কিয়েভের পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। শহর ও দেশজুড়ে এক ধরনের ভয় মিশ্রিত প্রত্যাশা ছিল। সামরিক পদক্ষেপের অবসান কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হবে– প্রত্যাশাটি এমন ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা কীসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তা মোটেও পরিষ্কার ছিল না, তবে এর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের ব্যাপারে মার্কিননীতি পরিবর্তনের সম্পর্ক ছিল।
গতকাল হোয়াইট হাউসের মঞ্চে উৎকণ্ঠা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ট্রাম্প ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে খনিজ পদার্থ বিষয়ক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা এবং তাঁকে অপমান করার আগে করমর্দন, সম্মতিজ্ঞাপন বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাত লাগানো সবই করেছেন। একই সময়ে উত্তর ও পূর্ব ইউক্রেনে বিমান হামলার সাইরেন বাজছিল। ফলাফল, আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল এবং জেলেনস্কি বিদায় নিলেন।

টিভি ক্যামেরার সামনে যা দেখা গেল, তা ছিল দারুণ ও অসাধারণ। জেলেনস্কিকে দেখাচ্ছিল গম্ভীর, রাগান্বিত ও বেপরোয়া। কেননা, একজন উপযুক্ত নেতাকে তাঁর জাতির জন্মগত অধিকার নিয়ে দরকষাকষি করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। ট্রাম্প নিজেকে একজন সৎ মধ্যস্থতাকারী দাবি করে বলেন, ‘আমি কারও সঙ্গে জোটবদ্ধ নই। আমি বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত।’ তিনি এ সময় জেলেনস্কিকে বলেন, কৃতজ্ঞ হোন। ট্রাম্প এমন এক ব্যক্তিকে বলছেন, যিনি তাঁর লোকদের খুন হতে দেখেছেন, তাঁর এলাকা দখল ও অবরোধ করতে দেখেছেন। ‘চুক্তি করুন, নইলে আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি।’
পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো। জেলেনস্কি তাঁকে যুদ্ধের নৃশংসতার ছবি দেখান। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাদের পাশে আছেন।’ কিন্তু বাস্তবে এখন কোনো আশা বা প্রত্যাশার সত্যতা দেখছি না। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অসম্মানিত হওয়ায় জেলেনস্কিকে আক্রমণ করেছেন। ট্রাম্প ও ভ্যান্স উভয়েই ক্যামেরার সামনে তাঁকে মৌখিকভাবে তীব্র সমালোচনা করেন। কারণ এটি এখন দরকষাকষির শিল্পের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা এখন পক্ষপাত, ভয় প্রদর্শন, রক্তপাতহীন হলেও নির্মম। 

কিন্তু ইউক্রেনবাসী এখন বিশ্বাস করে, শান্তিচুক্তি নিয়ে প্রেসিডেন্টের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না; বরং এই অঞ্চলে মার্কিন জড়িত থাকার বিষয়ে অনেকগুলো ভিন্ন ধারণা বিরাজ করছে। এসব ধারণার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত রয়েছে, তবে তা কখনও রাশিয়ান আগ্রাসনের শিকার এমন একটি দেশকে সমর্থন করার দিকে মনোনিবেশ করে না।
গত দুই সপ্তাহে আমরা দেখেছি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির বিষয়টি এখন বিরল মাটির ধাতু খনির ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে। সৌদি আরবে রাশিয়ান-মার্কিন দরকষাকষিতে অংশগ্রহণকারীরাও পৃথিবীর বিরল ধাতু নিষ্কাশন নিয়ে আলোচনা করেছিল। এ সময় তারা কেবল রাশিয়া অঞ্চল ও দখলকৃত ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোর সম্পদের ওপর মনোনিবেশ করেছিল। এই পৃথিবীর এ বিরল ধাতুগুলো ইউক্রেন যুদ্ধ ও সামরিক সহায়তার বিষয়টি মিডিয়া মনোযোগের বাইরে ঠেলে দিয়েছে। সেই জায়গা এখন ডলারে পরিপূর্ণ। 

সোভিয়েত ইউনিয়নে বেড়ে ওঠা বয়স্ক ইউক্রেনীয়রা এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠিকঠাকভাবে চিনতে পেরেছে। সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা কার্টুনে তাদের লোভী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, দখলদার পুঁজিতান্ত্রিক জাতি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল, যারা জটিল সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে শুধু ডলারের অতিলাভের ওপর দৃষ্টিনিবন্ধ করে। 
এটি একটি অস্তিত্বের যুদ্ধ এবং নতুন বাস্তবতা। ট্রাম্প বলেছেন, জেলেনস্কি ‘শান্তির জন্য প্রস্তুত নন’, তবে যে কোনো মূল্যে ইউক্রেনের কাছে যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প নেই। যে সহায়তা আগে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল, তা এখন কিনতে হবে। টাকা না থাকলে সম্পদ দিয়ে দিতে হয়। রাশিয়ান আগ্রাসনের তিন বছর পর ইউক্রেনে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আর্থিক স্বার্থ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরিবর্তে মাঠে নেমেছেন ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

জেলেনস্কি সাহসী ছিলেন, কিন্তু আমরা এখন সাহায্যপ্রার্থী। ট্রাম্প ও ক্রেমলিন বারবার স্পষ্ট করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার আলোচনায় ইউক্রেনের অংশগ্রহণ প্রয়োজনীয় বা কাম্য নয়। অন্য অনেক কিছুর মতো, বাইডেনের ঘোষিত নীতি বলে, ‘কোনো কারণ ছাড়াই ইউক্রেন নিয়ে আলাপ হচ্ছে না’, এখন যার পায়ের নিচের মাটি সরে যেতে শুরু করেছে। জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে সম্পদ হস্তান্তর-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য ডাকা হয়েছিল, কথা বলার জন্য নয়। 
ট্রাম্প তাঁর পথ পেয়েছেন। তিনি ইউক্রেনকে একটি কর্তা থেকে একটি কর্মে রূপান্তরিত করেছেন। আর এই হোয়াইট হাউসের অবমাননার পরে ইউক্রেনীয় কিছু লোক নিশ্চিত, ট্রাম্পের শর্তে বিরল মাটির ধাতু নিষ্কাশন হলে তাদের দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘উপনিবেশ’-এ পরিণত হবে। তবুও, অনেক ইউক্রেনীয় রাশিয়ান উপনিবেশের চেয়ে মার্কিন উপনিবেশে থাকতে পছন্দ করবে, যদি সেই পরিস্থিতি দেখা দেয়। 

আন্দ্রে কুরকভ: ইউক্রেনীয় ঔপন্যাসিক এবং ডেথ অ্যান্ড দ্য পেঙ্গুইন উপন্যাসের লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইউক র ন য ইউক র ন র পর স থ ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা

সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।

আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’

তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’

আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’

ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।

ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’

পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।

গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।

তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।

জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।

দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
  • দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • যদি ঠিক পথে থাকো, সময় তোমার পক্ষে কাজ করবে: এফ আর খান
  • বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ নিয়ে ক্ষুদ্ধ মাহি
  • ফতুল্লায় দুই ট্রাকের মাঝে পড়ে যুবকের মৃত্যু
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ মামলার আসামি নিহত, গুলিবিদ্ধ ৩
  • নামতে গেলেই চালক বাস টান দিচ্ছিলেন, পরে লাফিয়ে নামেন
  • তানজানিয়ার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের বিজয়ী সামিয়া
  • আমার স্ত্রী খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করছেন না: জেডি ভ্যান্স