কিয়েভের পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। শহর ও দেশজুড়ে এক ধরনের ভয় মিশ্রিত প্রত্যাশা ছিল। সামরিক পদক্ষেপের অবসান কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হবে– প্রত্যাশাটি এমন ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা কীসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তা মোটেও পরিষ্কার ছিল না, তবে এর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের ব্যাপারে মার্কিননীতি পরিবর্তনের সম্পর্ক ছিল।
গতকাল হোয়াইট হাউসের মঞ্চে উৎকণ্ঠা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ট্রাম্প ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে খনিজ পদার্থ বিষয়ক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা এবং তাঁকে অপমান করার আগে করমর্দন, সম্মতিজ্ঞাপন বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাত লাগানো সবই করেছেন। একই সময়ে উত্তর ও পূর্ব ইউক্রেনে বিমান হামলার সাইরেন বাজছিল। ফলাফল, আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল এবং জেলেনস্কি বিদায় নিলেন।

টিভি ক্যামেরার সামনে যা দেখা গেল, তা ছিল দারুণ ও অসাধারণ। জেলেনস্কিকে দেখাচ্ছিল গম্ভীর, রাগান্বিত ও বেপরোয়া। কেননা, একজন উপযুক্ত নেতাকে তাঁর জাতির জন্মগত অধিকার নিয়ে দরকষাকষি করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। ট্রাম্প নিজেকে একজন সৎ মধ্যস্থতাকারী দাবি করে বলেন, ‘আমি কারও সঙ্গে জোটবদ্ধ নই। আমি বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত।’ তিনি এ সময় জেলেনস্কিকে বলেন, কৃতজ্ঞ হোন। ট্রাম্প এমন এক ব্যক্তিকে বলছেন, যিনি তাঁর লোকদের খুন হতে দেখেছেন, তাঁর এলাকা দখল ও অবরোধ করতে দেখেছেন। ‘চুক্তি করুন, নইলে আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি।’
পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো। জেলেনস্কি তাঁকে যুদ্ধের নৃশংসতার ছবি দেখান। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাদের পাশে আছেন।’ কিন্তু বাস্তবে এখন কোনো আশা বা প্রত্যাশার সত্যতা দেখছি না। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অসম্মানিত হওয়ায় জেলেনস্কিকে আক্রমণ করেছেন। ট্রাম্প ও ভ্যান্স উভয়েই ক্যামেরার সামনে তাঁকে মৌখিকভাবে তীব্র সমালোচনা করেন। কারণ এটি এখন দরকষাকষির শিল্পের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা এখন পক্ষপাত, ভয় প্রদর্শন, রক্তপাতহীন হলেও নির্মম। 

কিন্তু ইউক্রেনবাসী এখন বিশ্বাস করে, শান্তিচুক্তি নিয়ে প্রেসিডেন্টের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না; বরং এই অঞ্চলে মার্কিন জড়িত থাকার বিষয়ে অনেকগুলো ভিন্ন ধারণা বিরাজ করছে। এসব ধারণার মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত রয়েছে, তবে তা কখনও রাশিয়ান আগ্রাসনের শিকার এমন একটি দেশকে সমর্থন করার দিকে মনোনিবেশ করে না।
গত দুই সপ্তাহে আমরা দেখেছি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির বিষয়টি এখন বিরল মাটির ধাতু খনির ইস্যুতে রূপান্তরিত হয়েছে। সৌদি আরবে রাশিয়ান-মার্কিন দরকষাকষিতে অংশগ্রহণকারীরাও পৃথিবীর বিরল ধাতু নিষ্কাশন নিয়ে আলোচনা করেছিল। এ সময় তারা কেবল রাশিয়া অঞ্চল ও দখলকৃত ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোর সম্পদের ওপর মনোনিবেশ করেছিল। এই পৃথিবীর এ বিরল ধাতুগুলো ইউক্রেন যুদ্ধ ও সামরিক সহায়তার বিষয়টি মিডিয়া মনোযোগের বাইরে ঠেলে দিয়েছে। সেই জায়গা এখন ডলারে পরিপূর্ণ। 

সোভিয়েত ইউনিয়নে বেড়ে ওঠা বয়স্ক ইউক্রেনীয়রা এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠিকঠাকভাবে চিনতে পেরেছে। সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা কার্টুনে তাদের লোভী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, দখলদার পুঁজিতান্ত্রিক জাতি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল, যারা জটিল সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে শুধু ডলারের অতিলাভের ওপর দৃষ্টিনিবন্ধ করে। 
এটি একটি অস্তিত্বের যুদ্ধ এবং নতুন বাস্তবতা। ট্রাম্প বলেছেন, জেলেনস্কি ‘শান্তির জন্য প্রস্তুত নন’, তবে যে কোনো মূল্যে ইউক্রেনের কাছে যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প নেই। যে সহায়তা আগে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল, তা এখন কিনতে হবে। টাকা না থাকলে সম্পদ দিয়ে দিতে হয়। রাশিয়ান আগ্রাসনের তিন বছর পর ইউক্রেনে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আর্থিক স্বার্থ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরিবর্তে মাঠে নেমেছেন ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

জেলেনস্কি সাহসী ছিলেন, কিন্তু আমরা এখন সাহায্যপ্রার্থী। ট্রাম্প ও ক্রেমলিন বারবার স্পষ্ট করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার আলোচনায় ইউক্রেনের অংশগ্রহণ প্রয়োজনীয় বা কাম্য নয়। অন্য অনেক কিছুর মতো, বাইডেনের ঘোষিত নীতি বলে, ‘কোনো কারণ ছাড়াই ইউক্রেন নিয়ে আলাপ হচ্ছে না’, এখন যার পায়ের নিচের মাটি সরে যেতে শুরু করেছে। জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে সম্পদ হস্তান্তর-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য ডাকা হয়েছিল, কথা বলার জন্য নয়। 
ট্রাম্প তাঁর পথ পেয়েছেন। তিনি ইউক্রেনকে একটি কর্তা থেকে একটি কর্মে রূপান্তরিত করেছেন। আর এই হোয়াইট হাউসের অবমাননার পরে ইউক্রেনীয় কিছু লোক নিশ্চিত, ট্রাম্পের শর্তে বিরল মাটির ধাতু নিষ্কাশন হলে তাদের দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘উপনিবেশ’-এ পরিণত হবে। তবুও, অনেক ইউক্রেনীয় রাশিয়ান উপনিবেশের চেয়ে মার্কিন উপনিবেশে থাকতে পছন্দ করবে, যদি সেই পরিস্থিতি দেখা দেয়। 

আন্দ্রে কুরকভ: ইউক্রেনীয় ঔপন্যাসিক এবং ডেথ অ্যান্ড দ্য পেঙ্গুইন উপন্যাসের লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইউক র ন য ইউক র ন র পর স থ ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা

জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদের গভীরতম শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়ে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)

আমার পিতার মৃত্যুপথের যাত্রা আমাকে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা আমি আমার পরিবার এবং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই শিক্ষাগুলো যে কাউকে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের যত্ন নিতে সাহায্য করবে।

১. এটাই জান্নাতের পথ

এক বছর আগে, আমার পিতা দারুস সালামের একটি মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে যান। এ দুর্ঘটনা তাঁকে হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ করে এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য আমরা দুবাইয়ে চলে আসি। একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’

এই কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। যত্ন নেওয়ার কষ্টকে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করি। এটি আমাকে কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।

আরও পড়ুনবাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’

২. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি

বাবা যেদিন পড়ে যান, সেদিন থেকে আমি অনুভব করি, তাঁর সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মুসলিম চ্যাপলেইন শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদের সঙ্গে কথা বলি।

তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর সঙ্গে যা বলতে চাও, বলে নাও। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও। তাঁর সম্পত্তি, দাফন এবং সাদাকার ইচ্ছা জেনে রাখো। শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এই সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন।’

এই পরামর্শ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করেছে এবং আমার দায়িত্ব স্পষ্ট করেছে।

৩. দিনগুলো দীর্ঘ, বছরগুলো ছোট

মৃত্যুপথযাত্রী একজন পিতার যত্ন নেওয়া শিশুপালনের মতো। দিনগুলো ক্লান্তিকর—খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, বহন করা। আমার মা এই দায়িত্বের বেশির ভাগ পালন করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন। কখনো মনে হতো, এই কষ্ট কি শেষ হবে? আবার পরক্ষণেই ভয় হতো, শেষটা কি খুব কাছে?

এই দ্বন্দ্ব আমাকে বর্তমানে থাকতে এবং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখিয়েছে।

৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলা

পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। চিকিৎসা, অর্থ বা মানসিক চ্যালেঞ্জ—ঢেউ থামানো যায় না, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভেসে চলা যায়। আমি এটাকে ‘সার্ফ-মোড’ বলি। এই মানসিকতা আমাকে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই না করে তাদের গ্রহণ করতে শিখিয়েছে।

৫. কষ্টের মধ্যে স্বস্তি

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে’ (সুরা শারহ: ৫)। পিতার অসুস্থতার মধ্যেও আমরা আল্লাহর রহমত দেখেছি—সঠিক চিকিৎসা দল, সময়মতো সঠিক মানুষের আগমন এবং ছোট ছোট অলৌকিক ঘটনা। এই ‘খায়ের’ আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে।

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও।শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদ, মুসলিম চ্যাপলেইন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়

৬. পিতার সেবা একটি ‘জিহাদ’

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার পিতা–মাতার সেবাই তোমার জিহাদ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৯৭২)। পিতার যত্ন নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর বিরক্তি, দুশ্চিন্তা এবং ক্রমাগত চাহিদা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। কখনো হতাশা বা রাগ অনুভব করেছি, কিন্তু কোরআনের আয়াত—‘তাদের সঙ্গে “উফ” বলো না’ (সুরা ইসরা: ২৩)—আমাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই জিহাদ আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল।

আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫

৭. পালিয়ে যাওয়া

ডাক্তারের জন্য, চেকআপের জন্য বা পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। কিন্তু এটি আমার নফসের দুর্বলতা ছিল। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি। এটি আমাকে পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং বর্তমানে থাকতে শিখিয়েছে।

৮. সহনশীলতার খেলা

পিতার যত্ন নেওয়া একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। সাইক্লিং ও দৌড় থেকে শিখেছি, সহনশীলতার জন্য বিশ্রাম, খাওয়া এবং ব্যায়াম প্রয়োজন। যখন আমি দৌড়াতে যেতাম বা ঘুমাতাম, তখন অপরাধবোধ অনুভব করতাম। কিন্তু নিজের যত্ন না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে যত্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আমাকে ভারসাম্যের গুরুত্ব শিখিয়েছে।

৯. অস্বস্তিকর আলাপ

মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি, ঋণ বা দাফনের ইচ্ছা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমরা পিতার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁর অছিয়ত (উইল) নিয়ে পুরোপুরি আলোচনা করতে পারিনি। এটি আমাকে শিখিয়েছে, আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগে অছিয়ত স্পষ্ট করে রাখতে হবে। একবার এই আলাপ হয়ে গেলেই হয়ে গেল। অন্য সময় নাহয় স্মৃতি বা পরামর্শ শেয়ার করার জন্য তোলা থাক।

১০. অনিশ্চিত সময়ে পরিকল্পনা

পিতার অবস্থা কখনো উন্নত, কখনো সংকটাপন্ন ছিল। এই অনিশ্চয়তায় জীবন পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি ‘বাগানের মালির মানসিকতা’ গ্রহণ করি—গাছের যত্ন নিয়ে ফুল-ফসল আল্লাহর হাতে ভাবেন তাঁরা। তেমনি আমি ইস্তিখারা পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিই। এটি আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ত্যাগ করে ভাগ্যের ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।

পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি।

১১. নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর ব্যবস্থা

গত রমজানে আমি দোয়া করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পিতা–মাতার সেবা করার সুযোগ দাও।’ তখন আমি আমেরিকায় স্থায়ী ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দুবাইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন—১০ বছরের ভিসা, কাজ এবং স্থানীয় সুবিধা। এই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুবিধা আমাকে আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।

১২. নিয়তের পবিত্রতা

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব তোমার অন্তরের কথা জানেন। যদি তুমি সৎ হও, তিনি তওবাকারীদের ক্ষমা করেন।’ (সুরা ইসরা: ২৫)

যখন লোকে আমার প্রশংসা করত, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, আমি কি আল্লাহর জন্য এটি করছি, নাকি মানুষের প্রশংসার জন্য? হতাশার মুহূর্তে আমি নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আন্তরিকতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।

১৩. জিকিরের মাধ্যমে কষ্ট সহ্য করা

পিতা সারা বছর তাঁর ব্যথার মধ্যেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, দরুদ শরিফ এবং তিলাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জিকির আমাকে একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে একজন শায়খ বলেছিলেন, ‘রোগী যদি একটি তাসবিহও বলতে পারেন, তবে তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করো।’ পিতার প্রতিটি জিকির তাঁর মর্যাদা বাড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।

আরও পড়ুনপিতা-মাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু১১ আগস্ট ২০১৬

১৪. আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন

একবার একজন নিরাপত্তারক্ষী পিতাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তিনি আপনাকে পরীক্ষা করছেন।’ এই কথা আমাকে ইমাম মালিকের হাদিসের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘একজন মুসলিমের ওপর যেকোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা আসে, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিঁধে, তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে আল্লাহ তা দিয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৮২৮)

এটি আমাকে কষ্টের পেছনের হিকমত বুঝতে সাহায্য করেছে।

মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম

১৫. দুশ্চিন্তা মোকাবিলা

চিকিৎসা ব্যয় এবং বাবার অবস্থা নিয়ে আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন বন্ধু আমাকে ইমাম শাফিঈর কবিতা পাঠান: ‘যা ছিল, তাতে আল্লাহ তোমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন; যা হবে, তাতেও তিনি যথেষ্ট দেবেন।’

এ কথা আমাকে দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।’

১৬. মায়ের শক্তি

আমার মা ছিলেন আমাদের পরিবারের মেরুদণ্ড। তিনি বাবার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া এবং আরামের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও ভালোবাসা আমাকে একজন স্ত্রী ও মায়ের অপরিসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি দোয়া করি, আমরা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মতোই যত্ন নিতে পারি।

১৭. চিকিৎসা বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত

আতুল গাওয়ান্দের বই ‘বিয়িং মর্টাল’ আমাকে শিখিয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা কষ্ট বাড়াতে পারে। আমরা একটি ‘প্রাকৃতিক মৃত্যুর অনুমতি’ ফর্ম স্বাক্ষর করি, যা পিতার জন্য শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এটি আমাকে মৃত্যুকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।

১৮. মৃত্যুর মুহূর্ত

মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম এবং বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত আমাকে আল্লাহর মহিমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

১৯. ব্যক্তিগত ও উম্মাহর কষ্ট

পিতার মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত কষ্ট ছিল, কিন্তু গাজার ভাই-বোনদের দুঃখ আমাকে আরও বেশি ব্যথিত করেছে। তাদের অনেকে প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার বা দাফনের সুযোগ পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে উম্মাহর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে।

২০. কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব

এই যাত্রা আমাকে আল্লাহর রহমত, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে আমরা মৃত্যুকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা শিখেছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুন্দর পরিণতি দিন।

সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম। অনুবাদ: মনযূরুল হক

আরও পড়ুনমারা গেলে নয়, সব সময় বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা২০ মার্চ ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খামেনিকে হত্যায় ইসরায়েলি পরিকল্পনা আটকে দেন ট্রাম্প
  • সাংবাদিক পরিচয়ে গেস্ট হাউসের কক্ষে কক্ষে তল্লাশি, দম্পতির কাছে বিয়ের প্রমাণ দাবি
  • ডেঙ্গু-করোনায় দুই মৃত্যু, আক্রান্ত ২৭৫ জন
  • চলতি মাসের ১৫ দিনে করোনায় ৪ জনের মৃত্যু
  • গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে প্রপাগান্ডার সয়লাব
  • কারাগারে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাক-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ১
  • রাতারাতি তারকা হলে দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন: রিচি
  • গুম করা হতো তিনটি ধাপে 
  • এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা