নদীবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরে আমাদের বাধা কোথায়
Published: 20th, June 2025 GMT
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নদ–নদীবিষয়ক ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন (ইসিই) কর্তৃক প্রণীত ১৯৯২ সালের সনদে স্বাক্ষর করেছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে এমন তথ্য জানা যাচ্ছে। সূচনায় সনদটি কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য ছিল। ২০০৩ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে একে ইউরোপবহির্ভূত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
এই সুযোগ ব্যবহার করে ইউরোপের বাইরের যেসব দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে, সেগুলো হলো ক্যামেরুন, চাদ, ঘানা, গিনি-বিসাউ, সেনেগাল, টোগো, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান। এখন বাংলাদেশ এ তালিকায় যুক্ত হবে, যদি এ সনদ স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত দেশের ভবিষ্যৎ সংসদ দ্বারা অনুমোদিত হয়।
২.ইউরোপীয় কমিশনের ১৯৯২ সালের সনদটি মূলত আন্তর্জাতিক নদ–নদীর দূষণবিষয়ক। এর মূল লক্ষ্য হলো ‘দূষণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস’।
সনদে বলা হয় যে কাজটি করতে হবে দূষণের উৎসে এবং তা এমনভাবে করতে হবে, যাতে এক দেশ কর্তৃক সাধিত দূষণ কোনো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উপায়ে অন্য দেশে না পৌঁছায়।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ সনদে বিস্তারিত নীতিমালা ও পথপদ্ধতি বিধৃত হয়েছে। ইসিইর এই সনদে আন্তর্জাতিক নদ–নদীর পানির ‘যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত ব্যবহার’ এবং ‘পরিবেশের সুরক্ষা ও প্রয়োজনবোধে পুনরুজ্জীবনের’ কথাও বলা হয়। তবে এসব বিষয়ে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রস্তাবিত হয় না। মূল মনোযোগ দূষণ হ্রাসের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে।
৩.সীমান্ত অতিক্রমকারী দূষণ বাংলাদেশের নদ–নদীর জন্যও একটি সমস্যা। গঙ্গা পৃথিবীর একটি অন্যতম দূষিত নদী। শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষি ও মনুষ্যবর্জ্য ছাড়াও এই নদীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ও গবাদিপশুর মরদেহ নিক্ষিপ্ত হয়, যা দূষণ বৃদ্ধি করে। এই দূষিত পানি নিয়েই গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
উত্তর–পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উত্তোলন বৃদ্ধির কারণে এই রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদ–নদীর পানির দূষণও বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীর দূষণ মোকাবিলার জন্য ইসিইর ১৯৯২ সালের সনদ স্বাক্ষর করা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তবে বাংলাদেশের জন্য দূষণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্তর্জাতিক নদ–নদীর প্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের সমস্যা। উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত নদ–নদীর পানি অপসারণ করছে এবং এ কারণে বাংলাদেশে নদ–নদীর প্রবাহ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে (বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে)।
■ উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত নদ–নদীর পানি অপসারণ করছে এবং তার ফলে বাংলাদেশে নদ–নদীর প্রবাহ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ■ এটা স্পষ্ট যে ১৯৯৭ সালের সনদ অভিন্ন নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশ স্বার্থের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থন পাবে, তাই অবিলম্বে বাংলাদেশের এটি স্বাক্ষর করা উচিত।ফারাক্কা বাঁধ ও উজানে আরও বহু স্থাপনা নির্মাণের কারণে শীতকালে বাংলাদেশে গঙ্গার পানি এখন ‘ন্যূনতম পরিবেশ রক্ষামূলক প্রবাহের’ নিচে চলে যায়। এ কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমের নদ–নদীগুলো গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে বর্ষাকালেও এই সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয় না।
গঙ্গার প্রবাহ হ্রাসের কারণে সুন্দরবন এখন হুমকির মুখে। ইউনেসকোর ‘বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যে’র একাধিক পর্যবেক্ষণ দল এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
উত্তরবঙ্গে তিস্তা নদীর প্রবাহ নিয়েও ভারত একই আচরণ করছে। এই নদীর ওপর ভারত কর্তৃক নির্মিত গজলডোবা এবং অন্যান্য বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা নদী প্রায় সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়।
আরও পড়ুনআন্তর্জাতিক পানি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের বাধা কোথায় ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪৪.আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ অভিমুখে সরিয়ে নেওয়ায় ব্যাপৃত। অথচ গঙ্গার প্রবাহ হ্রাসের কারণে এখন বাংলাদেশের নদ–নদীর প্রায় ৭০ শতাংশ প্রবাহ ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল। পূর্ব দিকে টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে মেঘনা নদীর প্রবাহ হ্রাসের প্রচেষ্টা গৃহীত হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা ৫৪টি নদ–নদীর প্রায় প্রতিটির ওপরই ভারত প্রবাহ অপসারণ কিংবা নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো নির্মাণ করেছে অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। ভারতের এ আচরণের কারণে বাংলাদেশের নদ–নদীর ক্ষতিকর বিকৃতিও সাধিত হচ্ছে।
শীতকালে শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে নদীর তলদেশের কাঠিন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে বর্ষাকালে নদী খাত ততটা গভীর হতে পারে না এবং নদী বরং পাড় ভাঙে। ফলে একদিকে নদ–নদী অগভীর হচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রশস্ত হচ্ছে। কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে ও নদীভাঙনে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে।
কাজেই ভারতের কাছ থেকে নদ–নদীর প্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রতিই বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সে জন্য দরকার আন্তর্জাতিক নদ–নদীসংক্রান্ত জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদে স্বাক্ষর করা।
৫.১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইন সমিতির ৫২তম সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদ–নদীসংক্রান্ত ‘হেলসিংকি বিধান’ গৃহীত হয়েছিল। প্রয়োজনের তুলনায় এই বিধান সামগ্রিক বিবেচিত না হওয়ায় ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নদ–নদীর ব্যবহারসংক্রান্ত ৩৭টি ধারা সম্পন্ন সনদ প্রণয়ন করে। পর্যাপ্তসংখ্যক দেশ কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে এ সনদ কার্যকারিতা পায়।
জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদ নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের অধিকারকে অনেক সুনির্দিষ্ট রূপ দেয়। যেমন এই সনদের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয় যে ‘কোনো দেশ কর্তৃক আন্তর্জাতিক নদ–নদী ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অংশীদার অন্যান্য দেশের যাতে কোনো প্রণিধানযোগ্য ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি এরূপ কোনো ক্ষতি সাধিত হয়, তবে দায়ী দেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ক্ষতিপূরণ প্রদানসমেত অন্যান্য এমন ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবে, যাতে এই ক্ষতি পূরিত হয়।’
এ ক্ষয়ক্ষতি বিচারে যেসব বিষয় আমলে নিতে হবে, এর একটি বিস্তারিত তালিকা এই সনদের ৬ নম্বর ধারা প্রদান করে। সেখানে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়, তার মধ্যে রয়েছে (ভাটির) দেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদা’, ‘নদীর ওপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা’ ও নদ–নদীর ‘প্রচলিত, বিদ্যমান ও সম্ভাব্য ব্যবহার’।
১৯৯৭ সালের সনদ অংশীদার সব দেশকে আলাদাভাবে এবং যেখানে প্রযোজ্য, যৌথভাবে আন্তর্জাতিক নদ–নদীর বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা ও যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করে (ধারা ২০)। সনদ ব্যাখ্যা দেয় যে নদ–নদীর বাস্তুতন্ত্র বলতে নদ–নদীর মোহনা ও সমুদ্র উপকূলকে অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করতে হবে (ধারা ২৩)।
৬.এ সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে ১৯৯৭ সালের সনদ বাংলাদেশের জন্য অনুকূল। এই সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধনকারী ভারতের ফারাক্কা কিংবা গজলডোবা বাঁধ মোটেও সিদ্ধ নয়।
আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপসারণের ভারতীয় তৎপরতাও এই সনদবিরোধী। গঙ্গার পানি অপসারণের মাধ্যমে সুন্দরবনের যে অবক্ষয় ভারত ডেকে এনেছে, সেটাও এ সনদের পরিপন্থী।
সর্বোপরি আবহমানকাল ধরে নদ–নদীর যেসব ‘প্রচলিত ও বিদ্যমান ব্যবহার’ বাংলাদেশের জনগণ করে আসছিলেন, সেগুলোর ক্ষতিসাধনকারী কোনো কাজ ভারত করতে পারে না।
নদ–নদীবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির উপায়ও ১৯৯৭ সালের সনদে অন্তর্ভুক্ত হয় (ধারা ৩৩)। বলা হয় যে যদি বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হতে না পারে, তবে তারা নিম্নরূপ তিন উপায়ের যেকোনোটি বেছে নিতে পারে।
প্রথমত, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে কোনো তৃতীয় পক্ষকে মধ্যস্থতা কিংবা সালিস করার জন্য অনুরোধ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তাদের দ্বারা গঠিত পানিবিষয়ক কোনো যৌথ প্রতিষ্ঠানের সহায়তা গ্রহণ করতে পারে।
তৃতীয়ত, ‘আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের’ শরণাপন্ন হতে পারে।
কাজেই এটা স্পষ্ট, ১৯৯৭ সালের সনদ অভিন্ন নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশ স্বার্থের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থন পাবে, তাই অবিলম্বে বাংলাদেশের এতে স্বাক্ষর করা উচিত।
ভারত চায় বাংলাদেশকে কেবল দ্বিপক্ষীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রাখতে। তবে পরিতাপের বিষয় যে এই দ্বিপক্ষীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ নদ–নদী বিষয়ে স্বীয় স্বার্থরক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো সাফল্য অর্জন করেনি। বস্তুত এ কাঠামো এখন বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক কদাচিৎ অনুষ্ঠিত হয়।৭.একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, যেহেতু ভারত ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষর করেনি এবং আপাতদৃষ্টে চায় না যে উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশ এতে স্বাক্ষর করুক, সেহেতু বাংলাদেশের পক্ষে এ সনদে স্বাক্ষর করে ভারতের বিরাগ বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না। যদি এটাই যুক্তি হয়, তাহলে বাংলাদেশ ইসিইর ১৯৯২ সালের সনদে স্বাক্ষর করতে গেল কেন? ভারত তো এই সনদেও স্বাক্ষর করেনি!
আসলে ভারতের ইচ্ছা বা অভিরুচি দ্বারা বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারিত হওয়া সংগত নয়। ভারত যেমন তার স্বার্থ দেখে, বাংলাদেশকেও তেমনি নিজের স্বার্থ দেখতে হবে। উজান অবস্থানের সুযোগে ভারত নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারছে। তাই ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে সে নিজের ওপর বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে চায় না। একই কারণে ভারত নদ–নদী বিষয়ে নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্তকারী কোনো বহুপক্ষীয় আলোচনায়ও রাজি নয়।
ভারত চায় বাংলাদেশকে কেবল দ্বিপক্ষীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রাখতে। তবে পরিতাপের বিষয় যে এই দ্বিপক্ষীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ নদ–নদী বিষয়ে স্বীয় স্বার্থরক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো সাফল্য অর্জন করেনি। বস্তুত এ কাঠামো এখন বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক কদাচিৎ অনুষ্ঠিত হয়।
৮.এটা গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৯৭ সালের সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সনদে প্রদত্ত সুরক্ষাগুলো ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়ও ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশ দেখাতে পারে যে নদ–নদীবিষয়ক তার দাবিগুলো কোনো অযৌক্তিক অভিলাষ নয়, বরং আন্তর্জাতিক সনদ দ্বারা স্বীকৃত ও সমর্থিত।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে স্বীয় অবস্থানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এ সনদে প্রদত্ত অধিকারগুলো ব্যবহার করতে পারে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশকেও এই সনদ স্বাক্ষরে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে এ অঞ্চলের নদ–নদীবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি সর্বসম্মত আইনগত ভিত্তি সৃষ্টি হয়।
১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষরের জন্য ভারতের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তিব্বতে চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের পানি অপসারণের হুমকি সম্ভবত একসময় ভারতেরও চক্ষু উন্মীলিত করবে।
লক্ষণীয়, ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের যেমন কিছু সুবিধা আছে, তেমনি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানেরও কিছু সুবিধা আছে। সে কারণে প্রায় এক যুগ আগে আমি ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলা উত্থাপন করেছিলাম। (দ্রষ্টব্য, লেখকের পুস্তিকা নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের চাবিকাঠি, ২০১৪)।
সম্প্রতি বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য ট্রানজিট–সুবিধা বাতিল করার মাধ্যমে ভারতই প্রমাণ করেছে যে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি সুযোগ বিনিময়যোগ্য ও শর্তসাপেক্ষ হতে পারে। এখন গঙ্গাচুক্তি নবায়নের সময় ঘনিয়ে আসছে। তিস্তা সংকটও প্রকট হয়ে পড়েছে। স্থিতাবস্থা বজায় রেখে নদী বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের সুরক্ষা দেখা কঠিন। এ বিষয়ে অগ্রগতির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষরই প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
● নজরুল ইসলাম অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান
* মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নদ নদ র প ন নদ নদ র প র ব যবহ র কর অবস থ ন র নদ র ওপর অন য ন য র ওপর ব র নদ নদ ত নদ নদ নদ র ব স রক ষ র জন য কর ত ক এখন ব এ সনদ ইউর প র করত
এছাড়াও পড়ুন:
নদীবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরে আমাদের বাধা কোথায়
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নদ–নদীবিষয়ক ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন (ইসিই) কর্তৃক প্রণীত ১৯৯২ সালের সনদে স্বাক্ষর করেছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে এমন তথ্য জানা যাচ্ছে। সূচনায় সনদটি কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য ছিল। ২০০৩ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে একে ইউরোপবহির্ভূত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
এই সুযোগ ব্যবহার করে ইউরোপের বাইরের যেসব দেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে, সেগুলো হলো ক্যামেরুন, চাদ, ঘানা, গিনি-বিসাউ, সেনেগাল, টোগো, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান। এখন বাংলাদেশ এ তালিকায় যুক্ত হবে, যদি এ সনদ স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত দেশের ভবিষ্যৎ সংসদ দ্বারা অনুমোদিত হয়।
২.ইউরোপীয় কমিশনের ১৯৯২ সালের সনদটি মূলত আন্তর্জাতিক নদ–নদীর দূষণবিষয়ক। এর মূল লক্ষ্য হলো ‘দূষণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস’।
সনদে বলা হয় যে কাজটি করতে হবে দূষণের উৎসে এবং তা এমনভাবে করতে হবে, যাতে এক দেশ কর্তৃক সাধিত দূষণ কোনো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উপায়ে অন্য দেশে না পৌঁছায়।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ সনদে বিস্তারিত নীতিমালা ও পথপদ্ধতি বিধৃত হয়েছে। ইসিইর এই সনদে আন্তর্জাতিক নদ–নদীর পানির ‘যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত ব্যবহার’ এবং ‘পরিবেশের সুরক্ষা ও প্রয়োজনবোধে পুনরুজ্জীবনের’ কথাও বলা হয়। তবে এসব বিষয়ে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রস্তাবিত হয় না। মূল মনোযোগ দূষণ হ্রাসের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে।
৩.সীমান্ত অতিক্রমকারী দূষণ বাংলাদেশের নদ–নদীর জন্যও একটি সমস্যা। গঙ্গা পৃথিবীর একটি অন্যতম দূষিত নদী। শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষি ও মনুষ্যবর্জ্য ছাড়াও এই নদীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ও গবাদিপশুর মরদেহ নিক্ষিপ্ত হয়, যা দূষণ বৃদ্ধি করে। এই দূষিত পানি নিয়েই গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
উত্তর–পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উত্তোলন বৃদ্ধির কারণে এই রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদ–নদীর পানির দূষণও বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীর দূষণ মোকাবিলার জন্য ইসিইর ১৯৯২ সালের সনদ স্বাক্ষর করা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তবে বাংলাদেশের জন্য দূষণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্তর্জাতিক নদ–নদীর প্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের সমস্যা। উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত নদ–নদীর পানি অপসারণ করছে এবং এ কারণে বাংলাদেশে নদ–নদীর প্রবাহ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে (বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে)।
■ উজান অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ভারত নদ–নদীর পানি অপসারণ করছে এবং তার ফলে বাংলাদেশে নদ–নদীর প্রবাহ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ■ এটা স্পষ্ট যে ১৯৯৭ সালের সনদ অভিন্ন নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশ স্বার্থের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থন পাবে, তাই অবিলম্বে বাংলাদেশের এটি স্বাক্ষর করা উচিত।ফারাক্কা বাঁধ ও উজানে আরও বহু স্থাপনা নির্মাণের কারণে শীতকালে বাংলাদেশে গঙ্গার পানি এখন ‘ন্যূনতম পরিবেশ রক্ষামূলক প্রবাহের’ নিচে চলে যায়। এ কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমের নদ–নদীগুলো গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে বর্ষাকালেও এই সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয় না।
গঙ্গার প্রবাহ হ্রাসের কারণে সুন্দরবন এখন হুমকির মুখে। ইউনেসকোর ‘বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যে’র একাধিক পর্যবেক্ষণ দল এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
উত্তরবঙ্গে তিস্তা নদীর প্রবাহ নিয়েও ভারত একই আচরণ করছে। এই নদীর ওপর ভারত কর্তৃক নির্মিত গজলডোবা এবং অন্যান্য বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা নদী প্রায় সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়।
আরও পড়ুনআন্তর্জাতিক পানি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাংলাদেশের বাধা কোথায় ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪৪.আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ অভিমুখে সরিয়ে নেওয়ায় ব্যাপৃত। অথচ গঙ্গার প্রবাহ হ্রাসের কারণে এখন বাংলাদেশের নদ–নদীর প্রায় ৭০ শতাংশ প্রবাহ ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল। পূর্ব দিকে টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে মেঘনা নদীর প্রবাহ হ্রাসের প্রচেষ্টা গৃহীত হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা ৫৪টি নদ–নদীর প্রায় প্রতিটির ওপরই ভারত প্রবাহ অপসারণ কিংবা নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো নির্মাণ করেছে অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। ভারতের এ আচরণের কারণে বাংলাদেশের নদ–নদীর ক্ষতিকর বিকৃতিও সাধিত হচ্ছে।
শীতকালে শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে নদীর তলদেশের কাঠিন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে কারণে বর্ষাকালে নদী খাত ততটা গভীর হতে পারে না এবং নদী বরং পাড় ভাঙে। ফলে একদিকে নদ–নদী অগভীর হচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রশস্ত হচ্ছে। কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে ও নদীভাঙনে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে।
কাজেই ভারতের কাছ থেকে নদ–নদীর প্রবাহের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রতিই বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সে জন্য দরকার আন্তর্জাতিক নদ–নদীসংক্রান্ত জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদে স্বাক্ষর করা।
৫.১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইন সমিতির ৫২তম সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদ–নদীসংক্রান্ত ‘হেলসিংকি বিধান’ গৃহীত হয়েছিল। প্রয়োজনের তুলনায় এই বিধান সামগ্রিক বিবেচিত না হওয়ায় ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নদ–নদীর ব্যবহারসংক্রান্ত ৩৭টি ধারা সম্পন্ন সনদ প্রণয়ন করে। পর্যাপ্তসংখ্যক দেশ কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে এ সনদ কার্যকারিতা পায়।
জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের সনদ নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের অধিকারকে অনেক সুনির্দিষ্ট রূপ দেয়। যেমন এই সনদের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয় যে ‘কোনো দেশ কর্তৃক আন্তর্জাতিক নদ–নদী ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অংশীদার অন্যান্য দেশের যাতে কোনো প্রণিধানযোগ্য ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি এরূপ কোনো ক্ষতি সাধিত হয়, তবে দায়ী দেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ক্ষতিপূরণ প্রদানসমেত অন্যান্য এমন ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবে, যাতে এই ক্ষতি পূরিত হয়।’
এ ক্ষয়ক্ষতি বিচারে যেসব বিষয় আমলে নিতে হবে, এর একটি বিস্তারিত তালিকা এই সনদের ৬ নম্বর ধারা প্রদান করে। সেখানে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়, তার মধ্যে রয়েছে (ভাটির) দেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদা’, ‘নদীর ওপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা’ ও নদ–নদীর ‘প্রচলিত, বিদ্যমান ও সম্ভাব্য ব্যবহার’।
১৯৯৭ সালের সনদ অংশীদার সব দেশকে আলাদাভাবে এবং যেখানে প্রযোজ্য, যৌথভাবে আন্তর্জাতিক নদ–নদীর বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা ও যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করে (ধারা ২০)। সনদ ব্যাখ্যা দেয় যে নদ–নদীর বাস্তুতন্ত্র বলতে নদ–নদীর মোহনা ও সমুদ্র উপকূলকে অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করতে হবে (ধারা ২৩)।
৬.এ সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে ১৯৯৭ সালের সনদ বাংলাদেশের জন্য অনুকূল। এই সনদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধনকারী ভারতের ফারাক্কা কিংবা গজলডোবা বাঁধ মোটেও সিদ্ধ নয়।
আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপসারণের ভারতীয় তৎপরতাও এই সনদবিরোধী। গঙ্গার পানি অপসারণের মাধ্যমে সুন্দরবনের যে অবক্ষয় ভারত ডেকে এনেছে, সেটাও এ সনদের পরিপন্থী।
সর্বোপরি আবহমানকাল ধরে নদ–নদীর যেসব ‘প্রচলিত ও বিদ্যমান ব্যবহার’ বাংলাদেশের জনগণ করে আসছিলেন, সেগুলোর ক্ষতিসাধনকারী কোনো কাজ ভারত করতে পারে না।
নদ–নদীবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির উপায়ও ১৯৯৭ সালের সনদে অন্তর্ভুক্ত হয় (ধারা ৩৩)। বলা হয় যে যদি বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হতে না পারে, তবে তারা নিম্নরূপ তিন উপায়ের যেকোনোটি বেছে নিতে পারে।
প্রথমত, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে কোনো তৃতীয় পক্ষকে মধ্যস্থতা কিংবা সালিস করার জন্য অনুরোধ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তাদের দ্বারা গঠিত পানিবিষয়ক কোনো যৌথ প্রতিষ্ঠানের সহায়তা গ্রহণ করতে পারে।
তৃতীয়ত, ‘আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের’ শরণাপন্ন হতে পারে।
কাজেই এটা স্পষ্ট, ১৯৯৭ সালের সনদ অভিন্ন নদ–নদীর ওপর বাংলাদেশ স্বার্থের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থন পাবে, তাই অবিলম্বে বাংলাদেশের এতে স্বাক্ষর করা উচিত।
ভারত চায় বাংলাদেশকে কেবল দ্বিপক্ষীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রাখতে। তবে পরিতাপের বিষয় যে এই দ্বিপক্ষীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ নদ–নদী বিষয়ে স্বীয় স্বার্থরক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো সাফল্য অর্জন করেনি। বস্তুত এ কাঠামো এখন বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক কদাচিৎ অনুষ্ঠিত হয়।৭.একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, যেহেতু ভারত ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষর করেনি এবং আপাতদৃষ্টে চায় না যে উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশ এতে স্বাক্ষর করুক, সেহেতু বাংলাদেশের পক্ষে এ সনদে স্বাক্ষর করে ভারতের বিরাগ বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না। যদি এটাই যুক্তি হয়, তাহলে বাংলাদেশ ইসিইর ১৯৯২ সালের সনদে স্বাক্ষর করতে গেল কেন? ভারত তো এই সনদেও স্বাক্ষর করেনি!
আসলে ভারতের ইচ্ছা বা অভিরুচি দ্বারা বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারিত হওয়া সংগত নয়। ভারত যেমন তার স্বার্থ দেখে, বাংলাদেশকেও তেমনি নিজের স্বার্থ দেখতে হবে। উজান অবস্থানের সুযোগে ভারত নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারছে। তাই ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে সে নিজের ওপর বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে চায় না। একই কারণে ভারত নদ–নদী বিষয়ে নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্তকারী কোনো বহুপক্ষীয় আলোচনায়ও রাজি নয়।
ভারত চায় বাংলাদেশকে কেবল দ্বিপক্ষীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রাখতে। তবে পরিতাপের বিষয় যে এই দ্বিপক্ষীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ নদ–নদী বিষয়ে স্বীয় স্বার্থরক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো সাফল্য অর্জন করেনি। বস্তুত এ কাঠামো এখন বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক কদাচিৎ অনুষ্ঠিত হয়।
৮.এটা গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৯৭ সালের সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ সনদে প্রদত্ত সুরক্ষাগুলো ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়ও ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশ দেখাতে পারে যে নদ–নদীবিষয়ক তার দাবিগুলো কোনো অযৌক্তিক অভিলাষ নয়, বরং আন্তর্জাতিক সনদ দ্বারা স্বীকৃত ও সমর্থিত।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে স্বীয় অবস্থানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এ সনদে প্রদত্ত অধিকারগুলো ব্যবহার করতে পারে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ উপমহাদেশের অন্যান্য দেশকেও এই সনদ স্বাক্ষরে উৎসাহিত করতে পারে, যাতে এ অঞ্চলের নদ–নদীবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি সর্বসম্মত আইনগত ভিত্তি সৃষ্টি হয়।
১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষরের জন্য ভারতের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তিব্বতে চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের পানি অপসারণের হুমকি সম্ভবত একসময় ভারতেরও চক্ষু উন্মীলিত করবে।
লক্ষণীয়, ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের যেমন কিছু সুবিধা আছে, তেমনি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানেরও কিছু সুবিধা আছে। সে কারণে প্রায় এক যুগ আগে আমি ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলা উত্থাপন করেছিলাম। (দ্রষ্টব্য, লেখকের পুস্তিকা নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের চাবিকাঠি, ২০১৪)।
সম্প্রতি বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য ট্রানজিট–সুবিধা বাতিল করার মাধ্যমে ভারতই প্রমাণ করেছে যে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি সুযোগ বিনিময়যোগ্য ও শর্তসাপেক্ষ হতে পারে। এখন গঙ্গাচুক্তি নবায়নের সময় ঘনিয়ে আসছে। তিস্তা সংকটও প্রকট হয়ে পড়েছে। স্থিতাবস্থা বজায় রেখে নদী বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থের সুরক্ষা দেখা কঠিন। এ বিষয়ে অগ্রগতির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের সনদ স্বাক্ষরই প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
● নজরুল ইসলাম অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান
* মতামত লেখকের নিজস্ব