২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে উদ্‌যাপন করেছেন, যাঁরা এই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের মানবতার অবদানে শ্রদ্ধাশীল।

বাংলাদেশের নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একটি দূরবর্তী গ্রাম জয়াগে, একটি গান্ধী আশ্রম রয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্থানীয় দানশীল ব্যারিস্টার হেমন্ত ঘোষ কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যারিস্টার ঘোষ তাঁর সম্পূর্ণ সম্পত্তি মহাত্মা গান্ধীর নামে একটি ট্রাস্ট হিসেবে দান করেছিলেন, যাতে গান্ধীজির নোয়াখালী সফরের পর সেখানে কল্যাণমূলক কার্যক্রম চালানো যায়।

১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর গান্ধী চার মাস নোয়াখালীতে অবস্থান করেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পদযাত্রায় পরিদর্শন করেন এবং উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অহিংসার বার্তা প্রচার করেন।

গান্ধী আশ্রমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আকস্মিকভাবে। একটি সরকারি গেজেটে আমি জানলাম যে সরকার (তখন খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েছেন একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে)  নোয়াখালীর জয়াগ গ্রামে অবস্থিত গান্ধী আশ্রমের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করেছে। 

আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ ও জাতি হিসেবে এটি একটি গর্বের বিষয় যে আমাদের দেশে এমন একটি স্থান রয়েছে, যেখানে আমরা মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর মানবতার জন্য করা কাজকে স্মরণ করতে পারি।

আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে ট্রাস্টের একজন সদস্য। ট্রাস্টের সভাপতি হাইকোর্টের বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচাযে৴র বাবা) এবং আরও কয়েকজন সদস্য, যার মধ্যে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বাংলাদেশ শাখার পরিচালক, আর জয়াগের বাসিন্দা চারু চৌধুরী যাঁকে ট্রাস্টের সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল।

আমি তখন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে সদ্য গিয়েছি (১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে), তাই জেলা সম্পর্কে (তখন নোয়াখালী জেলা ভাগ হয়নি) আমার সম্পূর্ণ জানা নেই।  জয়াগ গ্রাম বেগমগঞ্জ থানায়, যা নোয়াখালীর মাইজদী শহরের খুব কাছে। আমি সেখানে প্রায়ই গিয়েছি; কিন্তু জয়াগ গ্রাম বা সেখানে একটি গান্ধী আশ্রম আছে, আমাকে কেউ বলেনি। বলা বাহুল্য আশ্রম মোটামুটি খুব একটা পরিচিত ছিল না শুধু স্থানীয় লোক ছাড়া।

গেজেটটি প্রকাশিত হয় গান্ধীজির জন্ম তারিখে (২ অক্টোবর) ইচ্ছাকৃতভাবে। কারণ, তখন খোন্দকার মোশতাক ভারত সম্পর্কে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। গান্ধীর জন্মদিনে গান্ধী আশ্রম পুনরুজ্জীবিত করে একটি সরকারি উদ্যোগে ট্রাস্ট করে ভারতকে কিছু সন্তুষ্ট করার প্রয়াস ছিল এটা।  আমি অবাক হলাম না, তবে আমি তৎপর হলাম জয়াগ আশ্রম সম্পর্কে আরও তথ্য বের করতে আর চারু চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত হতে।

আরও পড়ুনবর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন এবং ক্লাইভ, চার্চিল ও গান্ধী১৭ জুন ২০২০

জয়াগ ও আশ্রমের অবস্থান সম্পর্কে আমার কর্মীদের কাছ থেকে খোঁজখবর নেওয়ার সময়, গেজেট প্রকাশের পরদিন চারু চৌধুরী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি ছিলেন হালকা গড়নের, ফরসা চেহারার একজন ব্যক্তি । তখন ৭১ বছর বয়সী ছিলেন। আমরা বসে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা কথা বলি—একটি মুগ্ধকর আলাপচারিতা।

চারু চৌধুরী ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ শিষ্য। তিনি গান্ধীর সঙ্গে দাঙ্গার পর নোয়াখালী সফরে এসেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আমি আশ্রমের ইতিহাস শুনি—কীভাবে এটি অবহেলা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয়ে অসামাজিক মানুষদের দ্বারা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তিনি আমাকে জানান, গান্ধীজির নির্দেশে তিনি কখনো আশ্রম ছেড়ে যাননি, যদিও তাঁর জীবন হুমকির মুখে পড়েছিল, সম্পত্তি হারিয়েছেন, এবং পাকিস্তান সরকারের হাতে বারবার কারাবরণ করেছেন।

পরদিন তিনি আমাকে জয়াগে নিয়ে যান আশ্রম পরিদর্শনে, যা প্রায় ১৫ থেকে ২০ মাইল দূরে। দৃশ্যটি ছিল করুণ—একটি ছাঁচ ধরা, শেওলাবৃত ভবন, যা একসময় সবজির বাগান ছিল, এখন ঝোপঝাড়ে ঢাকা। ভবনের ছাদে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ার চিহ্ন ছিল। ভেতরে ছিল চরকা, একটি তাঁত মেশিন এবং কিছু হস্তশিল্প তৈরির সরঞ্জাম। কয়েকজন নারী সেখানে কাজ করছিলেন। চারু চৌধুরী জানান, তাঁরা স্থানীয় নারী, যাঁরা নিয়মিত তাঁত ও সুতা কাটার প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। তিনি তখনো সম্পদহীন অবস্থায় দরিদ্রদের জন্য একটি কেন্দ্র পরিচালনা করছিলেন। তাঁর আশা ছিল, সরকার ট্রাস্ট গঠন করায় এখন অর্থায়ন আসবে।

আরও পড়ুন'বর্ণবাদী' গান্ধী এবং আফ্রিকার প্রতিশোধ০২ জানুয়ারি ২০১৯

দুঃখজনকভাবে, চারু চৌধুরীর সেই আশা বা স্বপ্ন যে আশ্রম পুনরুজ্জীবিত হবে, তা তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭৫ সালের আগস্টের সহিংস অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা সরকার গান্ধী ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশকে খুশি করার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছিল, আশ্রম পুনর্গঠনের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল না। এটি আমরা দুজনই বুঝতে পারি, যখন আশ্রমে কোনো নতুন তহবিল আসেনি। তখন স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা (জেলা বোর্ডের তহবিলসহ) এবং চারু চৌধুরীর বুদ্ধিমত্তায় কেন্দ্রের পুনরুদ্ধারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।

এই প্রচেষ্টায় সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি অনেক সহায়ক হয়। চারু চৌধুরী, ট্রাস্টের সচিব হিসেবে আদালতে ট্রাস্টের জমি পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করতে সক্ষম হন। আদালত ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় জমি উদ্ধার হয় এবং ভবিষ্যতের অনধিকার প্রবেশ রোধ করা যায়। কিছু সংস্কার কাজ শুরু হয় এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা আসতে শুরু করেন।

আশ্রমের প্রাণ ফিরে পেতে আবারও কয়েক বছর সময় লাগে। চারু চৌধুরী এবং তাঁর সহযোগীদের (যাদের মধ্যে বর্তমান সচিব ঝর্ণা চৌধুরীও রয়েছেন) নিরলস পরিশ্রমে আশ্রম পুনর্গঠিত হয়। আজ আশ্রমটি শুধু একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নয়; বরং একটি জাদুঘর—যা সেই মহান আত্মার স্মৃতিকে উৎসর্গ করা হয়েছে, যিনি নিজের চেয়ে অন্যদের কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

আরও পড়ুনগান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসের উত্থান-পতন০৪ নভেম্বর ২০১৭

আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশ ও জাতি হিসেবে এটি একটি গর্বের বিষয় যে আমাদের দেশে এমন একটি স্থান রয়েছে, যেখানে আমরা মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর মানবতার জন্য করা কাজকে স্মরণ করতে পারি। জয়াগের গান্ধী আশ্রম আমাদের সবার জন্য একটি শান্ত বার্তা—জীবনের প্রতিকূলতা কখনোই গান্ধীর প্রকৃত শিষ্যদের তাঁর আদর্শ অনুসরণ থেকে বিরত রাখতে পারে না। চারু চৌধুরী কখনোই ভুলে যাননি গান্ধীর সেই বাণী, ‘মানবতার প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না। মানবতা একটি মহাসাগর; যদি মহাসাগরের কয়েকটি বিন্দু নোংরা হয়, তাতে মহাসাগর নোংরা হয়ে যায় না।’

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র দ শ ম নবত র র জন য জয় গ গ অবস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

লিও তলস্তয়ের গ্রামে

আমি এখন যে গ্রামে এসেছি, সেই গ্রামে ১৮২৮ সালে লেখক লিও তলস্তয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাশিয়ার ইয়াস্নায়া পলিয়ানা নাম গ্রামটির। এটি আসলে তাঁদের পারিবারিক জমিদারির একটি অংশ। এখানে তিনি জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। এখানেই লিখেছেন অমর উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’ এবং অসংখ্য গল্প।

তলস্তয়কে আইন পড়তে কাজান শহরে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু পড়তে তাঁর ভালো লাগেনি। জমিদারি ছিল, তাই রোজগারের চিন্তাও করতে হয়নি। মাঝখানে সন্তানদের পড়ালেখার জন্য আট বছর মস্কোতে একটি বাড়ি কিনে বসবাস করেছিলেন।

লিও তলস্তয় শেষ জীবনে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। একসময় গৃহত্যাগ করেছিলেন। ১৯১০ সালে ৮২ বছর বয়সে আস্তাপোভো রেলস্টেশনে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে একাকী, আত্মীয়, বন্ধু থেকে দূরে, নীরবে তিনি দেহত্যাগ করেন। এরপর তাঁকে ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় এনে সমাহিত করা হয়।

ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে আমি যখন পৌঁছালাম, তখন রোদ ঝলমল করছে। গত কয়েক দিন খুব বৃষ্টি পড়েছে মস্কো শহরে। মস্কো থেকে আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ২২০ কিলোমিটার। সরাসরি মস্কো থেকে তলস্তয়ের গ্রামে আসার কোনো ট্রেন বা বাস নেই। আমাকে ট্রেনে করে আসতে হয়েছে প্রথমে তুলা শহরে৷

ট্রেনে করে আসার পথে রাশিয়ার সবুজ গ্রামের যে রূপ আমি দেখেছি, তার তুলনা হয় না। পথের পাশে ফুটে আছে হলুদ বুনো ফুল আর হঠাৎ হঠাৎ করে একটা বা দুটো দোচালা বাড়ি। মাঝে পড়ে গেল একটা নদী, আবার এসে গেল ঘন সবুজ জঙ্গল। এমন অসামান্য প্রকৃতি যে দেশের আছে, সে দেশের প্রতি এমনিতেই মায়া জন্মে যায়।

রাশিয়ার ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে ১৮২৮ সালে লেখক লিও তলস্তয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটি তাঁদের পারিবারিক জমিদারির একটি অংশ। এখানে তলস্তয় জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। এখানেই লিখেছেন অমর উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’।মাঝখানে ধূসর লম্বা পথ আর দুপাশে ঘন বনানী

সম্পর্কিত নিবন্ধ