জামায়াতের আমিরকে রিজভীর প্রশ্ন ‘জেনোসাইড হবে কেন?’
Published: 23rd, November 2025 GMT
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের কাছে প্রশ্ন রেখে জানতে চেয়েছেন, ‘‘জামায়াতের আমির বলেছে নির্বাচন এবং গণভোট একসাথে হলে নাকি জেনোসাইড হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি এটা বলে কি গোটা জাতিকে হুমকি দিলেন? জেনোসাইড হবে কেন?’’
রবিবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে হিউম্যান রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজনে ‘‘গণতন্ত্রে উত্তরণে করণীয়’’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
‘তারেক রহমান মানবতার দূত হিসেবে কাজ করছেন’
ইসির সামনে অনশনরত তারেকের পাশে রিজভী
এ সময় তিনি বলেন, ‘‘জেনোসাইড শেখ হাসিনা করার চেষ্টা করেছে। ৭১ সালে হানাদার বাহিনী জেনোসাইড করেছে। আপনি জেনোসাইডের হুমকি দিচ্ছেন, এটা তো জনগণ ভালোভাবে নেবে না। আপনি খুব বিপজ্জনক কথা বলেছেন। আমরা জেনোসাইড বন্ধ করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, বিপুল মানুষ নিজের জীবন দিয়ে একটা রক্তপিপাসু সরকারকে সরিয়েছে। আপনি এই আশঙ্কা করলেন কেন? আপনি তো একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। আপনি প্রচুর গণহত্যার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। আতঙ্ক তৈরি করছেন।’’
এ বিষয়ে জাতিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব।
রিজভী বলেন, ‘‘আপনারা চাচ্ছেন গণভোট যাতে আগে হয়। বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল বলেছে আগে যদি গণভোট করা হয় তাহলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। গণভোট এবং নির্বাচন একদিনে করলে ভালো হবে। এই ডিবেটটা চলছে। গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে ডিবেট এবং ডিসকাশন। কিন্তু আপনি সেখানে জেনোসাইডের ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন! আপনি একটি রক্তগঙ্গা বইবার ইঙ্গিত দিচ্ছেন! এটা তো ভয়াবহ ব্যাপার!’’
জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতার বক্তব্যকে ইঙ্গিত করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘‘আজকে একটি রাজনৈতিক দলের একজন বললেন যে, তাদের কথায় প্রশাসন উঠবে এবং বসবে। এটা গণতন্ত্রের কোনো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নেই। এই কথার মাধ্যমে আপনি তো আরেকটা দানবীয় শাসন তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছেন। আরেকটা শেখ হাসিনা এবং আরেকটা ফ্যাসিবাদ তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত দিলেন। শেখ হাসিনা পুলিশকে বানিয়েছে ছাত্রলীগ, র্যাবকে বানিয়েছে যুবলীগ এবং তারা গুম-খুন করে আনন্দিত হতো। যারা ক্যাডারভিত্তিক দল করে, তারা প্রশাসন-বিচার বিভাগ প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ক্যাডার বসানোর চেষ্টা করে। এটাই হয় গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। স্বাধীনতার পর থেকে গণতন্ত্রের যে ধারাবাহিকতা ছিল, সেটা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এখন আমাদের সেটা করতে হবে। এখন যদি কোনো ত্রুটি বিচ্যুত হয়, তাহলে এই দেশ এবং আমরা এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়বো যে আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব সংকটের মুখে পড়বে।’’
‘‘দেশ কীভাবে চলবে, সেই শাসন নিশ্চিত করবে জনগণ। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণই ঠিক করবে তাদের প্রতিনিধি কে হবে। সেই নির্বাচনটা হতে হবে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন। এটা না হলে গণতন্ত্র কখনোই শক্তিশালী হবে না,’’ বলেন তিনি।
সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাড.
ঢাকা/রায়হান//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এনপ গণতন ত র ব এনপ র গণভ ট
এছাড়াও পড়ুন:
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে
বাংলাদেশের সাংবিধানিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে গত বৃহস্পতিবার দেওয়া রায়টি নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করে আনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ১৪ বছর আগে যে রায়ের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছিল, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেই রায়কে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেছেন—নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধানাবলি পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো।
এ সিদ্ধান্ত কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়ার সমাপ্তি নয়, এটি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল। কারণ, গত এক যুগে তিনটি জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যে প্রশ্ন, বিতর্ক, বৈধতার সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলোপ।
২০১১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেন। পরবর্তীকালে সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবারের রায়ে আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সেই রায় ছিল ‘ত্রুটিপূর্ণ, কলুষিত ও অসাংবিধানিক’। এ রায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এখনই কার্যকর হবে না; বরং সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর ভবিষ্যতে তা প্রয়োগযোগ্য হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বহু টানাপোড়েনে ভরা। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনই অনুষ্ঠিত হয় এবং সে নির্বাচনগুলো তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। ধারণাটির জন্মই হয়েছিল ১৯৯১ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে, যখন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কোনো দলীয় উদ্ভাবন নয়; বরং রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য জাতীয় ঐকমত্য থেকে জন্ম নেওয়া একটি বিশেষ ব্যবস্থা।
২০১১ সালের পর থেকে এই ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন দাবি করে নাগরিক সমাজ, নানা সংগঠন ও রাজনৈতিক দল আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। এ রায়কে তাই কেউ কেউ গণতন্ত্রের জন্য ‘ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায়ের মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্বাসনে গিয়েছিল। ফলে ভোটারবিহীন, একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচন এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সংসদ তৈরি হয়েছিল।
সর্বোচ্চ আদালত গণতন্ত্রের স্বার্থে যে অবস্থান নিতে পারেন, এই রায় তার এক শক্তিশালী উদাহরণ। আমরা মনে করি, দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ককে আইনি ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ তৈরি করেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে আসায় নির্বাচন নিয়ে নতুন করে আস্থা সৃষ্টির পথ খুলছে। অতীতের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীন নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
এ রায় জনগণের আস্থাহীনতার সংকট কাটিয়ে গণতন্ত্রে নতুন ধারা ফিরিয়ে আনতে পারে—যদি রাজনৈতিক দলগুলো প্রজ্ঞা, উদারতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটি একটি পরোক্ষ সতর্কবার্তা—গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হবে না। এ ব্যবস্থার অতীতেও কিছু বিতর্ক ছিল। কিন্তু বিতর্ক সত্ত্বেও এটি ছিল একমাত্র প্রক্রিয়া, যা দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রক্রিয়াকে গ্রহণ করে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনবে কি না, এখন সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আমাদের প্রত্যাশা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনরুজ্জীবন গণতন্ত্রের জন্য যে সুযোগ তৈরি করেছে, রাজনৈতিক দলগুলো সেটি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজে লাগাবে।