বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নদ–নদীবিষয়ক ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন (ইসিই) কর্তৃক প্রণীত ১৯৯২ সালের সনদে স্বাক্ষর করেছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে এমন তথ্য জানা যাচ্ছে। সূচনায় সনদটি কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য ছিল। ২০০৩ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে একে ইউরোপবহির্ভূত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

এই সুযোগ ব্যবহার করে ইউরোপের বাইরের যেসব দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে, সেগুলো হলো ক্যামেরুন, চাদ, ঘানা, গিনি-বিসাউ, সেনেগাল, টোগো, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান। এখন বাংলাদেশ এ তালিকায় যুক্ত হবে, যদি এ সনদ স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত দেশের ভবিষ্যৎ সংসদ দ্বারা অনুমোদিত হয়।

২.

ইউরোপীয় কমিশনের ১৯৯২ সালের সনদটি মূলত আন্তর্জাতিক নদ–নদীর দূষণবিষয়ক। এর মূল লক্ষ্য হলো ‘দূষণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস’।

সনদে বলা হয় যে কাজটি করতে হবে দূষণের উৎসে এবং তা এমনভাবে করতে হবে, যাতে এক দেশ কর্তৃক সাধিত দূষণ কোনো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উপায়ে অন্য দেশে না পৌঁছায়।

এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ সনদে বিস্তারিত নীতিমালা ও পথপদ্ধতি বিধৃত হয়েছে। ইসিইর এই সনদে আন্তর্জাতিক নদ–নদীর পানির ‘যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত ব্যবহার’ এবং ‘পরিবেশের সুরক্ষা ও প্রয়োজনবোধে পুনরুজ্জীবনের’ কথাও বলা হয়। তবে এসব বিষয়ে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রস্তাবিত হয় না। মূল মনোযোগ দূষণ হ্রাসের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে।

৩.

সীমান্ত অতিক্রমকারী দূষণ বাংলাদেশের নদ–নদীর জন্যও একটি সমস্যা। গঙ্গা পৃথিবীর একটি অন্যতম দূষিত নদী। শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষি ও মনুষ্যবর্জ্য ছাড়াও এই নদীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ও গবাদিপশুর মরদেহ নিক্ষিপ্ত হয়, যা দূষণ বৃদ্ধি করে। এই দূষিত পানি নিয়েই গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

উত্তর–পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উত্তোলন বৃদ্ধির কারণে এই রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদ–নদীর পানির দূষণও বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীর দূষণ মোকাবিলার জন্য ইসিইর ১৯৯২ সালের সনদ স্বাক্ষর করা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

তবে বাংলাদেশের জন্য দূষণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্তর্জাতিক নদ–নদীর প্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের সমস্যা। উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত নদ–নদীর পানি অপসারণ করছে এবং এ কারণে বাংলাদেশে নদ–নদীর প্রবাহ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে (বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে)।

■ উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত নদ–নদীর পানি অপসারণ করছে এবং তার ফলে বাংলাদেশে নদ–নদীর প্রবাহ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ■ এটা স্পষ্ট যে ১৯৯৭ সালের সনদ অভিন্ন নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশ স্বার্থের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থন পাবে, তাই অবিলম্বে বাংলাদেশের এটি স্বাক্ষর করা উচিত।

ফারাক্কা বাঁধ ও উজানে আরও বহু স্থাপনা নির্মাণের কারণে শীতকালে বাংলাদেশে গঙ্গার পানি এখন ‘ন্যূনতম পরিবেশ রক্ষামূলক প্রবাহের’ নিচে চলে যায়। এ কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমের নদ–নদীগুলো গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে বর্ষাকালেও এই সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয় না।

গঙ্গার প্রবাহ হ্রাসের কারণে সুন্দরবন এখন হুমকির মুখে। ইউনেসকোর ‘বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যে’র একাধিক পর্যবেক্ষণ দল এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

উত্তরবঙ্গে তিস্তা নদীর প্রবাহ নিয়েও ভারত একই আচরণ করছে। এই নদীর ওপর ভারত কর্তৃক নির্মিত গজলডোবা এবং অন্যান্য বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা নদী প্রায় সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়।

আরও পড়ুনআন্তর্জাতিক পানি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের বাধা কোথায় ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪৪.

আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ অভিমুখে সরিয়ে নেওয়ায় ব্যাপৃত। অথচ গঙ্গার প্রবাহ হ্রাসের কারণে এখন বাংলাদেশের নদ–নদীর প্রায় ৭০ শতাংশ প্রবাহ ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল। পূর্ব দিকে টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে মেঘনা নদীর প্রবাহ হ্রাসের প্রচেষ্টা গৃহীত হচ্ছে।

গবেষকদের মতে, ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা ৫৪টি নদ–নদীর প্রায় প্রতিটির ওপরই ভারত প্রবাহ অপসারণ কিংবা নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো নির্মাণ করেছে অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। ভারতের এ আচরণের কারণে বাংলাদেশের নদ–নদীর ক্ষতিকর বিকৃতিও সাধিত হচ্ছে।

শীতকালে শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে নদীর তলদেশের কাঠিন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে বর্ষাকালে নদী খাত ততটা গভীর হতে পারে না এবং নদী বরং পাড় ভাঙে। ফলে একদিকে নদ–নদী অগভীর হচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রশস্ত হচ্ছে। কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে ও নদীভাঙনে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে।

কাজেই ভারতের কাছ থেকে নদ–নদীর প্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রতিই বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সে জন্য দরকার আন্তর্জাতিক নদ–নদীসংক্রান্ত জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদে স্বাক্ষর করা।

৫.

১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইন সমিতির ৫২তম সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদ–নদীসংক্রান্ত ‘হেলসিংকি বিধান’ গৃহীত হয়েছিল। প্রয়োজনের তুলনায় এই বিধান সামগ্রিক বিবেচিত না হওয়ায় ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নদ–নদীর ব্যবহারসংক্রান্ত ৩৭টি ধারা সম্পন্ন সনদ প্রণয়ন করে। পর্যাপ্তসংখ্যক দেশ কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে এ সনদ কার্যকারিতা পায়।

জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদ নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের অধিকারকে অনেক সুনির্দিষ্ট রূপ দেয়। যেমন এই সনদের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয় যে ‘কোনো দেশ কর্তৃক আন্তর্জাতিক নদ–নদী ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অংশীদার অন্যান্য দেশের যাতে কোনো প্রণিধানযোগ্য ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি এরূপ কোনো ক্ষতি সাধিত হয়, তবে দায়ী দেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ক্ষতিপূরণ প্রদানসমেত অন্যান্য এমন ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবে, যাতে এই ক্ষতি পূরিত হয়।’

এ ক্ষয়ক্ষতি বিচারে যেসব বিষয় আমলে নিতে হবে, এর একটি বিস্তারিত তালিকা এই সনদের ৬ নম্বর ধারা প্রদান করে। সেখানে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়, তার মধ্যে রয়েছে (ভাটির) দেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদা’, ‘নদীর ওপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা’ ও নদ–নদীর ‘প্রচলিত, বিদ্যমান ও সম্ভাব্য ব্যবহার’। 

১৯৯৭ সালের সনদ অংশীদার সব দেশকে আলাদাভাবে এবং যেখানে প্রযোজ্য, যৌথভাবে আন্তর্জাতিক নদ–নদীর বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা ও যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করে (ধারা ২০)। সনদ ব্যাখ্যা দেয় যে নদ–নদীর বাস্তুতন্ত্র বলতে নদ–নদীর মোহনা ও সমুদ্র উপকূলকে অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করতে হবে (ধারা ২৩)। 

৬.

এ সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে ১৯৯৭ সালের সনদ বাংলাদেশের জন্য অনুকূল। এই সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধনকারী ভারতের ফারাক্কা কিংবা গজলডোবা বাঁধ মোটেও সিদ্ধ নয়।

আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপসারণের ভারতীয় তৎপরতাও এই সনদবিরোধী। গঙ্গার পানি অপসারণের মাধ্যমে সুন্দরবনের যে অবক্ষয় ভারত ডেকে এনেছে, সেটাও এ সনদের পরিপন্থী।

সর্বোপরি আবহমানকাল ধরে নদ–নদীর যেসব ‘প্রচলিত ও বিদ্যমান ব্যবহার’ বাংলাদেশের জনগণ করে আসছিলেন, সেগুলোর ক্ষতিসাধনকারী কোনো কাজ ভারত করতে পারে না।

নদ–নদীবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির উপায়ও ১৯৯৭ সালের সনদে অন্তর্ভুক্ত হয় (ধারা ৩৩)। বলা হয় যে যদি বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হতে না পারে, তবে তারা নিম্নরূপ তিন উপায়ের যেকোনোটি বেছে নিতে পারে। 

প্রথমত, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে কোনো তৃতীয় পক্ষকে মধ্যস্থতা কিংবা সালিস করার জন্য অনুরোধ করতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, তাদের দ্বারা গঠিত পানিবিষয়ক কোনো যৌথ প্রতিষ্ঠানের সহায়তা গ্রহণ করতে পারে। 

তৃতীয়ত, ‘আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের’ শরণাপন্ন হতে পারে।

কাজেই এটা স্পষ্ট, ১৯৯৭ সালের সনদ অভিন্ন নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশ স্বার্থের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থন পাবে, তাই অবিলম্বে বাংলাদেশের এতে স্বাক্ষর করা উচিত।

ভারত চায় বাংলাদেশকে কেবল দ্বিপক্ষীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রাখতে। তবে পরিতাপের বিষয় যে এই দ্বিপক্ষীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ নদ–নদী বিষয়ে স্বীয় স্বার্থরক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো সাফল্য অর্জন করেনি। বস্তুত এ কাঠামো এখন বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক কদাচিৎ অনুষ্ঠিত হয়।৭.

একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, যেহেতু ভারত ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষর করেনি এবং আপাতদৃষ্টে চায় না যে উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশ এতে স্বাক্ষর করুক, সেহেতু বাংলাদেশের পক্ষে এ সনদে স্বাক্ষর করে ভারতের বিরাগ বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না। যদি এটাই যুক্তি হয়, তাহলে বাংলাদেশ ইসিইর ১৯৯২ সালের সনদে স্বাক্ষর করতে গেল কেন? ভারত তো এই সনদেও স্বাক্ষর করেনি!

আসলে ভারতের ইচ্ছা বা অভিরুচি দ্বারা বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারিত হওয়া সংগত নয়। ভারত যেমন তার স্বার্থ দেখে, বাংলাদেশকেও তেমনি নিজের স্বার্থ দেখতে হবে। উজান অবস্থানের সুযোগে ভারত নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারছে। তাই ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে সে নিজের ওপর বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে চায় না। একই কারণে ভারত নদ–নদী বিষয়ে নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্তকারী কোনো বহুপক্ষীয় আলোচনায়ও রাজি নয়।

ভারত চায় বাংলাদেশকে কেবল দ্বিপক্ষীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রাখতে। তবে পরিতাপের বিষয় যে এই দ্বিপক্ষীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ নদ–নদী বিষয়ে স্বীয় স্বার্থরক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো সাফল্য অর্জন করেনি। বস্তুত এ কাঠামো এখন বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক কদাচিৎ অনুষ্ঠিত হয়।

৮.

এটা গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৯৭ সালের সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সনদে প্রদত্ত সুরক্ষাগুলো ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়ও ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশ দেখাতে পারে যে নদ–নদীবিষয়ক তার দাবিগুলো কোনো অযৌক্তিক অভিলাষ নয়, বরং আন্তর্জাতিক সনদ দ্বারা স্বীকৃত ও সমর্থিত।

দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে স্বীয় অবস্থানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এ সনদে প্রদত্ত অধিকারগুলো ব্যবহার করতে পারে। 

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশকেও এই সনদ স্বাক্ষরে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে এ অঞ্চলের নদ–নদীবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি সর্বসম্মত আইনগত ভিত্তি সৃষ্টি হয়।

১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষরের জন্য ভারতের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তিব্বতে চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের পানি অপসারণের হুমকি সম্ভবত একসময় ভারতেরও চক্ষু উন্মীলিত করবে।

লক্ষণীয়, ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের যেমন কিছু সুবিধা আছে, তেমনি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানেরও কিছু সুবিধা আছে। সে কারণে প্রায় এক যুগ আগে আমি ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলা উত্থাপন করেছিলাম। (দ্রষ্টব্য, লেখকের পুস্তিকা নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের চাবিকাঠি, ২০১৪)।

সম্প্রতি বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য ট্রানজিট–সুবিধা বাতিল করার মাধ্যমে ভারতই প্রমাণ করেছে যে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি সুযোগ বিনিময়যোগ্য ও শর্তসাপেক্ষ হতে পারে। এখন গঙ্গাচুক্তি নবায়নের সময় ঘনিয়ে আসছে। তিস্তা সংকটও প্রকট হয়ে পড়েছে। স্থিতাবস্থা বজায় রেখে নদী বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের সুরক্ষা দেখা কঠিন। এ বিষয়ে অগ্রগতির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষরই প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।

নজরুল ইসলাম  অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নদ নদ র প ন নদ নদ র প র ব যবহ র কর অবস থ ন র নদ র ওপর অন য ন য র ওপর ব র নদ নদ ত নদ নদ নদ র ব স রক ষ র জন য কর ত ক এখন ব এ সনদ ইউর প র করত

এছাড়াও পড়ুন:

মালয়েশিয়ায় রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা আটকে আছে শুল্ক বাধায়

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার। আট লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন দেশটিতে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও তাতে বাংলাদেশের হিস্যা অনেক কম। বিশেষ করে উচ্চ শুল্ক বাধার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আশানুরূপ বাড়ছে না।

বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াকে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। অথচ ভারত, চীন ও পাকিস্তানের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো শুল্কমুক্ত বা কম শুল্ক–সুবিধায় দেশটিতে পণ্য রপ্তানি করছে। কারণ, এসব দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ রয়েছে।

এফটিএ না থাকায় মালয়েশিয়াতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছেন। এ জন্য তাঁরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশটির সঙ্গে এফটিএ করার দাবি জানিয়েছেন।

২৮০ কোটি ডলারের বাণিজ্য

বর্তমানে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে মোট দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৮০ কোটি মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ২৫–৩০ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট বাণিজ্যের মাত্র ৮-১০ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্যে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে তেল (বিশেষত পাম তেল), ইলেকট্রনিকস ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক ও সার, নির্মাণসামগ্রী ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে মালয়েশিয়া। আর বাংলাদেশ থেকে মূলত তৈরি পোশাক, বিভিন্ন ধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য এবং ভোক্তাসামগ্রী রপ্তানি হয় মালয়েশিয়াতে। বাংলাদেশের প্রাণ গ্রুপ, স্কয়ার, আকিজ গ্রুপ, ওয়ালটন, মুন্নু সিরামিকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতের বিভিন্ন কোম্পানি দেশটিতে পণ্য রপ্তানি করে।

তবে মালয়েশিয়ার ভোক্তা বাজার অনেক বড়। সঠিক নীতি গ্রহণ করলে এই বাজারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। মালয়েশিয়ার পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোকের বাস। এ ছাড়া দেশটিতে ২১ লাখের বেশি বিদেশি কর্মী রয়েছেন, যার প্রায় ৩৮ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি (৮ লাখের বেশি)।

হালাল পণ্যের বৃহৎ বাজার

মালয়েশিয়ার বহির্মুখী বাণিজ্য উন্নয়ন করপোরেশনের (ম্যাট্রেড) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে হালাল খাদ্যপণ্যের বাজার প্রায় ৫ হাজার কোটি (৫০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি। এসব পণ্যের চাহিদা মেটাতে দেশটি ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি (২০ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করে।

বাংলাদেশও দেশটিতে হালাল পণ্য রপ্তানি শুরু করেছে। তবে এখনো তা পরিমাণে খুব কম, মাত্র ৪ থেকে ৫ কোটি ডলারের আশপাশে। বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, শুধু শুল্ক বাধা দূর করা গেলেই দেশটিতে ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলারের হালাল পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ হালাল পণ্যের রপ্তানি বাড়বে পাঁচ গুণ।

মালয়েশিয়ায় স্থানীয় সরবরাহকারী কোম্পানির (পিনাকেল ফুডস) মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশের শীর্ষ কোম্পানি প্রাণ গ্রুপ। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে মসলা, নুডলস, জুস, ড্রিংকস, বিস্কুট, কুকিজ প্রভৃতি। গত চার দিনে মালয়েশিয়ার অন্তত ছয়টি বড় বড় শপিং মল ও সুপারমার্কেট ঘুরে সবগুলোতে প্রাণের পণ্য দেখা গেছে। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন মুদিদোকানেও প্রাণ ব্র্যান্ডের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে।

প্রাণের কর্মকর্তারা জানান, মালয়েশিয়ার মানুষ নুডলস, বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাকস, ফ্রোজেন খাদ্যপণ্য, বিস্কুট, জুস, বেভারেজ প্রভৃতি পছন্দ করেন। এ ছাড়া সেখানে প্রচুর প্রবাসী বাংলাদেশিও রয়েছেন। এটি তাদের জন্য বড় সুযোগ।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাধা দেশটির সঙ্গে কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি না থাকা। এ কারণে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। আমরা যদি বিনা শুল্কে প্রাণের পণ্য রপ্তানির সুযোগ পাই, তবে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজার ধরতে পারব। এতে দেশটিতে শুধু প্রাণের পণ্যের রপ্তানিই পাঁচ গুণ বাড়বে বলে আমরা আশা করি।’

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মাহবুব আলম শাহ বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি থাকায় তারা বাজার দখল করছে। এ বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ৩০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে টিকে থাকা কঠিন।’

বাণিজ্য চুক্তির অগ্রগতি কম

মালয়েশিয়ার সঙ্গে প্রায় এক দশক ধরে এফটিএ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেটি এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে ওঠেনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা গতি এসেছে।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, বর্তমানে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ভারত, পাকিস্তানসহ প্রায় ১৪টি দেশের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) রয়েছে। গত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ করার জন্য নানা সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে মালয়েশিয়া সফর করেন। এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়েছে।

দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি এফটিএ নিয়ে দর–কষাকষির জন্য একটি টার্মস অব রেফারেন্সের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এটির অনুমোদন হলে উভয় পক্ষ আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসতে পারে।

মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার (উপহাইকমিশনার) মোসাম্মাত শাহানারা মনিকা বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় আমাদের বাজার সম্ভাবনা প্রচুর, কিন্তু শুল্ক ও বিধিনিষেধের সহজীকরণ ছাড়া টিকে থাকা কঠিন।’ তিনি জানান, এফটিএ নিয়ে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হতে পারে।

শাহানারা মনিকা আরও বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রপ্তানি বাড়াতে হলে এফটিএর বিকল্প নেই। তবে পণ্যের পাশাপাশি সেবা খাতের মাধ্যমেও বাণিজ্য–ঘাটতি পূরণের সুযোগ রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ