ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ইউরোপের নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা যুদ্ধবিরতির কোনো চুক্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেন ও ইউরোপের নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, মস্কোর ওপর চাপ বজায় রাখার কথাও।
ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ১৫ আগস্ট—যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে। এ নিয়ে গত শুক্রবার ট্রাম্প বলেন, দুই পক্ষের (রাশিয়া-ইউক্রেন) ভালোর জন্য কিছু ভূখণ্ড হাতবদল করা লাগতে পারে। ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে রয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত হিসেবে ইউক্রেনকে এসব ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দেওয়া লাগতে পারে—এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন ট্রাম্প।
তবে নিজেদের কোনো ভূখণ্ড মস্কোর হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে শনিবার প্রবল আপত্তি জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররাও মনে করেন, এমন শর্ত রাশিয়াকে ‘আগ্রাসনে’ উৎসাহিত করবে। এদিন ফ্রান্স, ইতালি, জার্মান, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান বিবৃতি দিয়ে ভূখণ্ড ‘হাতবদলের’ বিরোধিতা করেছেন।
বিবৃতিতে ইউরোপের নেতারা বলেন, ‘শক্তি খাটিয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পরিবর্তন করা যাবে না’—এমন নীতির বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছেন তাঁরা। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করা উচিত বর্তমান যে সীমান্ত রয়েছে, সেটি মাথায় রেখে। শুধু যুদ্ধবিরতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের শত্রুতা থামানোর বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।
পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনার জন্য ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইউরোপের নেতারা বলেন, ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন ও রাশিয়ার ওপর চাপ বজায় রাখা জরুরি। আর কূটনৈতিকভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের সময় কিয়েভ ও ইউরোপের নিরাপত্তার স্বার্থের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। তাঁরা এ-ও বলেন, ইউক্রেনে শান্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে হতে পারে না।
ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা নিয়ে শনিবার লন্ডনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির সঙ্গে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঘণ্টাব্যাপী ওই আলোচনায় যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁরা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউক্রেনে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে বের করার।
বিবেচনায় জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প-পুতিন আলোচনায় জেলেনস্কিকে বাদ দেওয়া নিয়ে সমালোচনা চলছে। এরই মধ্যে শনিবার হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলাস্কায় পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার পথ খোলা রেখেছেন ট্রাম্প। তবে পুতিনের অনুরোধে এখন শুধু দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের (ট্রাম্প-পুতিন) পরিকল্পনা করা হয়েছে।
শনিবারই মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ আগস্ট আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে হোয়াইট হাউস। বৈঠকটির বিষয়ে জানাশোনা আছে—এমন একজন ব্যক্তি এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে যে জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি চূড়ান্ত নয়। সম্ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে।
ইউক্রেনের শান্তি ফেরানোর সিদ্ধান্ত কিয়েভকে ছাড়া নেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেছেন জেলেনস্কি। জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপের পর গতকাল রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশগুলোর নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইউর প র ন ত র ইউক র ন য দ ধ ইউক র ন র র ব ষয়ট বল ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক আরোপ: ট্রাম্প আসলে ভারতকে ততটা গুরুত্বই দেয়নি
ভারতীয়রা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছে। ট্রাম্প তাদের দেশের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ, সম্ভবত বিশ্বের মধ্যেও সর্বোচ্চ হার। তাহলে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের কূটনৈতিক জমকালো আয়োজনগুলো, যেগুলো ‘হাউডি মোদি’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামে পরিচিত ছিল, সেই বহুল আলোচিত সৌহার্দ্যের কী হলো? ফেব্রুয়ারিতে যে আন্তরিকতা দেখা গিয়েছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিকের বিদেশি অতিথিদের একজন হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ওয়াশিংটনে স্বাগত জানিয়েছিলেন, তারই-বা কী হলো? ভারত এই প্রকাশ্য অবজ্ঞাকে কীভাবে বুঝবে?
এটি আসলে খুবই সহজ: এভাবেই ট্রাম্প কাজ করেন। প্রতিটি যোগাযোগই তাঁর কাছে ক্ষমতার প্রদর্শন, প্রতিটি নীতি সিদ্ধান্তই ব্যক্তিগত খেয়ালের বহিঃপ্রকাশ। ভারত (তার প্রতিবেশীদের বিপরীতে) তাঁর চাওয়া একতরফা বাণিজ্যচুক্তিতে নতিস্বীকার করতে রাজি হয়নি, তাই তিনি রাগের বশে শুল্ক বসিয়েছেন। ট্রাম্প এটি করেছেন, কারণ সেটিই তাঁর স্বভাব।
সাম্প্রতিক এই টানাপোড়েনের আগে ভারত ছিল পৃথিবীর কয়েকটি দেশের একটি, যেখানে ট্রাম্পের প্রতি গভীর বিরূপ মনোভাব গড়ে ওঠেনি। চলতি মেয়াদের প্রথম চার মাসে পিউ রিসার্চ ২৪টি দেশের ২৮ হাজার ৩৩৩ জনের কাছে জানতে চেয়েছিল, তাঁরা কি বিশ্বাস করেন যে ট্রাম্প ‘বিশ্ব নিয়ে সঠিক কাজ করবেন’। অধিকাংশের (যেমন, তুরস্কে ৮০ শতাংশ, জার্মানিতে ৮১ শতাংশ, মেক্সিকোতে ৯১ শতাংশ) উত্তর ছিল না। কিন্তু ভারতীয়দের অর্ধেকের কিছু বেশি ট্রাম্পের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছিলেন—যে পাঁচটি দেশের মধ্যে তিনি অন্তত সমান জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছিলেন, ভারত তাদের একটি (অন্যগুলো ছিল হাঙ্গেরি, ইসরায়েল, নাইজেরিয়া ও কেনিয়া)।
যেকোনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতার মতো মনে হতে পারে। কী ভুল হলো, তা বিশ্লেষণ করার সময় ভারতীয়দের মনে রাখা উচিত ভালোবাসায় ব্যর্থদের জন্য প্রচলিত দুটি পরামর্শ। প্রথমত, সমস্যা আপনার নয়, তার। দ্বিতীয়ত, সে কারও সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক রাখতে সক্ষম নয়।
ভারতীয়রা ট্রাম্পের প্রতি যে উষ্ণ অনুভূতি পোষণ করেছিল, তা সব সময়ই একপক্ষীয় ছিল। ২০২০ সালে আহমেদাবাদের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন—এটি ট্রাম্প উপভোগ করলেও ভারতীয়রা হয়তো এই অভ্যর্থনার গুরুত্ব অতিরিক্তভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। ট্রাম্প ও মোদির কথিত বন্ধুত্ব কখনোই কোনো তাৎপর্যপূর্ণ নীতি-উদ্যোগে রূপ নেয়নি—বরং ট্রাম্প নিয়মিতভাবে নিজের সহকারীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মোদির উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন।
ভারতের ডানপন্থার কিছু অংশ ট্রাম্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল আরও অশুভ কারণে: তাঁর মুসলিমবিরোধী বক্তব্য ও পদক্ষেপের প্রতি ঝোঁকের জন্য। প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদীরা তাঁর [ট্রাম্প] অনুপস্থিতিতেই জন্মদিন উদ্যাপন করেছিলেন। ট্রাম্প যখন মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোর নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তৃত মুসলিমবিরোধী নীতি কার্যকর করেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থার কিছু অংশ তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিল।
তবে ট্রাম্পকে কোনো বৃহৎ ‘সভ্যতাগত অভিযানে’ তালিকাভুক্ত করার আশা সব সময়ই এক মূর্খতার কাজ ছিল—ট্রাম্পের গভীর পক্ষপাত আছে, কিন্তু কোনো প্রকৃত মতাদর্শ নেই। তাঁর কাছে কোনো স্থায়ী মিত্র বা শত্রুর ধারণা নেই—ব্যক্তিগত সম্পর্ক হোক বা ভূরাজনীতি, সম্পর্কের ধারণাই তাঁর কাছে অজানা।
একটি সম্পর্ক সব সময় উভয় পক্ষের চেয়ে বড় কিছু। সেটা বিবাহ হোক, বন্ধুত্ব হোক বা দুই জাতির মধ্যে জোট—এটি নিরন্তর যত্ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং আপসের দাবি করে। এর কোনোটিই ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক চরিত্রের অংশ নয়। তাঁর কাছে প্রতিটি মিথস্ক্রিয়া মানে একজন বিজয়ী আর একজন পরাজিত। ‘উভয় পক্ষের জয়’—এ ধারণা তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। ভারত এখানে ব্যতিক্রম নয়—তিনি [ট্রাম্প] একইভাবে আচরণ করেছেন নিজের ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে, রাজনৈতিক সহযোগীদের সঙ্গে, তাঁর [ট্রাম্প] তিনজন স্ত্রী এবং (একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া) বিশ্বের প্রায় সব দেশের নেতাদের সঙ্গে।
ট্রাম্প তেল কেনা নিয়ে কিছুই ভাবেন না, ইউক্রেন নিয়েও না। যা তাঁকে ক্ষুব্ধ করছে, তা হলো—ভারত নিজের অবস্থানে অটল রয়েছে। ট্রাম্প পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে জোর করে বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর প্রকাশ্য অন্যায্য শুল্কই হবে বাণিজ্যচুক্তির ভিত্তি এবং তাদের অনেকেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তা মেনে নিয়েছে।ওই একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যাঁর প্রতি ট্রাম্প বহু দশক ধরে এক রহস্যময় আসক্তি পোষণ করে আসছেন। কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, ট্রাম্প আশঙ্কা করেন যে পুতিন তাঁর [ট্রাম্পের] বিরুদ্ধে কোনো ব্ল্যাকমেল-যোগ্য তথ্য হাতে রেখেছেন। কিন্তু এই আশঙ্কা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেভাবে একেবারে বশীভূত কুকুরছানার মতো তাঁর রুশ প্রেসিডেন্টকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন।
কারণ যা-ই হোক না কেন, ভারতের ওপর শুল্ক আরোপের জন্য ট্রাম্প যে যুক্তি দিয়েছেন, তা আরও অযৌক্তিক শোনায়—তাঁর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ প্ল্যাটফর্মে তিনি লিখেছেন, ‘ভারত বিশাল পরিমাণে রাশিয়া থেকে তেল কিনছে… তারা পাত্তা দেয় না, রাশিয়া ইউক্রেনে কত মানুষ হত্যা করছে। এ কারণে, আমি ভারতের শুল্ক বাড়িয়ে দেব।’
ভারতীয়দের বিভ্রান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক: রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে ট্রাম্প ধারাবাহিকভাবে পুতিনের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সমর্থক ছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে—ওভাল অফিসের ভেতরে, সাংবাদিকদের ক্যামেরা চলমান অবস্থায়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অপমানজনকভাবে বক্তৃতা শুনিয়েছিলেন এবং রাশিয়ার দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি ক্ষুব্ধ, কারণ ভারত রুশ তেল কিনছে?
আসলে তা নয়। ট্রাম্প তেল কেনা নিয়ে কিছুই ভাবেন না, ইউক্রেন নিয়েও না। যা তাঁকে ক্ষুব্ধ করছে, তা হলো—ভারত নিজের অবস্থানে অটল রয়েছে। ট্রাম্প পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে জোর করে বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর প্রকাশ্য অন্যায্য শুল্কই হবে বাণিজ্যচুক্তির ভিত্তি এবং তাদের অনেকেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তা মেনে নিয়েছে।
পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য দেশ অনানুষ্ঠানিক ‘চুক্তি’ মেনে নিয়েছে, যার অধীনে তাদের রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রে গেলে তা শুল্কের কঠোর শাস্তিমূলক হারের মুখে পড়ে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারে শুল্কমুক্তভাবে। বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যগোষ্ঠী ইউরোপীয় ইউনিয়নও ভীতভাবে একই ধরনের দাবিতে সায় দিয়েছে। কিন্তু ভারত এমন নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এটাই ট্রাম্পের রোষের আসল কারণ।
তাহলে কেন এই দেশগুলো নতি স্বীকার করেছে? তারা সবাই ট্রাম্পকে ধোঁকা দেওয়ার আশায় আছে: এসব ‘চুক্তি’র কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই আর ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিনই নিজের সিদ্ধান্ত বদলান। তাঁর ভয় দেখানো নীতির কাছে নতি স্বীকার করা অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন করেছে, তারাও বাজি ধরছে যে একবার শিরোনামে জয়ের খবর তুলে নিলে ট্রাম্প আর তা কার্যকর করার প্রতি আগ্রহী হবেন না। যদি প্রকাশ্যে কিছুটা অপমান সহ্য করলেই ২৫ শতাংশের বদলে ১৫ শতাংশ শুল্কে রপ্তানি করা যায়, তাহলে এই গ্লানি মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?
ভারত কয়েক শতাংশ শুল্ক রেহাইয়ের জন্য জাতীয় মর্যাদা বিসর্জন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই: ইতিহাসজুড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অধিকারের বিষয়ে ভারত সব সময়ই ব্যতিক্রমীভাবে সংবেদনশীল থেকেছে। অধিকাংশ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াশিংটনসহ অন্যান্য জায়গায় অত্যধিক খুঁতখুঁতে এবং জাতীয় সম্মান নিয়ে অতিসংবেদনশীল হিসেবে দেখা হয়েছে, বিশেষ করে যেকোনো ছাড়, যা জাতীয় অপমান হিসেবে ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু বিজেপি, কংগ্রেস বা জনতা—সব ধরনের ভারতীয় নেতাই যখন এভাবে আচরণ করেছেন, তখন তা স্পষ্ট যে তারা তাদের জনগণেরই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
যা-ই হোক না কেন, আমি আশা করি ভারত তার অধিকার রক্ষায় অবিচল থাকবে। যে দেশই ট্রাম্পের অবৈধ দাবির কাছে মাথা নোয়ায়, পরবর্তী দেশের জন্য প্রতিরোধ করা ততটাই কঠিন হয়ে ওঠে। ভারত আসলে ভালো সঙ্গেই আছে: চীন, ব্রাজিল ও কানাডা এরই মধ্যে প্রতিরোধ করেছে আর যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তারা সম্ভবত নিজেদের নাগরিকদের ক্ষোভের মুখোমুখি হবে, যখন সম্পূর্ণ একতরফা শুল্ক কার্যকর হতে শুরু করবে।
ট্রাম্প কখনো ভারতের বন্ধু ছিল না। তিনি কারোরই বন্ধু ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে, সম্পর্ক কেবল ‘বোকার’ জন্য। ট্রাম্প কখনোই ভারতকে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে চায়নি। ‘বন্ধুত্ব’ বলে কোনো কিছু ট্রাম্পের প্রাপ্য নয়।
জোনাহ ব্ল্যাঙ্ক লেখক ও বিশ্লেষক
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া
*মতামত লেখকের নিজস্ব