চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো রাজনীতি বা দলীয় কোন্দল নেই। চাঁদাবাজি, বালুর মহাল দখল, অবৈধ মাটির ব্যবসাই এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ। এমন দাবি করেছেন উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের নুর আহমদ সড়কের নাসিমন ভবনের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, ৫ আগস্টের পর রাউজানে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা নেই। রাজনৈতিক কোনো নেতার দ্বন্দ্বে এসব ঘটনা ঘটেনি। মূলত রাউজানে ১৯৮৫ সালের পর থেকে কলেজছাত্র ফারুক হত্যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। এ পর্যন্ত শতাধিক ছাত্র-যুবককে প্রাণ দিতে হয়েছে।  সে সময় ছাত্রলীগ ও অধুনালুপ্ত এনডিপির সন্ত্রাসীরা এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। ৫ আগস্টের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আবার ঘটতে শুরু করেছে।

হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, মাটি কাটা, খালের বৈধ ও অবৈধ বালুর মহাল দখল ও বিক্রির দ্বন্দ্ব, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার থেকে কমিশন বাণিজ্য করার প্রতিযোগিতা, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করাসহ নানা অনিয়মের বিরোধে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

চাঁদাবাজিসহ বিভিন্নভাবে টাকা উপার্জন করে অস্ত্র কেনা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, বিগত কয়েক মাসে রাউজানে অনেক অস্ত্রশস্ত্র কেনা হয়েছে। এটা হয়তো অনেকে জানেন। প্রশাসনও জানে এটা। সুতরাং সন্ত্রাসীরা নিজেদের কর্মকাণ্ড আড়াল করার জন্য রাজনীতির ছত্রচ্ছায়া ব্যবহার করছে।

‘মামলার আসামি দিতে তোড়জোড়’

গোলাম আকবর খন্দকার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাউজানে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটার পর নিরপরাধ মানুষকে মামলার আসামি করতে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। এরপর মামলায় ফাঁসিয়ে টাকা দাবি করা হয়। যেমন, কয়েক দিন আগে উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের মুহাম্মদ মানিক আবদুল্লাহকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এখানে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। মাটি কাটা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারপরও তাঁকে দলের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডে হওয়া মামলায় বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে, যাঁরা আদৌ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের কাছ থেকে টাকা চাওয়া হচ্ছে।

গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, কয়েক মাস আগে নোয়াপাড়ার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তাঁকে গুলি করে মেরেছে। এই ঘটনার নেপথ্যেও ছিল চাঁদাবাজি।

দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রসঙ্গ টেনে গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, ‘পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাউজান উপজেলা প্রশাসন ও থানা প্রশাসনে দুটি গ্রুপ গিয়ে বসে থাকে। কেমন করে বসে থাকবে? ওখানে একটা গ্রুপ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসে থাকে। যারা ৫ আগস্টে পটপরিবর্তনের দিন রাউজান থানায় হামলা করে অস্ত্র লুট করেছে, তারাও থানার আশপাশে গিয়ে বসে থাকে। মানুষ যাবে কোথায়? সাধারণ মানুষ থানায় যেতে পারে না। প্রশাসনের কাছে যেতে পারে না।’

গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, কয়েক দিন আগে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তাকে যুবদল নামধারী একজন সন্ত্রাসী মারধর করেছেন। আগে তিনি ছাত্রলীগ করতেন। পটপরিবর্তনের পর যুবদলের হয়ে গেছেন। প্রকল্প কর্মকর্তা থানায় গিয়ে মামলা করেছেন। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে কারও ছত্রচ্ছায়ায় তাঁর জামিন হয়ে গেছে।

‘১ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা চাঁদাবাজি’

সংবাদ সম্মেলনে চাঁদাবাজির বিবরণ তুলে ধরেন গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, রাঙামাটি-কাপ্তাই থেকে প্রতিদিন গাছের ট্রাক আসে। প্রতিদিন প্রায় ৫০টির বেশি গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে। রাউজানে ৩৮টির মতো ইটভাটা রয়েছে। প্রতিটি ইটভাটা থেকে ৩ লাখ টাকা দিতে হবে, এমন নিয়ম ধার্য হয়েছে। অবশ্য গত নভেম্বরে প্রতিটি ইটভাটা ২ লাখ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হয়েছে।  আর গত ঈদের আগে প্রতিটি থেকে ১ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এই টাকা কার পকেটে গিয়েছে, তা খুঁজে বের করতে হবে।

বাড়িঘর নির্মাণ করতেও চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গোলাম আকবর খন্দকার। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ বাড়িঘর নির্মাণ করছে। বাড়িঘর নির্মাণে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। ওই টাকা তুলতে কালেক্টর (সংগ্রকারী) আছেন। তারা টাকা তুলে অ্যাকাউন্টে জমা দেয়। কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে।

গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, ‘সরকারি সংস্থা বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ করছে। সরকারি ঠিকাদার থেকে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন আদায় করা হচ্ছে।  টাকা না দিলে রাস্তার কাজ বন্ধ করা হচ্ছে। যেমন, রাউজানে পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ একটি ব্রিজ নির্মাণ করছে। খরচ হচ্ছে প্রায় ১২ কোটি টাকা। চাঁদার দাবিতে ওই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, ৩ কোটি টাকা চাঁদা দিতে হবে। আমাকে ফোন করে বিষয়টি ঠিকাদার জানিয়েছেন। এই অবস্থা প্রতিটি সেক্টরেই আছে।’

চাঁদাবাজি-দখল নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ড জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে বলে উল্লেখ করেন গোলাম আকবর খন্দকার। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে উপজেলার, কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। চাঁদাবাজি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে কয়েক মাস আগে দলের কেন্দ্রীয় একজন ভাইস চেয়ারম্যানকেও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের নেতার পদও স্থগিত করা হয়েছে। এখানে কোন্দল ও সন্ত্রাস করলে কেউ মনোনয়ন দেবে না। দল খুব সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে মনোনয়ন দেবে।

‘যৌথ বাহিনীর অভিযান দরকার’

পরিস্থিতি সামাল দিতে যৌথ বাহিনীর অভিযান দরকার বলে জানিয়েছেন গোলাম আকবর খন্দকার। তিনি বলেন, নোয়াপাড়া, পথের হাট, পাহাড়তলী চৌমুহনী, গহিরা, মুন্সিরঘাটা ও উপজেলা সদরে যৌথবাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল দরকার। এতে করে মানুষ যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। সন্ত্রাসীরা ভয় পাবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে। হালদা ও কর্ণফুলী থেকে অন্তত কয়েক মাসের জন্য বালু উত্তোলন বন্ধ রাখতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকারকে শোকজ

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারকে শোকজ করা হয়েছে। আজ বুধবার দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ তাদের এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে বিএনপির দপ্তর সূত্র নিশ্চিত করেছে।

গত বছরের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস কাদের চৌধুরীকে একবার শোকজ করা হয়েছিল। তখন তিনি শোকজের জবাব দিয়েছিলেন। তবে অসন্তোষ প্রকাশ করে গিয়াস কাদেরকে সতর্ক করেছিল বিএনপি।

গিয়াস কাদের চৌধুরী ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে ও প্রয়াত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই। আর চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতিতে গিয়াসের সঙ্গে গোলাম আকবরের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বসুন্ধরার চেয়ারম্যানসহ পরিবারের ২২ কোম্পানির শেয়ার ও ৭০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ
  • দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পেলেন গিয়াস কাদের ও গোলাম আকবর
  • গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকারকে শোকজ