দেশভাগের পর থেকে  এ জনপদের নারীদের সামাজিক ও মনস্তাত্বিক উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল ‘বেগম পত্রিকা’। শহুরে সংস্কৃতিতেই শুধু নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের কাছে বেগমের আবেদন ছিল অনেক বেশি। গ্রামে  খোলা ডাকে পৌঁছাতো ‘বেগম’ বেগম পত্রিকা। ওই সময় যারা অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানতেন তারা যেমন বেগম পত্রিকার পাঠক ছিলেন, তেমনি উচ্চশিক্ষিতরাও বেগম পড়তেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাকযোগে পত্রিকাটা যেত। মজার একটা ডাক ব্যবস্থা ছিল, ‘বুক পোস্ট’। এই মাধ্যমে স্বাভাবিক ডাক মাশুলের চেয়ে অনেক কম পয়সায় একটি ডকুমেন্ট এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো যেত। আমার মনে আছে পঁচিশ পয়সায় একটি পত্রিকা চলে যেত ঢাকা থেকে। একটু ফোল্ড করে ওপরে একটি কাগজে ঠিকানা আর পঁচিশ পয়সার একটা স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেওয়া হতো। তখনকার দিনে নিয়ম ছিল, আপনি কম টাকায় খোলা ডাকে ডকুমেন্ট পাঠাতে পারবেন। যেখানে একটি চিঠি পাঠাতে খরচ হতো আট আনা। 

যদিও বেগম মূলত নারীদের পত্রিকা। কিন্তু তখনতো খুব কম মেয়েই ছিল যে স্কুল কলেজে যেত। অনেক গ্রাম ছিল, যেখানে কোনো প্রাইমারি স্কুলই ছিল না। প্রাইমারি স্কুল খুঁজতে আবার আরেক গ্রামে যেতে হতো। আশির শুরুর দিক পর্যন্ত এই চিত্র ছিল। কিছু মানুষ ব্রিটিশ আমলে চাকরিসূত্রে পরিবারসহ শহরে থাকতেন। যখন দেশ ভাগ হয়ে গেলো তখন তাদের অনেকেই গ্রামে ফিরে আসলেন। এবং তাদের মনে ওই যে ‘শহর’ ছিলো, ওই যে শহুরে সংস্কৃতিতে জ্ঞান চর্চা, লাইব্রেরিতে যাওয়া— ওই সংস্কৃতি তারা গ্রামে পেলেন না। তখন এই অভাবটা পূরণ করতো বেগম, সওগাত, মোহাম্মদী পত্রিকাগুলো।  আমার নিজের দেখা যেটা, বেগম পত্রিকাটা পড়া হতো একেবারে সম্মিলিতভাবে। গ্রামে হয়তো একটা বাড়িতে বেগম রাখা হতো। সবাই ওই বাড়িতে যেতেন পত্রিকাটা পড়তে, কেউ কেউ যেতেন শুনতে। বেগম যে শুধু নারীর পত্রিকা তা কিন্তু নয়।মজার ব্যাপার হলো বেগম পুরুষেরাও পড়তেন।

আরো পড়ুন:

‘ব্লু লাইট’ যেভাবে ঘুমের ক্ষতি করে

কাজ নাকি কাজের ‘রেজাল্ট’কে প্রাধান্য দেবেন?

নিজের দেখা, আমার মায়ের দাদি, এবং আমার মায়ের মা অর্থাৎ আমার নানি ওনারা এই পত্রিকা পড়তেন। মায়ের দাদা ছিলেন তেজগাঁও থানার ওসি। তিনি যখন গ্রামে ফিরে গেলেন। তখন এই যে শহরকেন্দ্রিক তার যে পদচারণা ছিল, সেইটার ধারাবাহিকতা রক্ষা হলো বেগম পত্রিকার মাধ্যমে। কারণ তারা গ্রামে পর্যাপ্ত বই পায়নি, লাইব্রেরিতো ছিলোই না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তৎকালীন যে সমাজ কাঠামো, সেটা নারী শিক্ষাবান্ধব ছিল না। নারীদের পড়াশোনা করা সমাজ খুব একটা ভালো চোখে দেখতো না। আজকের নারী সমাজের যে অগ্রগতি দেখি তার ভিত্তিমূলে গেলে বেগমের একটা বিশাল ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাবে। বেগমের নারী পাঠক যারা ছিলেন, তারা সচেতন মা হয়ে উঠেছিলেন। উনাদের সন্তানদের পরবর্তীতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যায় পড়তে হয়নি। তারা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে গেছে। আমার মা এবং নানিকে দেখেছি বাড়ির শিশুরা ও পুরুষেরা ঘুমিয়ে গেলে অল্প আলোতে বেগম পত্রিকা পড়তেন। দিনের বেলায় হয়তো কাজের জন্য পড়তেন না। রাতে নিজে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পত্রিকাটা পড়তেন তারা। এখনকার মতো ঝলমলে ছিল না বেগম। নিউজপ্রিন্টের কাগজে ছাপা হতো। দেখতে এখনকার ম্যাগাজিনের মতো ছিল না। বর্তমান একটি দৈনিক পত্রিকা ভাঁজ করলে যেমন দেখায়, অনেকটা ওই আকারে প্রকাশ হতো বেগম। সমাজপতিরা বলতেন, বেগম ‘মিস লিড’ করছে নারীদেরকে। নারীদের মাথা নষ্ট করে ফেলছে। আমার জানা মতে, বেগম পত্রিকা যারা পড়তেন তারা সামাজিকভাবে এগিয়ে থাকা মানুষ।

পশ্চাৎপদ একটি গোষ্ঠী যাদেরকে সমাজ সহযোগিতা করছে না, বরং সমাজ তাদেরকে আরও পেছনের দিকে ঠেলছে; যাতে তারা সামনে আসতে না পারে—সেই জায়গায় একটা আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে বেগম পত্রিকা। কারণ সব রকম তথ্য, তত্ত্ব এক জায়গায় করে একটি মলাটের মধ্যে- এই ধরনের মন মানসিকতা যাদের ছিল তাদের কাছে উপস্থাপিত হতো। এবং সেই খানে তৎকালীন ফ্যাশন, সিনেমা, নাটক, সাহিত্য তুলে ধরা হতো। এই লেখাগুলো তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতো। 

‘বেগম’ পড়া আর না পড়া মানুষের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য ছিল। চলাফেরা, বাচনভঙ্গিতে অনেক এগিয়ে থাকতেন বেগমের পাঠক। সেক্ষেত্রে বলা যায়, ৫০ থেকে ৮০- এর দশক বা তার পরেও নারীর সার্বিক মননশীলতা উন্নয়নে বেগমের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অপরিসীম। অন্দরে থাকা নারীদের বিশ্বমুখী মনন গঠনে বেগম একটা দারুণ ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের মধ্যে আরেকটা সমাজ গড়ে তুলেছে বেগম।

ঢাকা/লিপি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব গম র আম র ম ব গম প পড়ত ন

এছাড়াও পড়ুন:

পুলিশের এখনকার ভূমিকার প্রশংসায় বিএনপির মাহদী আমিন

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে পুলিশের আচরণে পরিবর্তন দেখছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন।

মাহদী আমিন বলেছেন, ‘অন্ততপক্ষে গত এক বছরে পুলিশকে দেখছি আমরা অনেক কমফোর্টেবল একটা জায়গা থেকে। আমাদের রেসপেক্ট হচ্ছে। আজকে এভাবে কথা বলছি বা ফ্রিলি কমপ্লেন দিতে পারছি।’

আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন মাহদী আমিন। যৌথভাবে এ গোলটেবিলের আয়োজন করে প্রথম আলো ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।

বৈঠকে আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের পুলিশকে প্রশংসায় ভাসানোর আগে আওয়ামী লীগ আমল নিয়ে সমালোচনা করেন মাহদী আমিন। তখন বিএনপি সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘দেখা গেছে, বিএনপির অনেক নেতা আছে, যাদের নামে ৩০০, ৪০০ বা সাড়ে ৪০০ করে মামলা হচ্ছে। গায়েবি মামলা, যিনি মারা গিয়েছেন, ওনার নামেও মামলা হচ্ছে। বিদেশে আছেন, ওনার নামেও মামলা হচ্ছে।’

মাহদী আমিন বলেন, ‘হিউম্যান রাইটসের ক্ষেত্রে পুলিশের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল মানবাধিকার ধরে রাখা, তারাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল, একটা অংশ। বাক্‌স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বদলে বাক্‌স্বাধীনতা হরণ করেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে আইন লঙ্ঘন করেছে।’

আরও পড়ুনমাঝেমধ্যে শুনতে হয়, ‘উনি কি আমাদের লোক’: আইজিপি১ ঘণ্টা আগে

পুলিশকে ‘রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনের মত’ ব্যবহার বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেন তারেক রহমানের উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। ভবিষ্যতে যারা সরকারে আসবে, সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব তাদের। এর সঙ্গে জড়িত সব অংশীজনকেও পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।’

পুলিশের সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে মাহদী আমিন বলেন, ‘আমরা ও যারা ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসবে, কীভাবে আরও ডিগনিটি দেওয়া যায়, আরও রেসপেক্ট নিশ্চিত করা যায়, একটা সোশ্যাল মর্যাদা নিশ্চিত করা যায়, তার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

আরও পড়ুনগোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার না হলে পুলিশ সংস্কার অর্জিত হবে না: ইফতেখারুজ্জামান২ ঘণ্টা আগে

স্বাধীন পুলিশ কমিশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক মতৈক্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন মাহদী আমিন।

এই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতির সভাপতি এম আকবর আলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, পুলিশের অতিরিক্ত আইজি কাজী মো. ফজলুল করীমও বৈঠকে অংশ নেন।

আরও পড়ুন‘আমার লোক, তোমার লোক’ ব্যাধি থেকে দলগুলোকে বের হতে হবে: আসিফ নজরুল২ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পুলিশের এখনকার ভূমিকার প্রশংসায় বিএনপির মাহদী আমিন