিতা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বাবা একবারে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। তাঁদের বাড়ি বাঘা উপজেলার চকনারায়ণপুর গ্রামে। এই গ্রামের বাজারেই পরে চায়ের দোকান দেন। সঙ্গে বিস্কুট-কলাও রাখেন। সেটি এখনো তাঁদের আয়ের একমাত্র উৎস। তাতে কিছুতেই সংসার চলে না। বাবা তাই বিভিন্ন এনজিওতে ঋণ করেন। মাসে মাসে সেই ঋণের কিস্তি টানেন।
না পাওয়ার আঘাত নিয়ে বড় হওয়াপ্রতিটি ক্লাসেই কিছু সহযোগী বই কিনতে হয়। কোনো দিনই সেই বই একসঙ্গে কেনা হয়নি মিতার। সময় নিয়ে একটার পর একটা করে কিনতেন। এ জন্য ক্লাসের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ভালো হতো না। শিক্ষকেরা নবম শ্রেণিতে ওঠার পর তাঁর এই সংকটের বিষয়টা বুঝতে পারেন। তখন থেকে তাঁদের সৌজন্য সংখ্যাগুলো সব দিয়ে দিতেন। ওই দুই বছর আর বই নিয়ে সমস্যা হয়নি। মিতার ভাষায়, ‘জীবনে প্রথম সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছিলাম নবম শ্রেণিতে ওঠার পর।
আমি ফার্স্ট হয়েছি। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই জানে, আমি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হব। বাড়িতে গিয়ে দেখি বাবার মুখ ভারী। বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে অনেক খরচ। আমাদের অত সামর্থ্য নেই।’
এ কথা শুনে মিতার মতো তাঁর শিক্ষকদের মনেও বিষাদের ছায়া নেমে এল। তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক সাজিদুল ইসলাম। মানবিক বিভাগের বই নিতে গেলে মিতাকে পরপর তিন দিন তিনি ফিরিয়ে দিলেন, যেন বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। শেষে মানবিকেই পড়তে হলো মিতাকে।
২০১৭ সালে বাঘার রহমতুল্লাহ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করলেন মিতা। নম্বর পেলেন ১১৯৪, মানবিক বিভাগ থেকে উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের যেকোনো কলেজে ভর্তি হতে পারতেন কিন্তু এবারও আর্থিক কারণে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হলো স্থানীয় মোজাহার হোসেন মহিলা ডিগ্রি কলেজে। ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ (১১৪১ নম্বর) পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এবারও উপজেলার মধ্যে মানবিকে সর্বোচ্চ নম্বর মিতার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ও বাধার মুখে পড়লেন মিতা। বললেন, ‘আমার মা (সেলিনা বেগম) অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছাটা তিনি জানতেন। তাই আমার এসএসসির স্কলারশিপের ১৬ হাজার টাকা দিয়ে দুটি ছাগল কিনে রেখেছিলেন। আমি জীবনে অনেক ‘‘না’’ শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যেন আমাকে আরেকটা না শুনতে না হয়, সেই জন্য মা এই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।’
এইচএসসির ফল প্রকাশের পর মিতার বাবা রাজশাহীতেই মেয়েকে ভর্তি হতে বললেন। কিন্তু শিক্ষকদের চাপাচাপি আর পরামর্শে মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মিতার শিক্ষকেরা চাঁদা তুলে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সহযোগিতা করলেন।
মিতা বলেন, ‘আমাকে না জানিয়েই তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখনকার ইউএনও শাহীন রেজাও সহযোগিতা করেছিলেন।’
শিক্ষকের শাড়ি পরে ভাইভা দিয়েছেন মিতা খাতুন