মাদারীপুরে ‘অবৈধ’ কর্মকর্তাদের টেনেহিঁচড়ে বের করে দেওয়ার হুমকি জামায়াত নেতার
Published: 12th, October 2025 GMT
মাদারীপুরে ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখায় প্রবেশ করে ‘অবৈধ’ কর্মকর্তাদের টেনেহিঁচড়ে ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা। ওই হুমকি দেওয়ার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
হুমকি দেওয়া ওই নেতার নাম আবদুর রহিম। তিনি জামায়াতে ইসলামীর মাদারীপুর পৌর শাখার নায়েবে আমির। এ ছাড়া মাদারীপুর পুরান বাজারের ডিএম টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আবদুর রহিম তাঁর অনুসারীদের নিয়ে মাদারীপুর শহরের পুরান বাজার ইসলামী ব্যাংকের শাখায় প্রবেশ করেন। পরে তিনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের কক্ষে প্রবেশ করেন। পরে ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বক্তব্য দেন। এ সময় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘কাল থেকে যেন তারা (এস আলমের সময়কালে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা) ব্যাংকে না আসে। এস আলমের কোনো লোক এই ব্যাংকে থাকতে পারবে না। আজ সন্ধ্যার মধ্যে তাদের আর জানি এই ব্যাংকে আমরা আর দেখতে না পাই।’
ভিডিওর আরেকটি অংশে আবদুর রহিমকে বলতে দেখা যায়, ‘এখানে চাকরি করতে পারবে না, পারবে না, পারবে না। আজকে আপনাদের ম্যানেজারসহ বলে গেলাম, আগামী দিন আমরা আবার আসব। পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়ে যায়। আমরা টেনেহিঁচড়ে ব্যাংক থেকে বের করে দেব, ইনশা আল্লাহ! আগামীকাল কোনো প্রক্রিয়ায় যেন অবৈধ লোক এই ব্যাংকে প্রবেশ করতে না পারে। যদি সঠিক পন্থায় নিয়োগ হয়, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তাদের জবাব দিতে হবে। না হলে তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দিতে হবে। আমরা ঘোষণা দিয়ে গেলাম। আগামীকাল আবার খোঁজখবর নেব।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সকালে জামায়াতের ওই নেতা ইসলামী ব্যাংকে যান। শনিবার সন্ধ্যার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে জেলাজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়।
জানতে চাইলে জামায়াত নেতা আবদুর রহিম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলীয়ভাবে আমাদের ওই ব্যাংকে যাওয়ার কোনো নির্দেশনা ছিল না। আমরা বৃহস্পতিবার ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করেছি। পরে ব্যাংকের ম্যানেজার আমাদের ডাকলে তাঁর কক্ষে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা কথা বলেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, এস আলমের সময় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা যেন এই ব্যাংকে না থাকতে পারে। এটাই আমরা বলেছি। কোনো হুমকিধমকি দিইনি। বাকি কথা ব্যাংকের ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি উত্তর দেবে।’
ইসলামী ব্যাংক মাদারীপুর পুরান বাজার শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট মো.
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাদারীপুর ব্রাঞ্চ থেকে ১৬ জন ছাঁটাই হলেও আরও একজন কর্মকর্তাকে জামায়াতের লোকজন বাদ দিতে ম্যানেজারকে চাপ সৃষ্টি করেন। পরে জামায়াতের ওই নেতা প্রকাশ্যে হুমকি দিলে তিনি আর ব্যাংকে আসেননি। এখানে যাঁরা ছাঁটাই হয়েছেন, সবাই অনিয়ম করে আসেননি। অনেকে যোগ্যতা অনুসারে নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁরাও ছাঁটাই হয়েছেন।
এ সম্পর্কে মাদারীপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুর রহিম ইসলামী ব্যাংকে গিয়ে হুমকি দিয়েছেন, এমন কথা শুনিনি বা জানি না। ব্যাংকের ম্যানেজার তাঁকে ডাকছিল বলে শুনেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফেসবুকে আমরা তাঁর (আবদুর রহিমের) বক্তব্য শুনেছি। এটি নিয়ে আমরা আলাপ করে বিষয়টি দেখব।’
একদিকে ছাঁটাই, অন্যদিকে নিয়োগে তোড়জোড় ইসলামী ব্যাংকেরউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক কর মকর ত ট ই হয় ছ এই ব য আম দ র ব র কর ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
জাহান্নামের আগুন যাদের দিয়ে প্রথম জ্বালানো হবে
কিয়ামতের দিন সবাই দাঁড়িয়ে থাকবে আল্লাহর সামনে। হিসাব শুরু হবে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, সবার আগে যাদের ব্যাপারে ফয়সালা হবে, তাদের মধ্যে তিন শ্রেণির মানুষকে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি—প্রথমে আনা হবে একজন শহীদকে। আল্লাহ তাকে তাঁর নেয়ামতগুলো স্মরণ করিয়ে দেবেন। সে চিনতে পারবে। আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন, “এসব নেয়ামতে তুমি কী আমল করেছ?”
সে বলবে, “আপনার পথে জিহাদ করেছি, শহীদ হয়েছি।” আল্লাহ বলবেন, “মিথ্যা বলছ! তুমি লড়েছ যাতে লোকে বলে ‘কী সাহসী!’ আর তাই বলা হয়েছে।” তারপর নির্দেশ হবে, তাকে মুখের ওপর টেনে জাহান্নামে ছুড়ে ফেলা হবে।
দ্বিতীয়জন আসবে একজন আলেম, যে ইলম শিখেছে, শিখিয়েছে, কোরআন তিলাওয়াত করেছে। আল্লাহ নেয়ামতগুলো দেখাবেন। সে চিনবে। জিজ্ঞাসা হবে, “কী আমল করেছ?” সে বলবে, “ইলম শিখেছি, শিখিয়েছি, আপনার জন্য কোরআন পড়েছি।” আল্লাহ বলবেন, “মিথ্যা! তুমি শিখেছ যাতে লোকে বলে ‘আলেম’, কোরআন পড়েছ যাতে বলে ‘কারী’। আর তাই বলা হয়েছে।”
তারপর তাকেও মুখের ওপর টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আরও পড়ুনজান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের পথ২৫ জুলাই ২০২৫তৃতীয়জন আসবে একজন ধনী, যাকে আল্লাহ সব ধরনের সম্পদ দিয়েছিলেন। নেয়ামত দেখানো হবে। সে বলবে, “আপনার পছন্দের প্রতিটি পথে খরচ করেছি।” আল্লাহ বলবেন, “মিথ্যা! তুমি খরচ করেছ যাতে লোকে বলে ‘কী দানশীল!’ আর তাই বলা হয়েছে।” তারপর তাকেও একই পরিণতি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৬৮৮)
ইমাম নববী (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এটি রিয়া বা লোক দেখানোর গুনাহের ভয়াবহতা ও শাস্তির কঠোরতা প্রমাণ করে। সব আমলেই ইখলাস বাধ্যতামূলক। আল্লাহ বলেছেন, “তাদেরকে কেবল এই নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল যে তারা খাঁটি দিলে আল্লাহর ইবাদত করবে।” (সুরা বাইয়িনাহ, আয়াত: ৫)
জিহাদ, ইলম, দান—এসবের যত প্রশংসা এসেছে, তা কেবল তাদের জন্য যারা খাঁটি মনে আল্লাহর জন্য করেছে (নববী, শারহু সহিহ মুসলিম, ৫/৪৬, দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবী, বৈরুত, ১৩৯২ হি.)
প্রথম শ্রেণি: নামের জন্য জিহাদকারীযে জিহাদ করে কেবল নাম-যশের জন্য, গোত্রের গৌরবের জন্য, বা লুটের মালের লোভে—তার জিহাদ আল্লাহ কবুল করবেন না।
এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেউ লুটের জন্য লড়ে, কেউ নামের জন্য, কেউ দেখানোর জন্য—কে আল্লাহর পথে?” তিনি বললেন, “যে লড়ে যাতে আল্লাহর কালিমা সবচেয়ে উঁচু হয়, সে-ই আল্লাহর পথে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৮১০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৯০৮)
এই হাদিস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জিহাদের মর্যাদা কেবল নিয়তের ওপর নির্ভর করে। নাম-যশের জন্য রক্ত ঝরালেও তা বাতিল।
দ্বিতীয় শ্রেণি: নামের জন্য ইলম ও কোরআনের হাফেযদ্বিতীয় শ্রেণিটি আমাদের সময়ের জন্য বিশেষ সতর্কবার্তা। যারা ইলমের পোশাক পরে, উঁচু পদে বসে, ফতোয়া দেয়, কোরআন পড়ে—কিন্তু নিজের জীবনে আমল করে না।
আজকাল এমন মানুষের সংখ্যা দুঃখজনকভাবে বেড়েছে। অনেকে দ্বীনের নামে বড় বড় পদে আসীন, কিন্তু তাদের কথা ও কাজের মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক। তারা ইসলামের দুশমনদের সঙ্গে হাত মেলায়, শরীয়তের সঙ্গে খেলা করে, আলেমদের গালি দেয়।
রাসুল (সা.) বলেছেন, “কোরআন তোমার পক্ষে সুপারিশ করবে, না হয় বিপক্ষে দলিল হবে। প্রত্যেক মানুষ সকালে উঠে নিজেকে বিক্রি করে—হয় মুক্তি পায়, নয় ধ্বংস করে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪২৩)
আরও পড়ুনজান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের পথ২৫ জুলাই ২০২৫নাওয়াস ইবন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত, কিয়ামতে কোরআন ও তার আমলকারীদের আনা হবে। সুরা বাকারা ও আলে ইমরান তাদের পক্ষে তর্ক করবে (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৪০)
মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন, যে কেবল পড়ে কিন্তু আমল করে না, সে কোরআনের আহল নয়। কোরআন তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে (মোল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতিহ শারহু মিশকাতিল মাসাবিহ, ৪/৬২৭, দারুল ফিকর, বৈরুত, ২০০২)
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেছেন, “কোরআন হেফজ করা মানে তার হরফ হেফজ করা নয়, তার হুদুদ কায়েম করা।” (তাযকিরাতু আফদালিল আযকার, পৃ. ৬৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ২০০৫)
হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন, “কেউ বলে, ‘আমি পুরো কোরআন পড়েছি, একটা হরফও ফেলিনি।’ অথচ তার চরিত্রে, আমলে কোরআনের ছাপ নেই। এরা আসলে কোরআনকে পুরোপুরি হারিয়েছে।” (ইবনুল মুবারক, কিতাবুয যুহদ, পৃ. ২৭৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৭)।
ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, “কোরআন যার পক্ষে সে আমল করে, যার বিপক্ষে সে আমল করে না।” (তাযকিরাতু আফদালিল আযকার, পৃ. ৮৭, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ২০০৫)
আলী (রা.) বলেছেন, “হে ইলমের বাহক! আমল করো। আসল আলেম সেই যার ইলম ও আমল মিলে যায়।” (সুনানু দারিমী, ১/৭৩, দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবী, বৈরুত, ১৪০৭ হি.)
রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, “আল্লাহর সম্মান করা মানে বয়স্ক মুসলিমকে সম্মান করা, কোরআনের হাফেযকে সম্মান করা—যে তার মধ্যে অতিরঞ্জন করে না, দূরে সরে যায় না।” (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৪৫)
মোল্লা আলী কারী এর ব্যাখ্যায় বলেন, অতিরঞ্জন মানে রিয়া, বাড়াবাড়ি তাজবীদ; দূরে সরে যাওয়া মানে আমল না করা, ভুলে যাওয়া। দুটোই নিন্দনীয়। (মিরকাতুল মাফাতিহ, ৮/৭০৬-৭০৭, দারুল ফিকর, বৈরুত, ২০০২)
তৃতীয় শ্রেণি: নামের জন্য দানকারীযারা দান করে কেবল নাম-যশের জন্য, তাদের দানও বাতিল। আলেমরা বলেন, আল্লাহর পথে দান গোপন রাখাই উত্তম। রাসূল (সা.) বলেছেন, সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ নিজের আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন—তাদের মধ্যে একজন সে, যে এমন গোপনে দান করে যে, তার বাঁ হাতও জানে না ডান হাত কী খরচ করেছে (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৬০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৪৭২)
শেষ কথা: ইখলাসই সবকিছুএই হাদিস আমাদের হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে দেয় যে, সবচেয়ে বড় জিহাদ, সবচেয়ে উঁচু ইলম, সবচেয়ে বেশি দান—কোনোটাই কাজে আসবে না যদি নিয়ত খাঁটি না হয়। আমল কবুলের চাবিকাঠি ইখলাস। আজ আমরা যারা ইলমের দাবি করি, কোরআন পড়ি, দান করি—নিজেদের প্রশ্ন করি: আমি কার জন্য করছি? লোকের মুখে প্রশংসা শোনার জন্য, না আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য?
যারা ইলম ও কোরআনের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদের ওপর দায়িত্ব আরও বেশি। তারা যদি আমল না করেন, তবে কোরআন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। আসুন, আমরা নিজেদের সংশোধন করি। ছোট আমল হলেও খাঁটি নিয়তে করি। কিয়ামতের সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য যেন আমাদের জন্য না হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইখলাস দান করুন এবং জাহান্নাম থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
আরও পড়ুনউত্তম ব্যবহার হৃদয়ের জান্নাত১৮ এপ্রিল ২০২৫