আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে। অনেক দেশ এখন নিজেদের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল শিখছে। রাশিয়া ও চীন এই খেলায় কিছুটা সফল হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই খেলা খেলতে গিয়ে উল্টো নিজের বিপদ ডেকে আনছে।

রাশিয়া মনে করেছিল, ইউরোপ যেহেতু তার জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, সেহেতু তারা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ মেনে নিতে বাধ্য হবে। এ ধারণা আংশিকভাবে সঠিকও ছিল, কারণ ইউরোপ এখনো রুশ তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরতা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।

তা ছাড়া জ্বালানি-বাণিজ্যই এখন রাশিয়ার সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক দৃঢ় করার মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে। আর এই জ্বালানি–বাণিজ্যই নতুন এক আমেরিকান জোটবিরোধী অর্থনৈতিক ভিত তৈরি করছে।

চীনও সমান শক্ত অবস্থানে আছে। কারণ, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল, বিশেষ করে রেয়ার আর্থ বা দুষ্প্রাপ্য খনিজ এবং অন্যান্য ক্রিটিক্যাল মিনারেলস উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোপুরি চীনের হাতে।

আরও পড়ুনভারতকে বশ মানাতে গিয়ে উল্টো বিপদে ট্রাম্প০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম শুধু সবুজ জ্বালানিপ্রযুক্তির জন্য নয়, এলইডি, ফাইবার অপটিকস ও উচ্চ ক্ষমতার ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরিতেও অপরিহার্য। আবার অ্যান্টিমোনি (যার বেশির ভাগই চীন থেকে আসে) উচ্চমানের সামরিক সরঞ্জাম ও অগ্নিনিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গত এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘লিবারেশন ডে’ নামে পরিচিত নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর চীন সাতটি অতিরিক্ত রেয়ার আর্থের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এগুলো হলো, সামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, টারবিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, লুটেটিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম।

আগে এদের কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকলেও এখন যুক্তরাষ্ট্র তার ভুল বুঝতে পারছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে দ্রুত একাধিক ফ্রন্টে বাণিজ্যযুদ্ধে পিছু হটতে হয়েছে।

এবার যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়া ও চীনের মতো কৌশল নকল করার চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে তারা নিজেদের জ্বালানি উৎপাদন বাড়াচ্ছে এবং তারা রেয়ার আর্থের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি অর্থ ঢালছে। কিন্তু দুটি উদ্যোগই জটিল সমস্যায় ভুগছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রার ইতিহাসে দেখা গেছে, কোনো মুদ্রার আধিপত্য কখনোই স্থায়ী নয়। যেমন দ্য ইকোনমিস্টের সম্পাদক ওয়াল্টার বাজেট উনিশ শতকে বলেছিলেন, ব্রিটেনের অর্থব্যবস্থা ছিল ‘অর্থনৈতিক শক্তি ও ভঙ্গুরতার এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ’। আজ সে কথা ডলারের ক্ষেত্রেও হুবহু প্রযোজ্য।

স্বল্প মেয়াদে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বাড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে নতুন খনন ও পাইপলাইন বিনিয়োগ লাগবে। কিন্তু যেহেতু নন-কার্বন এনার্জির খরচ দ্রুত কমছে, তাই কোম্পানিগুলো ফসিল জ্বালানিতে বড় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতা দীর্ঘস্থায়ী নয়, বরং ক্ষণস্থায়ী এক উত্থান হবে।

কিন্তু কথা হলো, রেয়ার আর্থ উৎপাদন তুলনামূলকভাবে সম্ভব, কিন্তু তাতে সময় লাগবে। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন পাস খনি ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে এই খাতের বিনিয়োগকারীরা একের পর এক দেউলিয়া হয়েছেন।

২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন মার্কিন কোম্পানি এমপি ম্যাটেরিয়ালস কিছুটা ভিন্ন পথে হেঁটেছে। তারা মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরকে ৪০ কোটি ডলারের শেয়ার দিয়েছে এবং খননকৃত উপকরণ কেনার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু এই ‘ট্রাম্পীয় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ দেউলিয়াত্ব রোধ করতে পারলেও অলৌকিক কিছু ঘটাতে পারবে বলে মনে হয় না। টেন এক্স ফ্যাসিলিটি নামের তাদের প্রধান প্রকল্প ২০২৮ সালের আগে উৎপাদন শুরু করতে পারবে না।

ফলে ট্রাম্প প্রশাসন এখন এমন কিছু করতে চাইছে, যার ফল পাওয়া যাবে তাড়াতাড়ি। আর সে কারণেই তারা ডলারের ব্যবহারকে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছে।

আরও পড়ুনএশিয়া যেভাবে ডলার-নির্ভরতা কমাতে পারে০২ অক্টোবর ২০২৫

ষাটের দশকে ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী ভ্যালেরি জিসকার দেস্ত্যাঁ বলেছিলেন, বিশ্বের প্রধান মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অতিরিক্ত সুবিধা’ দিয়েছে। এখন ট্রাম্প মনে হচ্ছে, এই সুবিধার সীমা পরীক্ষা করতে চাইছেন। যদিও একই সঙ্গে তিনি ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলছেন, যা ডলারের অবস্থানকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রার ইতিহাসে দেখা গেছে, কোনো মুদ্রার আধিপত্য কখনোই স্থায়ী নয়। যেমন দ্য ইকোনমিস্টের সম্পাদক ওয়াল্টার বাজেট উনিশ শতকে বলেছিলেন, ব্রিটেনের অর্থব্যবস্থা ছিল ‘অর্থনৈতিক শক্তি ও ভঙ্গুরতার এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ’। আজ সে কথা ডলারের ক্ষেত্রেও হুবহু প্রযোজ্য।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলার এখনো বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। তবে বাণিজ্য ও অর্থনীতি সমান গতিতে চলে না। বাণিজ্য নির্ভর করে উৎপাদনের ওপর। আর অর্থনীতি অনেকটাই প্ল্যাটফর্মভিত্তিক। ইতিহাসে যেমন জেনোয়া, অ্যান্টওয়ার্প বা আমস্টারডাম তাদের অবস্থান হারিয়েছে, তেমনি চাইলে বিশ্বের অন্য দেশগুলোও ডলারের বিকল্প তৈরি করতে পারে।

আরও পড়ুনট্রাম্পের এক লাখ ডলারের ট্যালেন্ট ট্যাক্স বনাম চীনের ফ্রি আমন্ত্রণ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চোখ খুললেই দেখা যায়, এখন এমন অনেক মুদ্রা আছে, যেগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের মতো ঋণ ও ঘাটতির বোঝা নেই।

ফেসবুকের লিবরা প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। এটি একটি ব্লকচেইনভিত্তিক মুদ্রা তৈরি করার উদ্যোগ, যা একাধিক মুদ্রার ঝুড়ির (বাস্কেট) সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এটি তৎক্ষণাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাধার মুখে পড়ে। তবে প্রযুক্তিগতভাবে এটি সম্পূর্ণ সম্ভব ছিল।

আগে ডলারের বিকল্প হিসেবে ইউরো বা রেনমিনবিকে (চীনা মুদ্রা) অবাস্তব মনে হলেও ব্লকচেইন প্রযুক্তি এখন এক বিশ্বমুদ্রার ধারণাকে বাস্তব করে তুলতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বাস করে, মার্কিন ডলারে সমর্থিত স্টেবলকয়েন তৈরি হলে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডের চাহিদা বাড়বে। আর এতে সহজেই বিশাল জাতীয় ঋণ পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু বিপদ হলো, আজ প্রায় সব স্টেবলকয়েনই ডলারনির্ভর।

আরও পড়ুনডলারের সিংহাসন কি কেঁপে উঠছে২৮ এপ্রিল ২০২৫

তবে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো বড় আর্থিক সংকট দেখা দিলে বা শুধু তার আভাস পেলেও নতুন ধরনের মুদ্রা আসতে পারে, যা হবে অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান ও হংকং ডলার; নরওয়েজিয়ান ও সুইডিশ ক্রোন এবং সুইস ফ্রাঙ্কসহ বিভিন্ন শক্তিশালী মুদ্রার মিশ্রণ। একজন উদ্ভাবনী ইস্যুকারী চাইলে এর সঙ্গে কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি যোগ করতে পারেন। পাশাপাশি তাঁকে অবশ্যই মজুত রাখতে হবে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সম্পদ—সোনা।

তবে ট্রাম্প একজন অধৈর্য নেতা। তিনি দ্রুত ফল চান এবং পরাজয় সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যতই মেধাবী ও সৃজনশীল হোক না কেন, ট্রাম্প এমন এক অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, যেখানে তাঁর জেতার সম্ভাবনা প্রায় নেই।

ডলারের বৈশ্বিক আধিপত্যের ওপর যে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি রয়েছে, শেষ পর্যন্ত সেটিই ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত করবে।

হ্যারল্ড জেমস প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র য় র আর থ অবস থ ন ম পর ক র অর থ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

লিও তলস্তয়ের গ্রামে

আমি এখন যে গ্রামে এসেছি, সেই গ্রামে ১৮২৮ সালে লেখক লিও তলস্তয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাশিয়ার ইয়াস্নায়া পলিয়ানা নাম গ্রামটির। এটি আসলে তাঁদের পারিবারিক জমিদারির একটি অংশ। এখানে তিনি জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। এখানেই লিখেছেন অমর উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’ এবং অসংখ্য গল্প।

তলস্তয়কে আইন পড়তে কাজান শহরে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু পড়তে তাঁর ভালো লাগেনি। জমিদারি ছিল, তাই রোজগারের চিন্তাও করতে হয়নি। মাঝখানে সন্তানদের পড়ালেখার জন্য আট বছর মস্কোতে একটি বাড়ি কিনে বসবাস করেছিলেন।

লিও তলস্তয় শেষ জীবনে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। একসময় গৃহত্যাগ করেছিলেন। ১৯১০ সালে ৮২ বছর বয়সে আস্তাপোভো রেলস্টেশনে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে একাকী, আত্মীয়, বন্ধু থেকে দূরে, নীরবে তিনি দেহত্যাগ করেন। এরপর তাঁকে ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় এনে সমাহিত করা হয়।

ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে আমি যখন পৌঁছালাম, তখন রোদ ঝলমল করছে। গত কয়েক দিন খুব বৃষ্টি পড়েছে মস্কো শহরে। মস্কো থেকে আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ২২০ কিলোমিটার। সরাসরি মস্কো থেকে তলস্তয়ের গ্রামে আসার কোনো ট্রেন বা বাস নেই। আমাকে ট্রেনে করে আসতে হয়েছে প্রথমে তুলা শহরে৷

ট্রেনে করে আসার পথে রাশিয়ার সবুজ গ্রামের যে রূপ আমি দেখেছি, তার তুলনা হয় না। পথের পাশে ফুটে আছে হলুদ বুনো ফুল আর হঠাৎ হঠাৎ করে একটা বা দুটো দোচালা বাড়ি। মাঝে পড়ে গেল একটা নদী, আবার এসে গেল ঘন সবুজ জঙ্গল। এমন অসামান্য প্রকৃতি যে দেশের আছে, সে দেশের প্রতি এমনিতেই মায়া জন্মে যায়।

রাশিয়ার ইয়াস্নায়া পলিয়ানা গ্রামে ১৮২৮ সালে লেখক লিও তলস্তয় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটি তাঁদের পারিবারিক জমিদারির একটি অংশ। এখানে তলস্তয় জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। এখানেই লিখেছেন অমর উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’।মাঝখানে ধূসর লম্বা পথ আর দুপাশে ঘন বনানী

সম্পর্কিত নিবন্ধ