‘অনুপম চরিত্রের’ কুদরুত–ই–ইলাহীকে যমুনা অয়েলে এমডি পদে রেখে দিতে বিপিসিতে চিঠি
Published: 23rd, November 2025 GMT
তেল চুরি, অপচয় ও পাইপলাইন থেকে আসা তেল গায়েব, ট্যাংকলরির সক্ষমতা জালিয়াতিসহ নানা ঘটনায় এক বছর ধরে বিতর্কের মধ্যে আছে যমুনা অয়েল কোম্পানি। এসব ঘটনায় গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি কাজ করছে। একাধিক অভিযানও চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), চলছে তদন্ত। এর মধ্যেই বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) একই দায়িত্বে রাখতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই তেল কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, তিনি ‘অনুপম চরিত্রের অধিকারী’।
যমুনা অয়েলের বর্তমান এমডি মুস্তফা কুদরুত–ই–ইলাহীর চাকরি শেষে ৩০ নভেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁকে আরও এক বছর এই পদে রেখে দিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুপারিশ করে চিঠি পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি)।
দেশে জ্বালানি তেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা হলো বিপিসি। এর অধীনে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নামের তিনটি তেল কোম্পানি পরিবেশকদের মাধ্যমে বাজারে তেল বিক্রি করে। যমুনা তেল কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যান মো.
এমডি পদে কুদরুত–ই–ইলাহীকে রেখে দিতে যমুনা অয়েল কোম্পানির বোর্ড থেকে চিঠি পেয়েছেন জানিয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এটা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
কুদরুত–ই–ইলাহীকে রেখে দিতে বিপিসিতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, তাঁর দায়িত্বকালে কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জন রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় যমুনার বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণে তিনি বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন।জ্বালানি খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে বিভিন্ন কোম্পানিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের হিড়িক ছিল। কেউ কেউ একই পদে ১০ থেকে ১৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ দায়িত্বে চুক্তিভিত্তিক কোনো নিয়োগ হয়নি।
আরও পড়ুনসরকারি তেলের ডিপো থেকে পৌনে ৪ লাখ লিটার ডিজেল গায়েব০১ অক্টোবর ২০২৫বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, চুক্তিভিত্তিক কোনো নিয়োগ বিবেচনা করা হবে না। কারণ, সরকারি সংস্থায় প্রয়োজন অনুসারে যোগ্য কর্মকর্তা আছেন।
বিপিসিতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ১২ নভেম্বর যমুনা তেল কোম্পানির ৫৪০তম বোর্ড সভায় মুস্তফা কুদরুত–ই–ইলাহীর অবসর নিয়ে আলোচনা হয়। অবসরের পরও মেয়াদ বাড়ানোর কারণের মধ্যে তাঁকে ‘অনুপম চরিত্রের অধিকারী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
চুক্তিভিত্তিক কোনো নিয়োগ বিবেচনা করা হবে না। কারণ, সরকারি সংস্থায় প্রয়োজন অনুসারে যোগ্য কর্মকর্তা আছেন।মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টাচিঠিতে আরও দাবি করা হয়, তাঁর দায়িত্বকালে কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় যমুনার বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণে তিনি বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। তাই তাঁর চাকরি আরও এক বছর বাড়াতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বোর্ড সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আরও পড়ুনজ্বালানি তেল ‘চুরি’ করতে যমুনা অয়েলে অভিনব জালিয়াতি৩১ আগস্ট ২০২৫তবে যমুনা অয়েলের কর্মকর্তারা বলছেন, এমডির মেয়াদ বাড়াতে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি সত্য নয়। গত এক বছরে যমুনা তেল কোম্পানির ভাবমূর্তি বারবার নষ্ট হয়েছে। পাইপলাইন থেকে তেল গায়েবের ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা হয়েছে। এক বছরে যমুনার তেল অপচয় ও চুরি বেড়েছে। এ নিয়ে একাধিক তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ট্যাংকলরির সক্ষমতা জালিয়াতি করে ধরা পড়ার পর একটি লরির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। যমুনার ফতুল্লা ডিপোয় দুই ট্যাংকের সক্ষমতা জালিয়াতি করে ধরা পড়েছে। যমুনা তেল কোম্পানির তদন্তেও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপর নতুন করে সক্ষমতা যাচাই করা হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে কুদরুত–ই–ইলাহী এমডির দায়িত্ব নেওয়ার পর কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির বিষয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, তা বেড়েছে মূলত ব্যাংকে জমানো স্থায়ী আমানতের সুদ থেকে। এখানে বর্তমান এমডির দক্ষতার কোনো বিষয় নেই।
যমুনা অয়েলের কর্মকর্তারা বলছেন, এমডির মেয়াদ বাড়াতে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি সত্য নয়। গত এক বছরে যমুনা তেল কোম্পানির ভাবমূর্তি বারবার নষ্ট হয়েছে। কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে মূলত ব্যাংকে জমানো স্থায়ী আমানতের সুদ থেকে। আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে যোগ্য কর্মকর্তারা বঞ্চিত হন।চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আপত্তি জানিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, এতে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা বঞ্চিত হন। রাজনৈতিক বিবেচনায় গত সরকারের সময় এমন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হতো। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সরকারের কাছে এমন রাজনৈতিক নিয়োগের প্রত্যাশা কেউ করে না।
যমুনার তেল চুরিসহ বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত থাকা একটি চক্র বর্তমান এমডির মেয়াদ বাড়াতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে বলেও কর্মকর্তাদের অভিযোগ।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, যারা দুর্নীতি ও অনিয়মে পারদর্শী, তারা নানা ধরনের লবিং রক্ষা করে। নিজস্ব সমর্থক তৈরি করে সরকারের আনুকূল্য ধরে রাখে। গত সরকারের সময় এ সংস্কৃতি ব্যাপক দেখা গেছে। এখন যমুনার এমডির ঘটনাটি নতুন করে দেখাচ্ছে, সরকার বদলের পরও সংস্কৃতি পুরোপুরি বদলায়নি।
আরও পড়ুনডিপো থেকে তেল চুরির ঘটনা তদন্ত করছে জ্বালানি বিভাগ০৭ অক্টোবর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য গ য কর মকর ত কর মকর ত র সরক র র এক বছর ক বছর বলছ ন তদন ত এমড র
এছাড়াও পড়ুন:
মানিকগঞ্জে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভক্তদের ওপর হামলা, আহত ৪
মানিকগঞ্জে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার বাউলশিল্পী আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে তিন ভক্ত-অনুরাগীসহ মোট চারজন আহত হয়েছেন।
‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে থাকা একদল ব্যক্তি এবং আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে এ ঘটনা ঘটে। আজ রোববার বেলা পৌনে ১১টার দিকে জেলা শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকায় ঘটনাটি ঘটে।
আহত ভক্তরা হলেন জেলার শিবালয়ের শাকরাইল গ্রামের আবদুল আলীম (২৫), সিঙ্গাইরের তালেবপুর গ্রামের আরিফুল ইসলাম (২৯) ও হরিরামপুরের কামারঘোনা গ্রামের জহিরুল ইসলাম (৩২)। আহত অন্যজন হলেন সদর উপজেলার বরঙ্গাখোলা গ্রামের আবদুল আলীম (২৭)।
পুলিশ, আহত ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, আজ সকালে জেলা শহরে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে থাকা একদল ব্যক্তি। একই সময়ে আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করেন তাঁর ভক্তরা।
সকাল ১০টার দিকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে একদল ব্যক্তি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তাঁরা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলার প্রধান ডাকঘর কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেন।
অন্যদিকে মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা। কিন্তু অন্য পক্ষের মিছিলের কারণে তাঁরা প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে কর্মসূচি পালন না করে দক্ষিণ সেওতা এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দক্ষিণ পাশে জড়ো হন।
অন্য পক্ষের সমাবেশস্থল থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ গজ দূরে শহীদ মিনারের অবস্থান। সেখানে আবুল সরকারের ভক্ত-অনুসারীদের অবস্থানকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বেলা পৌনে ১১টার দিকে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে থাকা ব্যক্তিদের হামলায় আবুল সরকারের তিন ভক্ত-অনুরাগী আহত হন।
পাশাপাশি আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীদের হামলায় আবদুল আলীম আহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে আহত ব্যক্তিদের জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সুজিত চন্দ্র রায় বলেন, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। তাঁদের মাথার একাধিক স্থানে সেলাই দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত আবদুল আলীম বলেন, লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করা হয়। ইট দিয়ে তাঁদের মাথায় আঘাত করা হয়েছে।
বাউলশিল্পীর সহকারী বাউলশিল্পী রাজু সরকার বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, হানাহানি নয়। আমরা আবুল সরকারের মুক্তি চাই।’
মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাউলশিল্পী আবুল সরকারের শাস্তির দাবিতে তৌহিদী জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। অন্যদিকে আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীরা তাঁর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেন। পরে তৌহিদী জনতার একটি অংশ আবুল সরকারের সমর্থকদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে তিন-চারজন আহত হন। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরিস্থিতি এখন শান্ত ও স্বাভাবিক আছে।
৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় খালা পাগলির মেলায় পালাগানের আসরে বাউলশিল্পী আবুল সরকার ধর্ম অবমাননা করে মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ। তাঁর মন্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ নভেম্বর রাতে মাদারীপুরে একটি গানের আসর থেকে আবুল সরকারকে আটক করে মানিকগঞ্জ পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরের দিন সকালে তাঁকে জেলা ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। ওই দিন দুপুরে মুফতি মো. আবদুল্লাহ বাদী হয়ে আবুল সরকারকে আসামি করে ঘিওর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।