অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, আমাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। সংস্কারে ব্যর্থ হলে এ জাতি বহুধা পিছিয়ে যাবে। রাজনীতির ডান-বাম ধারার সবাই দোহার হয়ে একই কথা বলছেন। বাস্তবতা হলো, কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। অর্থনীতি যখন ডুবছে, বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজ তথা আয়-উপার্জনের পথ হারাচ্ছে, তখন দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও তথৈবচ। সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর সরকার বিশেষত ধর্মীয় ও সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হচ্ছে।

একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়। তার জন্য আমার জাতিসত্তার বাইরের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে, আমার ভাষার বাইরের ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠীকে, আমার ধর্মের বাইরের ছোট ধর্মগোষ্ঠীকে এবং তাদের আচরণ, মতামতকে আমার সইতে পারার মতো মন তৈরি করতে হয়। অন্তত এর আগ পর্যন্ত জাতি, ভাষা, ধর্মের সব সংখ্যালঘুকে রাষ্ট্রীয় নিরঙ্কুশ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দরকার। সে জায়গায় আমি মনে করি, রাষ্ট্র নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই আজ অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন কিংবা বহুত্ববাদ চর্চার ওপর মহলের কথাগুলো নিছক কথার কথায় পরিণত হচ্ছে। 

শুরুতে ভাস্কর্য ভাঙার কয়েক ডজন ঘটনার ক্ষেত্রে কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। ফলে মানুষ ভেবেছে ভাস্কর্যগুলোই বোধহয় স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ! আওয়ামী লুটেরারা মানুষের চিন্তার আড়ালে যেতে পেরেছে। ভাস্কর্য ভাঙার পরে আমরা মন্দির ও মাজার ভাঙতে দেখেছি। একের পর এক মন্দির ও মাজারে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। মানুষ অসহায় দৃষ্টিতে তা দেখেছে। দাবি তোলার পরও কোনো প্রতিকার মেলেনি। এ অবস্থায় মানুষ মনে করেছে সরকারেরই কোনো কোনো অংশ মুখে যতই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির কথা বলুক, কার্যত মনে বিদ্বেষই লালন করে। এ ধরনের অনেক ঘটনায় মামলা হয়েছে বটে, সরকারও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানান দিয়েছে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলেও তো বহু সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মামলা হয়েছিল, একটারও কি নিষ্পত্তি হয়েছে? ভুক্তভোগী সুবিচার পেয়েছে? এবারও যে ওইসব মামলা একই ভাগ্য বরণ করবে না, এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? প্রশাসনের তরফে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মিটিং যেমন আয়োজন করা হয়, তেমন করে মাসে একবার সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে ভিন্ন ধর্মের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বয়ান আসতে পারত। তা সম্ভবত তাদের চিন্তায়ও আসেনি।

ভাস্কর্য আর মূর্তির পার্থক্য মানুষকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন ছিল। এমনকি মূর্তিপূজাও সংশ্লিষ্ট নাগরিকের অধিকার বলে প্রচার করা যেত। এই বয়ান একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত গেলে নিশ্চয়ই এর একটি ইতিবাচক ফল মিলতে পারত। 

রাষ্ট্রের চোখে মসজিদ-মন্দির, গির্জা-প্যাগোডা কি মাজার সবই সমান। এটিই বহুত্ববাদ। এখানেই বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু বৈষম্য থাকতে পারবে না। এটি ঠিক, ওইসব ভাঙচুর, আক্রমণের সময়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিপর্যস্ত ছিল। যুক্তিগ্রাহ্য মানুষ মনে করেছিল, পুলিশে এখনও শৃঙ্খলা আসেনি, তাই এসব হচ্ছে। অল্প কিছুদিন পরেই এসব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু অগ্রসর চিন্তার মুসলিম ধর্মীয় দল মন্দির পাহারা দিয়েছে, তা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। পুলিশ ইতোমধ্যে তার দাঁত দেখাতে শুরু করেছে। অন্তত মজুরি-ভাতার ন্যায্য দাবিতে রাস্তায় নামা শ্রমিকদের এবং চাকরির দাবিতে মিছিলকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশকে সেই দাঁত বসাতে আমরা দেখেছি। এর মধ্যেও মন্দির-মাজারে হামলা হয়েছে, পুলিশ নির্বিকার ভূমিকা পালন করেছে।

এনসিটিভির নবম ও দশম শ্রেণির ব্যাকরণ বই নিয়ে শোরগোল হলো। বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ নামে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়া হলো ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ স্লোগান দিয়ে। এর প্রতিবাদ করায় পাহাড়ে নয়, খোদ রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু মতিঝিলে ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’র উগ্র ছাত্ররা ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার’ ওপর হামলা করল, তাদের রক্তে রাজপথ রাঙা হলো। আদিবাসী ছাত্ররা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গেল। সেখানেও বাধা এলো এবং হামলা হলো। আবার ওই ঘটনার প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা’ ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানসহ শত সহস্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে মিছিল বের করে দোয়েল চত্বর পার হলেই পুলিশ জলকামান আর লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখানেও ভুক্তভোগীরা কোনো প্রতিকার পেল না।
মজার ব্যাপার হলো, নিরীহ আদিবাসী শব্দ নিয়ে এই তুলকালাম কাণ্ড যখন চলছিল তখনই সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ যুক্ত করার প্রস্তাব এলো সরকার গঠিত কমিশন থেকে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বলাবলি করতে লাগল, কীসের বহুত্ববাদ? যে যায় লঙ্কা, সেই হয় রাবণ! হাসিনা স্বৈরাচারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কোনো পার্থক্য আছে কিনা, এই যখন মানুষ ভাবছে তখন বলুন তো, এই উগ্র বাঙালিত্ব আর ছাত্রলীগের বাঙালিত্বের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ছাত্রলীগের হকিস্টিক বাহিনী, হেলমেট বাহিনীর সঙ্গে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির মারধরের পার্থক্য কোথায়? শ্রমিকরা সারা মাস কাজ করার পর মজুরি না পেয়ে রাস্তায় নামলে আওয়ামী লীগ বলত ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’; এই সরকারও বলে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’– দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য রেখা স্পষ্ট করতে না পারলে যে এই ‘বহুত্ববাদ’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের’ চিন্তা শুধুই কথার কথায় রূপান্তরিত হবে, সে বোধ কি সরকারের আছে?

বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির দেশ। বর্তমান সময়ে বিশ্বায়নও একটি বাস্তবতা। প্রবাসী শ্রমিক শুধু মুসলিম দেশে কাজ পান না; ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন জাতির দেশেও তাঁকে কাজ খুঁজতে হয়। তাই বহুত্বের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিকল্প নেই। 

জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ভ স কর য সরক র র মন দ র

এছাড়াও পড়ুন:

‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি

‎নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনসৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সকল ধর্মমত, সকল  সম্প্রদায় তারা একত্রিত হয়েছে।

সকলেই সার্বিক সহয়তা করছে যাতে করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসব সুন্দর ভাবে পজলন করতে পারে। পূজাকে ঘিরে  একটি গোষ্ঠি চাইবে পূজা উৎসব নষ্ট করে দেয়ার জন্য। 

সে জন্য আমাদের তৎপরতা রয়েছে। আমাদের  গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তার পাশাপাশি র‍্যাব, বিজিবি,  সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশবাহিহনী সবাই কাজ করছে যাতে করে সুন্দর ভাবে পূজা উৎসব শেষ করতে পারি।

‎‎মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর)  শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫নং ঘাটে দূর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনের স্থান পরিদর্শনকালে তিনি এ নির্দেশনা দেন।

‎দূর্গা পূজা বিজয়া দশমী শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেকোনো অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুন্দর ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান নিরাপদ রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন জেলা প্রশাসক।

‎‎জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২২৩টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বর্তমানে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।

‎‎এসময় তিনি প্রতিটি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ সহযোগিতার নির্দেশনা দেন।

‎‎তিনি বলেন, সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব।

‎‎এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
  • নুরুল হকের ওপর হামলার ঘটনায় জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
  • ১৭ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ, নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই হাজার সদস্য
  • ফরিদপুরে অবরোধ শনিবার পর্যন্ত স্থগিত
  • আসন্ন নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশ ডিএমপি কমিশনারের