সংবিধানের মূলনীতি নয়, অগ্রাধিকার হোক গণতান্ত্রিক উত্তরণ
Published: 16th, January 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেই দুটি কথা বলেছিল– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং অগণতান্ত্রিক যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার যতদূর সম্ভব অবসান। এ লক্ষ্যে একাধিক সংস্কার কমিশন গঠিত হয় এবং তাদের ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমার কথা বলা হয়। বুধবার যে চারটি কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, এর অন্যতম সংবিধান সংস্কার কমিশন। তারা যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলো নিয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বিশেষত যেভাবে সংবিধানের মূলনীতিসহ মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলেছে, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে, যা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। কারণ ইংরেজি নামে পরিবর্তন না হলে বাংলা নামে পরিবর্তন হবে কীভাবে? ইংরেজি অক্ষুণ্ন থাকলে বাংলাও সেভাবে থাকবে। এটাও তাদের অপ্রয়োজনীয় জটিলতাবর্ধক পরিবর্তনের প্রস্তাব। যদিও সংবিধান সংস্কার কমিশনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি– কেন এই পরিবর্তন দরকার। যদি বৈষম্য নিরসন ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা রোধে সংবিধান পুনর্লিখন বা মৌলিক পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে তবে বলা দরকার, আমাদের বর্তমান সংবিধানে বৈষম্য নিরসনে যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। এটি যেমন মূলনীতিতেও রয়েছে, যেমন সমাজতন্ত্র; তেমনি ঘোষণাপত্রে সাম্য এ বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে। মৌলিক মানবাধিকার প্রশ্নে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মধ্যে আছে। এমনকি কার্ল মার্ক্সের বক্তব্য অনুসারে, সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ এবং কাজের যোগ্যতা ও পরিমাণ অনুযায়ী প্রাপ্তির কথাও বলা হয়েছে। সুতরাং, বৈষম্য নিরসনে বাহাত্তরের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
হ্যাঁ, গণতন্ত্র প্রসঙ্গে কিছু সংস্কার আসতে পারে। তাতেও সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। কিছু সামান্য বিধিবিধান, শব্দ পরিবর্তন করলেই হয়ে যাবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে; তা গ্রহণ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে সংস্কার প্রস্তাব স্বাগত। তা ছাড়া নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধান থাকতে পারে। অর্থাৎ সরকারি দল ও বিরোধী দল ব্যবসায়ীদের দ্বারা করায়ত্ত হয়ে যেভাবে অনুপযুক্ত প্রার্থীকে ভোটে দাঁড় করিয়ে দেয়, তা রোধে ‘না’ ভোটের বিধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের মেয়াদ চার বছর হলে কেউ ‘মৌরসি পাট্টা’ গড়ে তুলতে পারবে না। সে জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের ৪ বছরের প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য। সাংবিধানিক পদগুলো তথা নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদেও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য সংস্কার দরকার। কিন্তু কোনোটাই বলছে না– এর জন্য সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে– এ সরকার বিপ্লবী সরকার নয়। যে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ সরকার, তা সংবিধান পরিবর্তনের আন্দোলন ছিল না। সে আন্দোলনে কিছু আকাঙ্ক্ষা ছিল। বৈষম্য নিরসন ও গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা, তার পরোক্ষ সূত্রে সংবিধানে পরিবর্তন যে আনা যাবে না– এমনটি নয়। তবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ও মৌলিক নীতি, যার মধ্যে এরূপ আকাঙ্ক্ষার সংঘাত নেই, সেগুলো অপরিবর্তিত রেখে অন্যখানে ছোটখাটো পরিবর্তন আনা যেতে পারে। তবে তাকে পুনর্লিখন বলা যাবে না। কিন্তু সেই ধরনের প্রস্তাবও সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে এসেছে।
সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা আবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। যেমন অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে অধ্যাদেশ করে আইন করতে পারে। অথবা ফেব্রুয়ারিতে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে আলোচনা করবে, সেখানে সব দলের ঐকমত্য হলেও পরিবর্তন হতে পারে, যাতে পরিবর্তিত নির্বাচিত সরকার এসে তার অনুমোদন দেয়। ইতোমধ্যে সেগুলো বলেছি। যেমন ‘না’ ভোট, ন্যায়পাল, সরকারের মেয়াদ ইত্যাদি। কিন্তু যেগুলো মৌলিক, যেমন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বা দেশকে প্রদেশে বিভক্ত করা– সে পরিবর্তন এ সরকার করতে পারে না।
আমরা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার চাই। দলের সংস্কার ছাড়া ভালো রাজনৈতিক দল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। অর্থাৎ রাজনীতিকে যাতে ব্যবসায়ীরা কিংবা আমলারা প্রভাবিত করতে না পারে। রাজনীতিবিদরা যাতে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হন, সে জন্য স্থানীয় ও অন্যান্য নির্বাচনে কিছু বিধানে আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতায় সংস্কার আনতে হবে। নির্বাচনে যাতে পেশিশক্তি, অর্থ ও প্রশাসনিক প্রভাব না থাকে– তা নিশ্চিত করতে হবে এ সরকারকে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারের সুপারিশ করেছে কমিশন। নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকায় সংসদ সদস্যের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয় বলে মনে করেন অনেকে। এটা সত্য বটে, তবে এর বিপরীত একটি দিক আছে। যেখানে সংসদ সদস্যরা অর্থ, লোভ, পদ ইত্যাদিতে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লে তারা অন্য দলে যেতে পারেন। এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তনের অনাস্থা ভোটে ৭০ অনুচ্ছেদ থাকতে পারে। তাতে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা তৈরি হবে না। কিন্তু অন্য যেগুলো নীতিগত বিষয়, সেগুলো বিবেক অনুসারে কখনও নিজ দলকে সমর্থন নাও করতে পারি। এখানে বিবেকের স্বাধীনতা থাকা দরকার।
স্থানীয় সরকার নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে কিনা– এ নিয়ে আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এর মীমাংসা করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার সুবিধা হলো, প্রভাবশূন্য একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচনী মহড়ার উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। যেহেতু স্থানীয় পর্যায়ে পরিচিত লোকজন নির্বাচন করবে, রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের বাইরে এ নির্বাচনে শ্রমজীবী মানুষও কম খরচে দাঁড়াতে পারবে। আমলাতান্ত্রিক প্রভাব কমাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিই যাতে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের কার্যকর প্রধান হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারেন– সংবিধানে এটা নিশ্চিত করা চাই। এতে আমলারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারবে না।
সংবিধানে একটা সংস্কার জরুরি মনে করি। আমাদের দেশে পার্বত্যসহ অন্যান্য যেসব জাতি আছে, তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দরকার, যেটা বাহাত্তরের সংবিধানেও অনুপস্থিত। সেখানে বলা হয়েছে– সবাই আমরা বাঙালি। আমরা যে বহুজাতিক রাষ্ট্র, সে জন্য প্রতিটি জাতি ও মাতৃভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
এ সরকারের এখন উচিত হবে সংস্কার প্রস্তাবগুলো আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসা। তাতে জনগণ একটা মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে। তবে আগে যেটা বলেছি, সামান্য কিছু সংস্কারও এরা করতে পারে। কিন্তু সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে হাত দেওয়া ঠিক হবে না। সরকার যাতে সফলভাবে গণতান্ত্রিক উত্তরণ করতে পারে, তা-ই এখনকার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
এম এম আকাশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র র ব যবস থ এ সরক র সরক র ন জন য স দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ক্ষুদ্র-মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের মেলা শুরু হচ্ছে ৮ মে
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে আবার শুরু হচ্ছে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতের নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে ব্যাংকার-এসএমই নারী উদ্যোক্তা সমাবেশ, পণ্য প্রদর্শনী ও মেলা। নারীদের উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী করে তোলা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। ৮ থেকে ১১ মে রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এই মেলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলা চলবে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগ জানায়, এবারের মেলায় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ৪৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে। মেলায় আসা দর্শনার্থীদের জন্য এসএমই খাতে তাঁদের পণ্য ও সেবাসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানার সুযোগ রয়েছে। মেলায় অংশগ্রহণকারী ৭০ জন নারী উদ্যোক্তা তাঁদের পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করবেন। এ ছাড়া মেলার প্রথম ও দ্বিতীয় দিন সিএমএসএমই খাত ও সমসাময়িক অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই সেমিনার পরিচালনা করবেন। মেলা প্রাঙ্গণ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
চার দিনের এই মেলার উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন অর্থ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গত মার্চে সিএমএসএমই খাতে কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে, তার নতুন লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০২৯ সালের মধ্যে ব্যাংকের মোট ঋণ স্থিতির ২৭ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিবছর এ খাতে ঋণের পরিমাণ দশমিক ৫ শতাংশ করে বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চলতি ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যাংকের মোট ঋণ স্থিতির ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে প্রদানের কথাও বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
এদিকে এসএমই ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, দেশে ৭৮ লাখের বেশি সিএমএসএমই শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এটি মোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ৯৯ শতাংশের বেশি। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ হয় এসএমই খাতে। এই খাতে আড়াই কোটির বেশি মানুষ কর্মরত।