পুরুষশূন্য বাড়েদাপাড়ায় আতঙ্ক, খোলা আকাশের নিচে ১৩ পরিবার
Published: 26th, May 2025 GMT
কর্দমাক্ত পথের গলিতে পোড়া মোটরসাইকেলের কঙ্কাল। অদূরে স্তূপ করা পুড়ে যাওয়া লেপ-তোশক, কাপড়-চোপড়। অন্যপাশে পুড়ে যাওয়া রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দেওয়া ঘরের পোড়া ছাউনি। ভেতরে পড়ে রয়েছে আধপোড়া স্টিলের থাল, বাসন, হাঁড়ি। বেশিরভাগ জিনিসই বুঝার উপায় নেই কি ছিল সেটা। পাশের দুই কক্ষের দোচালা টিনের ঘরের সব পুড়ে ছাই। টিনগুলো দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ঘরের ভেতরে অবশিষ্ট রয়েছে পোড়া ফ্রিজ, খাট, টেবিল, ফ্যান।
পুড়ে যাওয়া বাড়ির এমন দৃশ্যটি যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহরমশিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদা পাড়ার বিষ্ণু বিশ্বাস ও শিউলি বিশ্বাস দম্পত্তির। সনাতন ধর্মাবলম্বীর মতুয়া সম্প্রদায়ের এই বাড়িতে গত বৃহস্পতিবার রাতে দুবৃত্তরা হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। রাতের খাবার খেয়ে যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা তখন এমন ঘটনা ঘটে। বাড়িটিতে প্রথমে লুটপাট ও পরে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে দুটি ঘর, রান্নাঘরের সকল জিনিসপত্র পুড়ে ছাই। হামলা লুটপাটের ভয়বহতায় পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে তখন আশ্রয় নেয় পাশের বিলে। ফিরে এসে দেখেন বছরের পর বছর ধরে তিলে তিলে সাজানো সংসার পুরোটা পুড়ে ছাই। এই ঘটনার চারদিন পার হলেও আতঙ্কে এখনও ঘরে ফেরেনি বাড়ির পুরুষ সদস্যরা।
কেবল বিষ্ণু বিশ্বাস ও শিউলি বিশ্বাস দম্পত্তি নয়, এমন ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে বাড়েদা পাড়ার সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৩ পরিবারের ১৮টি ঘর। অগ্নিসংযোগের আগে এসব বাড়িতেও চলে লুটপাট।
স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘের লিজ নেওয়ার জন্য ডহরমশিয়াহাটির বাড়েদা পাড়াতে পিল্টু বিশ্বাসের বাড়ি যান। সেখানে চুক্তিপত্র করার সময় গোলযোগ হলে অজ্ঞাত ৭-৮ জন দুর্বৃত্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছে কুপিয়ে ও গুলি করে তরিকুলকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর রাতে নওয়াপাড়ার ধোপাদি এলাকার দিক থেকে আসা একদল দুর্বৃত্ত ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের অন্তত ১৩টি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া উপজেলার সুন্দলী বাজারে ৬টি দোকানে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করা হয়। এ সময় আহত হন অন্তত ১০ জন। এরপর পাড়াটির লোকজন ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নেয় দূরের বিল ও ঝোপঝাড়ে। সেখান থেকে দেখতে পান তাদের বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে। সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন ধানের গোলা, বসত ঘর, রান্না ঘর, গোয়াল ঘর, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তারা।
এদিকে এই ঘটনার চারদিন পর সোমবার বিকেলে নিহত তরিকুল ইসলামের ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু ১১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে পিল্টু বিশ্বাসকে। পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতেই খুন হন তরিকুল। এছাড়া বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।
তবে ঘটনার পর এখনও কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে পুরো এলাকাটি। পুড়ে যাওয়া বাড়ির নারী সদস্যরা এখনও আতঙ্কিত। তবে নতুন করে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
তরিকুল উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। তিনি উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন।
সোমবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, চারিদিকে ঘরবাড়ির জিনিসপত্রগুলো পুড়ে ছাই। কারও বাড়ির ঘরের ইট আছে শুধু, ঘরের ছাউনি, তার ভিতরে জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাড়াটিতে বেশিরভাগ বাড়ি পুরুষশূন্য। আত্মীয় স্বজনেরা দলবেঁধে খাবার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে আসছেন দেখতে। পাড়াটিতে চারদিন ধরেই বিদ্যুৎ নেই। কোনো কোনো বাড়িতে চুলা জ্বলেনি। নিরাপত্তার জন্য মোড়ে মোড়ে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মাঝে মাঝে আসছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। তারপরও আতঙ্ক কাটেনি মতুয়া সম্প্রদায়ের এই পাড়াটিতে। কয়েকদিন ধরে অবরত বৃষ্টি ঝরছে, তার মধ্যে কেউ গোয়াল ঘরে, কারোও ঠাঁই হয়েছে স্বজনের বাড়িতে।
শিউলি বিশ্বাস বলেন, ঘরে টিভি, ফ্রিজ, সোনাদানা, পাসপোর্ট, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, নগদ দেড় লাখ টাকা ছিল। এখন আর কিছুই নেই। শুধু বাড়ির ছয়টি মানুষ বেঁচে আছি।
স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, প্রথমে লোকজন এসে ঘরে ঢুকে সোনাদানা, টাকাপয়সা লুট করেছে। তারা আমাকে বেদম মারধর করেছে। এরপর আমাকে লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, অসহায় জীবন-যাপন করছি। ঘরের কিছু নেই যে, শরীরে জড়াবো। রান্না করবো, জায়গা নেই। বৃষ্টিতে আশ্রয় নিচ্ছি গোয়াল ঘরে।
‘পুলিশ প্রশাসন আসলেও রাত হলি আতঙ্ক বাড়ে। এই বুঝি আবার হামলা হলো, বলেন তিনি। প্রশাসন টাকা, টিন দিলেও কি আমার সাজানো-ঘোছানো সংসার ফিরো পাবো বলেও প্রশ্ন তুলেন এই নারী।
ঘের নয় রাজনৈতিক বিরোধে খুন
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের বিল বোকড়ে তরিকুলের একটি মাছের ঘের ছিল। ঘেরটির জমির ইজারার মেয়াদ শেষ হয়েছে। পাশের বিল কাছুরাবাদে অন্য এক ব্যক্তির আরেকটি মাছের ঘের ছিল। বিল কাছুরাবাদের বেশিরভাগ জমি ডহর মশিয়াহাটী গ্রামবাসীর। ঘেরের জমির ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মালিক ঘের ছেড়ে দিয়েছেন। এই ঘেরের জমি ইজারা নিয়ে তরিকুল ইসলাম মাছ চাষ করতে চেয়েছিলেন। অন্য আরেক ব্যক্তিও ওই ঘেরের জমি ইজারা নিয়ে মাছ করতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে তরিকুল ইসলামের বিরোধ হয়। বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলামকে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে প্রথমে কুপিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ নিহতের ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু।
তিনি বলেন, ঘের নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব নেই। প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকাণ্ড মনে করলেও রাজনৈতিক কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যেহেতু এটা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা। আমার ভাই বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য করে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তৃতীয় পক্ষ বিষয়টি ঘুরিয়ে দিতে নিরীহ হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। তারপরেও বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টিএস আইয়ূব সোমবার ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজ খবর নেন। এসময় তিনি বলেন, খুলনা বিভাগীয় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ ঘটনা জানার পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি।
খোলা আকাশের নিচে ১৩ পরিবার
বাড়েদাপাড়ার অধিকাংশ মতুয়া সম্প্রদায়ের। ক্ষোভের আগুনে দেওয়া বাড়িঘর পুড়ে ভস্মীভূত। ঘরের চার দেয়াল থাকলেও পুড়ে ছাই ছাউনি। ফলে খোলা আকাশের নিচে গত তিন দিন পার করছেন পাড়াটির বাসিন্দারা। সোমবার দিনভর বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে পার করেছেন।
চণ্ডিকা বিশ্বাস জানান, গায়ে কাপড় ছাড়া কিছু নেই। ঘরের সবকিছু পুড়ে গেছে। ঘরবাড়িতে থাকার মতো অবস্থা নেই। গাছের পাতাও পুড়ে গেছে। আমরা আতঙ্কে আছি। পাড়া পুরুষশূন্য। আমরা নিরপরাধ। যারা আমাদের ক্ষতি করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা
পাড়াটিতে পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২৪ ঘণ্টা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন তারা। যেহেতু বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনীতিক দল বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন, ফলে অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন না বলে জানিয়েছেন জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি দিপাঙ্কর দাস রতন। এছাড়া গত শনিবার ও রোববার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢেউ টিন, শাড়ি-লুঙ্গি ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
পুলিশ যা বলছেন
এ ঘটনা রাজনৈতিক কোন ঘটনা নয় বলে দাবি করেছেন অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কিছু রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছি। আসামিদের দ্রুত আটকে অভিযান চলছে। এই ঘটনায় সোমবার বিকেলে মামলা করেছেন। নিহতের পরিবারের সদস্যদের আসামিদের চিহ্নিত করতে দেরি হওয়াতে মামলায় বিলম্ব হয়েছে। গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সার্বক্ষণিক টহল জোরদার করা হয়েছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: যশ র ক ষকদল ন হত পর ব র র র জন ত ক ব যবস থ উপজ ল র এই ঘটন স মব র ল টপ ট কর ছ ন ঘটন র র সদস আতঙ ক ব ষয়ট এ ঘটন করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারের ভেতরে একটা অংশ নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে: এনসিপি
সরকারের ভেতরের একটি পক্ষ ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বাইরে গিয়ে নিজেরাই ঐকমত্য কমিশন হওয়ার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, এই চেষ্টার কারণে নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে।
আজ সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আখতার হোসেন এ কথা বলেন।
আখতার হোসেন বলেন, তাঁদের কাছে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে সরকারের ভেতরের কোনো একটা অংশ সংস্কারকে ভন্ডুল করে নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতেই কমিশন সুপারিশ উপস্থাপন করেছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্যসচিব বলেন, সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই সরকার আদেশ জারি করবে, সেটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যখন সরকারের তরফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আরও এক সপ্তাহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাপ–আলোচনার কথা বলা হয়, তখন মনে হয় যে সরকার আসলে এই সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে সাপ-লুডো খেলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ৯৬-তে পৌঁছে গিয়েছিলাম, সেটাকে আবার তিনে নিয়ে আসা হয়েছে সাপ কেটে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।’
অতি দ্রুত সরকারকে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে এনসিপির সদস্যসচিব বলেন, সরকারকে নিজেকেই দায়িত্ব নিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। সামনের সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা প্রদান করার মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গণভোটের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের অভিপ্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন বাস্তবায়িত হয়, সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।