পাল্টা শুল্ক আরোপের পর মার্কিন ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরাচ্ছে। তাদের অনেকেই বাংলাদেশের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জুতার ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনা করছে। এর ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে নতুন ক্রয়াদেশ পেয়েছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ পাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

অবশ্য মার্কিন বড় ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়া আমাদের জন্য কিছু কঠিন। কারণ, আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। আমরা সবচেয়ে বেশি ভুগছি বন্ড জটিলতায়। ধরুন, আমার প্রতিষ্ঠান দেড় লাখ জোড়া জুতার ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এই জুতার পুরো কাঁচামাল আমদানির প্রাপ্যতার অনুমতি দেয় না বন্ড কর্তৃপক্ষ। আমাদের ভাগ ভাগ করে কাঁচামাল আনতে হয়। তাতে সময়সমতো পণ্য জাহাজীকরণ আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই আমাদের জুতা রপ্তানি বছরের পর বছর ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের আশপাশেই ঘুরছে। অথচ দেশে রপ্তানিমুখী ১০০-এর বেশি কারখানায় যে যন্ত্রপাতি স্থাপন করা আছে, তাতে বছরে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি করা সম্ভব। অর্থাৎ, এখনই বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের জুতা রপ্তানির সক্ষমতা দেশের কারখানাগুলোর আছে।

বন্ড জটিলতা নিরসনে মূল্য সংযোজনের শর্ত দিয়ে কাঁচামাল আমদানির অনুমতি দেওয়া উচিত। যেমন ১০০ ডলারের কাঁচামাল আনলে ১২৫ ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেটি না করলে আমদানি করা কাঁচামালের ওপর শুল্ক আরোপ হবে, এমন ব্যবস্থা করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চীন, কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ কাঁচামাল আমদানিতে মূল্য সংযোজন ব্যবস্থা চালু করে উন্নতি করেছে।

আমাদের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, সাভারের চামড়াশিল্প নগরের দূষণ। এ কারণে আমাদের চামড়া বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলো কিনছে না। চামড়াশিল্প নগরের ব্যবস্থাপনা বিসিকের কাছ থেকে নিয়ে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সেটি হলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অটোমেশন হলেও জুতাশিল্প বরাবরই শ্রমনিবিড়। সে কারণে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় একটা জায়গায় এগিয়ে রয়েছে। শ্রমিকের কম মজুরির জন্য বাংলাদেশ যে দামে জুতা দিতে পারে, তা অন্য দেশ পারে না। সে জন্য মার্কিন পাল্টা শুল্কের কারণে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটি কাজে লাগাতে আমাদের দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

মো.

নাসির খান, সহসভাপতি, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ আম দ র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ক্লাউডে বিপর্যয় এবং সিঁদুরে মেঘের ভয়

গত কয়েক বছরে বিশ্বজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তির অন্যতম বড় রূপান্তর এসেছে ক্লাউডকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তিগত ছবি, ব্যাংকিং, অফিসের কাজ, স্মার্ট যন্ত্র—সবই এখন ক্লাউডের ওপর দাঁড়িয়ে। এতটাই দাঁড়িয়ে যে অনেকে মনে করেন, ক্লাউড মানেই যেন অবিচ্ছেদ্য নির্ভরযোগ্যতা। কিন্তু সত্যটা ভিন্ন। সাম্প্রতিক তিনটি ইন্টারনেট বিপর্যয় বা আউটেজ যা হয়েছিল, ক্লাউড ফ্লেয়ার, মাইক্রোসফট অ্যাজুর এবং অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস (এডব্লিউএস) প্রমাণ করেছে, ক্লাউড যত সুবিধার, ততটাই ভঙ্গুর। কয়েকটি ভুল কনফিগারেশন বা একটি নোড ব্যর্থ হওয়ার পরিণতি বিশ্বব্যাপী অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে।

ক্লাউড ফ্লেয়ার: একটি ভুল ফাইল, অচল হয়ে যাওয়া আধা ইন্টারনেট

১৮ নভেম্বর ক্লাউড ফ্লেয়ারের নেটওয়ার্কে একধরনের ‘ফিচার ফাইল’ ভুলভাবে তৈরি হয়, যার আকার ছিল আগের চেয়ে দ্বিগুণ। এটি ঘটে ভুল পারমিশন কনফিগারেশনের কারণে। বট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম—এই ফাইল লোড করতে না পারার কারণে মূল ট্রাফিক রাউটিংয়ে, অর্থাৎ ইন্টারনেট থেকে আসা বিভিন্ন অনুরোধগুলো ঠিক জায়গামতো পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার), চ্যাটজিপিটি থেকে শুরু করে অসংখ্য ওয়েবসাইটে ত্রুটি দেখা দেয়।
সিস্টেমের কনফিগারেশনের কারণে রেকর্ড ফাইলটি বারবার রিফ্রেশ হচ্ছিল, ফলে নেটওয়ার্ক কখনো ভেঙে পড়ছিল আবার কখনো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরুদ্ধারও হচ্ছিল। যার ফলাফল—পুরো ডিএনএস ও ওয়েব ফিল্টার সিস্টেম হয়ে পড়ে অকার্যকর। এই ওঠানামা প্রকৌশলীদের কিছুটা দিক্‌ভ্রান্ত করে; যার ফলে প্রথমে মনে হয়েছিল ডিডস আক্রমণ চলছে। পরে দেখা গেল, এটি নিছকই একটি অভ্যন্তরীণ ভুল! (সূত্র: ক্লাউডফ্লেয়ারের ব্লগ)

মাইক্রোসফট অ্যাজুর সিডিএন আউটেজ ২০২৫: রাউটিং সিদ্ধান্তে ভুল

গত ২৯ অক্টোবর মাইক্রোসফট অ্যাজুরের ফ্রন্ট ডোর সেবায় একটি ভুল কনফিগারেশন ছড়িয়ে পড়ে। প্রিমিয়াম নোডগুলো ভুলভাবে সংকেত পায় যে সব ব্যাকএন্ড নাকি অকার্যকর। এ ক্ষেত্রেও ট্রাফিক রাউটিং থেমে যায়। মাইক্রোসফট টিমস, আউটলুক, এক্স-বক্স তো আছেই; নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্ট, আলাস্কা এয়ারলাইনসের চেক ইনসহ বিভিন্ন দেশের সরকারি পোর্টাল অচল হয়ে যায়।
এ ঘটনা প্রমাণ করে, ইন্টারনেট ট্রাফিকের রাউটিং ভুল হওয়ার ফলে একটি দেশ নয়, বিশ্বব্যাপী জরুরি সেবা আটকে যেতে পারে। খেয়াল করতে হবে, এ ক্ষেত্রে সমস্যা ডিএনএসে ছিল না, নেটওয়ার্কেও নয়; সমস্যাটি ছিল অ্যাপ্লিকেশন সরবরাহ স্তরের (ডেলিভারি লেয়ার) একটি ভুল লজিক, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ডে পুরো সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়ে। ডিএনএসের সমস্যার কথা বলা হলো। কারণ, এ ঘটনার কয়েক দিন আগেই এডব্লিউএসের আউটেজ থেকে দেখেছি আমরা, কীভাবে ডিএনএসের কারণে ধসে পড়ে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাগুলো। (সূত্র: মিডিয়াম ডটকম)

আরও পড়ুনক্লাউডফ্লেয়ারের নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ে এক্স, চ্যাটজিপিটিসহ সারা বিশ্বের ইন্টারনেটের সেবায় বিঘ্ন১৮ নভেম্বর ২০২৫এডব্লিউএস ২০২৫: ডিএনএস রেকর্ড থেকে অচলাবস্থা

গত ২০ অক্টোবর এডব্লিউএসে দেখা দেওয়া আউটেজের মূল কারণ ছিল ডায়নামো ডেটাবেজের একটি ডিএনএস রেকর্ড ভুলভাবে মুছে যায়; মূলত ল্যাটেন্ট রেস কন্ডিশনের অস্থিতিশীলতার কারণে একাধিক ডিএনএস প্ল্যানারগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যতা থাকেনি। ডায়নামো ডেটাবেজে যেহেতু এডব্লিউএসের প্রধান ইঞ্জিনগুলোর একটি, তাই এর ব্যর্থতা পর্যায়ক্রমিক প্রভাব তৈরি করে। রোবলক্স, ক্যানাভা, সিগন্যালসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং অ্যাপ, স্মার্ট যন্ত্র—সবই বন্ধ হয়ে যায়।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমস্যাটি সাইবার আক্রমণ ছিল না; বরং ল্যাটেন্ট রেস কন্ডিশনের ভুলের কারণে ডিএনএস অটোমেশন ভুল কাজ করেছে। অর্থাৎ অটোমেশন যত উন্নত, তত আশঙ্কা থাকে কোনো ভুল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার। (সূত্র: থাউজেন্ডআইস ডটকম)

ক্লাউড নির্ভরতার ঝুঁকি: প্রযুক্তি যত বাড়ছে, ভঙ্গুরতা তত বাড়ছে

ক্লাউড ফ্লেয়ার, মাইক্রোসফট অ্যাজুর ও এডব্লিউএস—এই তিন কোম্পানি আধুনিক ইন্টারনেটের অন্যতম প্রধান সেবাপ্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানের জন্য করণীয়: ক্লাউড আছে, ব্যাকআপ পরিকল্পনাও থাকতে হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ক্লাউড বেছে নেয় খরচ, স্কেলিং ও দ্রুত ডিপ্লয়মেন্টের সুবিধায়। কিন্তু এই তিনটি ঘটনা শেখায়—এক ক্লাউড বা একক সিডিএন–নির্ভরতা বিপজ্জনক।

প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজন: মাল্টিরিজিওন ক্লাউডে বা মাল্টিপল ক্লাউড সেবাদাতার মাধ্যমে বাণিজ্যক ও হাই ডিপেন্ডেন্সি সার্ভিস নেওয়া। এ ক্ষেত্রে ক্লাউড নেটিভ সার্ভিস নকশা করার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হতে হবে।

ক্লাউড দরকার, কিন্তু ক্লাউড সচেতনতা আরও বেশি দরকার

সাম্প্রতিক আউটেজগুলো দেখিয়েছে, ভবিষ্যতের ইন্টারনেট আরও যত ক্লাউড-নির্ভর হবে, ততই হয়ে উঠবে স্পর্শকাতর। ভুল হতে পারে, প্রযুক্তি ব্যর্থ হতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রস্তুতি না থাকলে ছোট একটি ভুল বৈশ্বিক বিপর্যয় আনতে পারে।
ক্লাউড আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু ভরসা করার আগে বুঝতে হবে—ক্লাউড কোনো জাদু নয়; এটি মানুষ বানানো সিস্টেম এবং সেই সিস্টেমের ভুল আমাদের সবার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখন সময়, অন্ধ আস্থা নয়, সচেতন ব্যবহারের।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও বাংলাদেশ সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

সম্পর্কিত নিবন্ধ