সংসদে নারী আসন ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন
Published: 13th, August 2025 GMT
আলোচনা
রাশেদা কে চৌধূরী
নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান ও
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
১৯৯৫ সালের বেইজিং ঘোষণা ও কায়রোর আইসিপিডি সম্মেলনের সেই স্লোগান, ‘আমাদের বাদ দিয়ে আমাদের নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না।’ কিন্তু ৩০ বছর পর দেখছি, বাংলাদেশ যেন উল্টো দিকে হাঁটছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যাক গিয়ারে হাঁটার জন্য দায়ী কে?
বৈষম্য বিলোপ, বিচার ও সংস্কার—এই তিন প্রত্যাশা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু নারীকে বাদ দিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। বৈষম্য বিলোপের আশা এখন ‘গুড়ে বালি’।
কাদের চাপে পড়ে কোন পথে হাঁটছে দেশ? আমরা কি ধরে নেব সরকার পক্ষপাতদুষ্ট? একটা বিশেষ গোষ্ঠী বা বিশেষ ব্যক্তি বা কারও কাছে অন্তর্বর্তী সরকার যে পক্ষপাতদুষ্ট নয়, সেটা তাদেরই প্রমাণ করতে হবে।
আমাদের নতুন করে গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু করতে হবে, নারীর অবদান গবেষণা ও আন্দোলনের মাধ্যমে দৃশ্যমান করতে হবে। আমি প্রত্যাশা করব আবার একটি নারীর ডাকে ‘মৈত্রী যাত্রা’ হবে আমাদের পক্ষ থেকে।
নারীর ক্ষমতায়ন শুধু অংশগ্রহণ নয়, অংশীদারত্ব নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ শব্দটির সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে—নারীদের বাদ দিয়ে কোনো অন্তর্ভুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। নারীদের বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত কেন শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই নেবে? আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে আছি। মাঠে কাজ করছি। নারীদের কথা শুনতে হবে। নারী আসন নিয়ে নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানাই। এ ছাড়া সব রাজনৈতিক দলকে মানানোর দায়িত্ব পালন করতে হবে ঐকমত্য কমিশনকে।
বদিউল আলম মজুমদার
সদস্য, ঐকমত্য কমিশন ও প্রধান, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
আমার মনে হয়, আপনাদের একটু সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার যে ঐকমত্য কমিশনের ম্যান্ডেটটা কী ছিল? ঐকমত্য কমিশনের ম্যান্ডেটটা ছিল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো। ঐকমত্য কমিশন শুধু ফ্যাসিলিটেটরের কাজ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবের আলোকে ৫ শতাংশ আসনের কথা বলা হয়েছে। এখানে একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। তো এখন আমাদের মনে হয়, একটু নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার, আমাদের একটু নিজেদের ভাবা দরকার, কী ঘটল, কেন ঘটল? নিঃসন্দেহে নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে সাম্প্রতিক অঘটন আমাদের গভীর ভাবনার বিষয়। এখানে পুরুষ নয়, জয়ী হয়েছে পুরুষতন্ত্র। নারীরা আমাদের দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা। সংসদে নারীদের ৫০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব থাকাটা তাঁদের অধিকার। বিগত ২০০৭ সালে যখন স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার সুযোগ হয়েছিল, তখন আমি বহু চেষ্টা করেছি, সবার সহায়তা–সমর্থন পাইনি। তখনকার অধ্যাদেশে ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের বিষয়টি ছিল। কিন্তু সরকার সেটি রেটিফাই করেনি, ফলে নারীর নেতৃত্ব সৃষ্টির ঐতিহাসিক সুযোগ হারিয়ে গেছে। তখন যদি ৪০ শতাংশ নারী দাঁড়িয়ে যেত, আজ হাজার হাজার নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি হতো। নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সরাসরি নির্বাচন ও ঘূর্ণমান পদ্ধতির মতো বিকল্পগুলো গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতে ঘূর্ণমান পদ্ধতি পরীক্ষিত ও সফল হয়েছে, যেখানে নারীর প্রতিনিধিত্ব প্রায় ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অতএব, আমাদের এই ঐতিহাসিক সময়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য ঘূর্ণমান পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। এটি নারী নেতৃত্বের বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
শিরীন পারভিন হক
প্রধান, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন
রাজনীতি ও জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের জায়গায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান সংস্কৃতি বদলাতে হবে। এটা আমাদের খোলাখুলি সমালোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে, ‘বয়েজ ক্লাব’ হিসেবে পার করে দেব, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। সেটার জন্য প্রতিবাদ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতি বদলাতে হবে।
আগে যখন ১৫টা সিট দিয়ে শুরু হয়েছিল, তখন জনসংখ্যা কত ছিল আর এখন জনসংখ্যা কত। গোটা সংসদ দিয়েই তো প্রশ্ন ওঠানো দরকার, ৩০০ মানুষ কী করে এই জনসংখ্যাকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের তো জনপ্রতিনিধির সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সেই সংখ্যা বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে নারীর আসনের বিষয়টা দেখতে হবে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৬০০ করা এবং এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে। আমাদের প্রস্তাব দুই মেয়াদের জন্য। অনেক পুরুষ বলছেন, এতে নারী আধিক্য বাড়বে। তো বাড়ুক। এত দিন আমরা পুরুষ আধিক্য নিয়ে চলেছি। দুই মেয়াদ নারীর আধিক্য থাকুক। এই সময়ের মধ্যে অনেক নারী নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে।
আমরা নারীকে যদি সুযোগ না দিই, দরজাটা খুলে যদি না দিই এবং দরজার বাইরে রাখব বলে যদি ঠিক করে বসে থাকি, তাহলে নারী দেখব না।
বিকেন্দ্রীকরণে আমরা খুব জোর দিয়েছি। কারণ, একমাত্র বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়েই কিন্তু তৃণমূলের নারীরা কেন্দ্রে এসে পৌঁছাবেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়টা একটা ঐতিহাসিক সুযোগ অনেক কিছু করার। সে জন্য এ প্রস্তাব। রাজনৈতিক সরকার এলে সেটা থাকবে না।
ফওজিয়া মোসলেম
সভাপ্রধান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে সংসদে নারীর উপস্থিতির সম্পর্ক স্পষ্ট। আমরা দেখেছি নারীদের অংশগ্রহণ ব্যতীত ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় নারী না থাকলে নারীর পক্ষে আইন প্রণয়ন ও বৈষম্য দূর করার সুযোগ তৈরি হয় না। সংসদ হচ্ছে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্থান, এখানে নারীর প্রতিনিধিত্ব অপরিহার্য।
বিগত সংসদগুলোয় আমরা দেখেছি, সংরক্ষিত আসন নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কেবল দলীয় ভারসাম্য রক্ষায় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে, ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংসদে থাকা নারী সদস্যরা জনগণ বা নারীর স্বার্থে নয়, বরং কেবল দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাই সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে আমরা জানিয়ে আসছি।
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দেখা গেছে, ছোট দল—বিশেষত বামপন্থীরা ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন। বেশির ভাগ দল নারীদের জন্য আসন ছাড়তে অনিচ্ছুক।
বর্তমানে আমরা একটি খসড়া বিলের প্রস্তাব দিয়েছি, যেখানে বলা হয়েছে—সংসদের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪০০ করা হোক; এর মধ্যে ১৫০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ৩০০ সাধারণ আসনের পর প্রতি দুটি সাধারণ আসনের জন্য একটি নারী আসন নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নারীদের কাজের চাপ কমবে এবং প্রতিনিধিত্ব আরও কার্যকর হবে।
আমাদের মূল দাবি দুটি। প্রথমত, সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত, সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দেবে এবং সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
ফারাহ কবির
কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ
১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বারবার সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সংরক্ষিত নারী আসন ১৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত হয়েছে। তবু যখনই আমরা রাজনৈতিক দলের কাছে যাই, বারবার শোনা যায়—নারীদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ বাংলাদেশ সরকারই ১৯৯৫ সালে বেইজিং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে প্রতিশ্রুতি ছিল নারীদের জন্য অন্তত ৩০ শতাংশ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। সেই ৩০ শতাংশের লক্ষ্য থেকে আমরা আর এগোতে পারিনি।
আমার মতে, আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে ও স্পষ্টভাবে বলতেই হবে—প্রথমত, সরাসরি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৫ সালে সরকার ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে যে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলে যাঁরা নারী রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে বসতে হবে, তাঁদের প্রস্তুত করতে হবে।
এখানে সিভিল সোসাইটির অবস্থান মোটামুটি স্পষ্ট—১০০টি আসন এবং সরাসরি নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সংরক্ষিত ৫ শতাংশ আসনের প্রস্তাবকে আমি দয়া বা অনুগ্রহ হিসেবে দেখি। দেশে যদি নারীর সংখ্যা ৫০ থেকে ৫১ শতাংশ হয়, যদি তৈরি পোশাক খাত থেকে শুরু করে রেমিট্যান্স আয়ের বড় অংশ নারীরা এনে দেন, তাহলে মাত্র ৫ শতাংশ আসন বরাদ্দের যুক্তি কী? আমরা চাইব, অন্তত ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হোক।
আমরা জানি, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, বিদ্বেষ ও বাধাগুলো কীভাবে কাজ করে। কিন্তু এখন সময় এসেছে সবাই মিলে নিজ নিজ আসনে থাকা নারীদের পাশে দাঁড়ানোর, তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করার।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
আমার ধারণা, নারী প্রতিনিধিত্ব এখন পর্যন্ত যা আছে, আগামী সংসদে তা আরও অনেক কম হবে। আমরা কোনো ভালো দিকে যাচ্ছি না। জুলাই ঘোষণাপত্র থেকে নারীকে সচেতনভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। যদি এমন হতো যে ঘোষণাপত্রে সব গোষ্ঠীকেই বাদ দেওয়া হয়েছে, তাহলে বুঝতাম কোনো গোষ্ঠীকেই টার্গেট করা হয়নি। কিন্তু এখানে কয়েকটি গোষ্ঠীকে নেওয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনোটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ রকম একটি জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি না।
দেশে নারীর ক্ষমতায়ন এখনো শুধু মুখের কথা। সামনের দিনগুলোতে এই পর্যায়েও নারীকে দেখা যাবে না। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে নারীর জন্য ইশতেহার হিসেবে ধরে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে হবে।
নারীর মূল ক্ষমতায়নের জায়গাটি রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর থেকে হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার যতগুলো কমিশন হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দল সংস্কার নিয়ে কোনো কমিশন নেই। সেটিকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের ঘাটতির কারণে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আগামী দিনগুলোয় রাজনৈতিক দলগুলোর নারী নেতৃত্ব সংস্কারের জায়গাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
বিগত প্রতিটি সংসদে নারীদের আলংকারিকভাবে দেখা হয়েছে। সংসদের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোয় নারীরা থাকেন। কিন্তু তাঁরা সেখানে যান শুধু কোরাম পূরণ করতে। সেখানে গিয়ে তাঁরা তেমন অংশগ্রহণ করেন না। তাঁরা আগ্রহও পান না। তাঁদের বক্তব্যও গুরুত্ব পায় না। নারীরা সংরক্ষিত আসন ও নির্বাচন ছাড়া আসছেন দেখে জনপ্রতিনিধিত্বের বোধ তাঁদের আসে না। সেই কারণে আমরা সবাই সরাসরি নির্বাচনের দাবি করি।
গীতা দাস
সভাপ্রধান, নারীপক্ষ
দাবি পূরণে এখন নাগরিক সমাজকে সক্রিয় হতে হবে। তবে সক্রিয়তা কত দূর পর্যন্ত হওয়া উচিত, আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।
নারীদের সবখানে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। নারীরা জড় পদার্থ নয়। যখন যার ইচ্ছা সংসদে আসন তৈরি করবে, আমরা সেখানে বসব। যদি আসন নিয়ে আবারও কোনো সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে আমরা ভোট দেব না। হয়তো গুরুত্ব দেবে না, কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিবাদ জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় যখন নারীদের জন্য তিনটি সদস্যপদ রাখা হয়, তখন অনেক সমালোচনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, নারীরা ভোট দেবে, কিন্তু তারা বুঝবে না কাকে কত ভোট দিতে হবে। নারীদের প্রতি এমন অবমূল্যায়ন সারাক্ষণই চলে আসছে।
নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে এখনো নানা অজুহাত দেওয়া হয়। আমরা এখন আরও পিছিয়ে গেছি। নারী কমিশনে ৫০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু পরে আমরা কিছুটা পিছিয়ে এসে বলেছি, এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ রাখা হোক।
বারবার বলা হচ্ছে—সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা অনুপস্থিত। তবে আমরা, যারা প্রেশার গ্রুপে আছি, তাদের নেটওয়ার্ক সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত। সারা দেশব্যাপী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা যেহেতু বলা হয়েছে, আমরা একটি ক্যাম্পেইন চালাতে পারি। আমরা চাই—নারী আসনের ক্ষেত্রে, যা প্রস্তাবের শুরুতে ৫০ শতাংশ ছিল এবং পরে এক-তৃতীয়াংশে নেমেছে, অন্তত তা যেন বহাল থাকে। আর যার যে নেটওয়ার্ক আছে, সেখান থেকে সবাই যেন সোচ্চার হয়।
শাহীন আনাম
নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
যখনই সমান অধিকারের কথা বলি, তখনই একটা হুংকার আসে। অনেক দিন ধরে সরাসরি নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। এখন যে ৫ শতাংশ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা হাস্যকর।
এ পরিস্থিতি আমাদের গভীরভাবে আহত করেছে এবং আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে—আমাদের সমাজে নারীর স্থান আসলে কোথায়? নারীর প্রতিনিধিত্ব কেবল সংবেদনশীলতার বিষয় নয়, এটি একটি ন্যায্য দাবি। নারীরা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ। তাই সংসদ ও অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থায় নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সংবিধানসম্মত ও যুক্তিসংগত দাবি।
আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের আসন থাকতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় সংরক্ষিত আসন ও পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। প্রস্তাবিত মাত্র ৫ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে প্রহসনে পরিণত করে। আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কেবল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ, নারী সংগঠন বা সাধারণ নারীদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করা হয়নি।
আমাদের প্রশ্ন, শুধু রাজনৈতিক দলই কি দেশের একমাত্র প্রতিনিধি? নাগরিক সমাজ কি কোনো ভূমিকা রাখে না? নারী নাগরিকদের মতামত কি গুরুত্ব পায় না? এ প্রক্রিয়া যে নারীবিরোধী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা স্পষ্ট করে জানাতে চাই, নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের দাবি জানিয়ে যাব। আমরা চাই, অবিলম্বে নারীদের সঙ্গে, নারী আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করা হোক, যাতে রাজনৈতিক ও নীতি-প্রক্রিয়ায় নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়।
খুশী কবির
সমন্বয়কারী, নিজেরা করি
বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি নতুন সরকার পেয়েছি, যে সরকারের কাছে মানুষের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল যে তারা রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে। এটাই ছিল অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু তা করতে এই সরকার ব্যর্থ হয়েছে। যে পরিবর্তন ও সংস্কার করার কথা ছিল, তা হয়নি।
অতীতে যাঁরা নারী আসনে সংসদে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই অনেক ভালো কাজ করেছেন। তাঁরা নিশ্চুপ ছিলেন না। অনেকেই সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু এমন অনেক পুরুষ প্রতিনিধি ছিলেন, যাঁরা কোনো ভূমিকা রাখেননি। তাই এটা একেবারেই যৌক্তিক নয় যে আমরা যোগ্য নারী পাচ্ছি না, কিন্তু অযোগ্য পুরুষ হলেও যথেষ্ট। এগুলো পরিবর্তনের জন্য আমাদের চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই নারী সদস্য আছেন, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কথা বললে স্পষ্ট হয় যে তাঁরা দলের ভেতরে কতটা কোণঠাসা। রাজনৈতিক পরিসরে তাঁদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর একচোখ এখনো পুরোপুরি অন্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন দলের চিন্তার পরিবর্তন কে আনবে? কেবল নারী নয়, দেশের যেকোনো নাগরিকেরই এ অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা।
আমাদের দাবি স্পষ্ট—নারীর জন্য সরাসরি নির্বাচন। সরাসরি নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি দায়বদ্ধ থাকেন ভোটারের কাছে এবং ভোটারও প্রতিনিধিকে জবাবদিহির মুখোমুখি করেন।
সংসদে নারীর জন্য ৫০ ভাগ প্রতিনিধিত্ব চাইতে আমরা ভয় পাই কেন? এ জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে চাপ দেওয়া উচিত। এ জন্য যাঁরা মানবাধিকার, গণতন্ত্র, লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে কাজ করছেন, সবাইকে একযোগে চেষ্টা চালাতে হবে।
সামিনা লুৎফা
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে ৩৩ থেকে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করার দাবি তো দূরের কথা, এখন ৫ শতাংশও শুধু আহ্বান হিসেবে রাখা হচ্ছে—এমনকি সেটা বাধ্যতামূলকও নয়। এই অবস্থায় নারী অধিকার আন্দোলনের সামনে চ্যালেঞ্জ আরও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐকমত্য কমিশনে নারীবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন এবং প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। ঐকমত্য কমিশনের মিটিংয়ে রাজনৈতিক দলগুলো গিয়ে ওখানে যখন কথা বলে, যে ছবি দেখি, তা পুরো একটা ‘বয়েজ ক্লাব’। এখানে চারদিকজুড়ে সব পুরুষ বসে আছেন এবং তাঁরা ওখানে বসে নারীর ভাগ্য নির্ধারণ করছেন। আমরা খবর পাচ্ছিলাম যে আপনারা যদি ১৫ চান, ১০ দিতে পারি। ১০ থেকে কমিয়ে ৭, পরে ৫ শতাংশে নামানো হলো। এটা কি মাছের বাজারে দরাদরি? অবাক লাগে, প্রগতিশীল রাজনীতিকেরাও এখানে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে রাজি হয়েছেন। শুধু পুরুষেরা বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নারী কীভাবে রাজনীতিতে আসবেন। এর চেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নারীকে তাঁর মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মানবাধিকারের জায়গা থেকে বিবেচনা করলে দলগুলো তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর চেয়ে বড় ঐতিহাসিক ভুল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আর কখনো করেনি বলে আমার ধারণা। একই সঙ্গে সবাই মিলে একটা ভয়ংকর রক্ষণশীল অবস্থান নিলেন এবং এর দায় ও খেসারত তাঁদের দিতে হবে। নারীদের সামনে আসতে হবে। নারী শিক্ষার্থী যাঁরা এই অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন, তাঁদেরও সামনে আসতে হবে। যাঁরা নির্বাচন করবেন, তাঁদের নিজেদের জায়গাটার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের বিষয়গুলো ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ নয়, সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকারকর্মী ও সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সংস্কারের বড় সুযোগ এসেছে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার, বৈষম্যহীন বাংলাদেশে যদি করতে না পারি, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় আসবে, তখন আমাদের কথা বলার সুযোগ হবে না। আমরা মনে করছি এবার হচ্ছে আমাদের সময়।
এই ঐতিহাসিক সময়ে, এখনো নারীদের জন্য সরাসরি নির্বাচনের ১০০টি আসন নিশ্চিত করতে আমাদের আবার চাপ প্রয়োগ করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ছে? কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেই আগে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। অথচ এখনো আমাদের নতুন করে এই লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
মাত্র ৫ শতাংশের মতো নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আজও আলোচনা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে আমরা এখনো সেই স্থানে দাঁড়িয়ে আছি। যদি এই হাঁটি হাঁটি পা পা গতিতে এগোতে হয়, তাহলে অন্তত আরও ২৫ বছর লাগবে ৩৩ শতাংশ নারী আসন নিশ্চিত করতে।
নারীদের সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে আসনে পাঠানো উচিত। সরাসরি নির্বাচন নারীর মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণের সেরা মাধ্যম। তাই নারীর ক্ষমতায়ন এবং সংসদীয় কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরাসরি নির্বাচিত নারীর সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনায় শুধু নারী নয়, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ সমাজের সব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সবাই এই দেশের নাগরিক। সেই ভাবনা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
আমাদের এই ঐতিহাসিক সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে, যাতে আমরা সত্যিকারের বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
তাসলিমা আখতার
সভাপ্রধান, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ও সদস্য, শ্রম সংস্কার কমিশন
আমরা প্রত্যেকেই খুব উদ্বিগ্ন। কারণ, আমরা আশা করেছিলাম গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নারীদের অংশগ্রহণ যেমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখেছি, তেমনি গৃহস্থালির ভেতরের নারীদেরও বাইরে এসে সক্রিয় হতে দেখেছি। সেই প্রেক্ষাপট থেকে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি বিশেষ উদ্যোগ নেবে এবং সরাসরি নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করবে।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে যে পর্যায়ে পৌঁছানো গেছে, সেখানে আগের অবস্থাই বহাল আছে। আমরাও যখন আলোচনা করি, তখন আমাদের মানসপটে সংসদ সদস্য মানেই পুরুষ, রাজনৈতিক দল মানেই পুরুষ, নেতা বা বীর মানেই পুরুষ—এমনকি কেউ কেউ বলছেন, ঐকমত্য কমিশনও মানে ‘বয়েজ ক্লাব’।
বাংলাদেশে আমরা যে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছি, সেখানে নারী, পুরুষ, হিন্দু, মুসলমান, পাহাড়ি, বাঙালি—প্রত্যেকের জন্যই, এমনকি শ্রমিকদের জন্যও নির্বাচন একটি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এমন বৈষম্যমূলক সমাজে নারীদের সেই নাগরিক মর্যাদায় পৌঁছে দিতে, সংরক্ষিত আসনের পরিবর্তে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমরা দেখেছি, এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি।
আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এখনো চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ আছে। তবে এই চাপ এমনি এমনি তৈরি হবে না, আর সরাসরি নির্বাচনের সিদ্ধান্তও কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিয়ে দেবে না। আমার মতে, এই ক্ষমতা অর্জন বা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য নারীদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। নারী আন্দোলনের কর্মী এবং অন্য নারীদের সংগঠিত হয়ে মাঠে নেমে এই কথাগুলো জোরালোভাবে বলা এখন অত্যাবশ্যক।
নাজিফা জান্নাত
শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক
আমাদের দেশে যতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে, তার সবগুলোই মূলত একধরনের ‘বয়েজ ক্লাব’ হয়ে থেকেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যায় নারী-পুরুষ সমান হলেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। সাম্প্রতিক ঐকমত্য কমিশনে সংসদে নারীর আসনসংক্রান্ত সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানে তারা পূর্বের পদ্ধতিতে ফিরে গেছে। এটি শুধু হতাশাজনক নয়, নারীর প্রতি সরাসরি অবমাননা।
অভ্যুত্থানের সময় আমরা নারীরা সামনে ছিলাম। তখন আমাদের মিছিলের সামনে রাখলে আন্দোলন ঠিকমতো হচ্ছিল। নারীদের থেকে সাপোর্ট সিস্টেম পাওয়া যাচ্ছিল। তখন কোথাও নারীদের ‘না’ করা হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার শুরুতে দেখছি যে বিএনপি, এনসিপিসহ অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলই ১০০টি নারী সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন করার কথা জানিয়েছিল। এ ব্যাপারে তারা একমত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে। অথচ ২০০১ সালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে নির্বাচিত হয়ে এলে তারা সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করবে।
নারীর প্রতিনিধিত্ব শুধু ন্যায্যতার প্রশ্ন নয়, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মানোন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত। এখনই সময় নারীকে টোকেন হিসেবে রাখার মানসিকতা পরিত্যাগ করে প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে অগ্রসর হওয়ার।
নাগরিক সমাজ, নারী সংগঠন ও সচেতন জনগণকে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে ঐকমত্য কমিশনের কাছে দাবি জানাতে হবে। আমরা আহ্বান জানাই—সব রাজনৈতিক দল যেন নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব সমর্থন করে, যাতে নারীর সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রবেশের পথ সুগম হয়।
অংশগ্রহণকারী:
রাশেদা কে চৌধূরী
নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান
ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
শিরীন হক
প্রধান, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন
বদিউল আলম মজুমদার
সদস্য, ঐকমত্য কমিশন ও
প্রধান, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
ফওজিয়া মোসলেম
সভাপ্রধান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
ফারাহ কবির
কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
গবেষণা পরিচালক, সিপিডি
গীতা দাস
সভাপ্রধান, নারীপক্ষ
শাহীন আনাম
নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
খুশী কবির
সমন্বয়কারী, নিজেরা করি
সামিনা লুৎফা
অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকারকর্মী, সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন
তাসলিমা আখতার
সভাপ্রধান, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ও সদস্য শ্রম সংস্কার কমিশন
নাজিফা জান্নাত
শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক
ধারনাপত্র উপস্থাপন
নাজনীন আখতার, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
সুমনা শারমীন, সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স দ ধ ন ত গ রহণ ন র র র জন ত ক ত ব ন শ চ ত কর ন র দ র জন য ন শ চ ত করত ন র র জন য ম নব ধ ক র ব শ বব দ য র প রস ত ব র ব যবস থ ন র ব ষয়ক ন র জন য আম দ র ম র জন য স ন আম দ র আম দ র দ র পর প র আম দ র প সরক র র জনস খ য আসন ন র ত ব কর ন র পর ক জ কর ল র জন আসন র ণ করত সদস য ন করত র একট অবস থ দরক র র আসন
এছাড়াও পড়ুন:
সফল নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক উত্তরণের অর্ধেকপথ পার করা সম্ভব হবে: মান্না
দেশে একটি সফল নির্বাচন হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের অর্ধেক পথ পার করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও চলমান রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন সময়টা উত্তরণের। যে কথা হচ্ছে সেটা হচ্ছে একটা নির্বাচন। একটা সাকসেসফুল ইলেকশনই (সফল নির্বাচন) আমাদেরকে গণতন্ত্রের উত্তরণের অর্ধেকটা পথ পার করে দেয়।’
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মাওলানা ভাসানী ও গণ–অভ্যুত্থানের রাজনীতি: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মাহমুদুর রহমান এ কথাগুলো বলেন। রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে গণসংহতি আন্দোলন।
দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগের যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয় নয় বলে মনে করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি। দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা ও জুলাই জাতীয় সনদের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১১ মাস ধরে বা ১০ মাস ধরে এতগুলো পার্টি (রাজনৈতিক দল) বসল, নিজেরা কথাবার্তা বলল। তারপরে যেভাবেই হোক একটা সনদ (জুলাই জাতীয় সনদ) নিয়ে আবার বাইরে চলে আসল...এ রকম তো অসম্ভব ছিল। টক শোর মধ্যে যে রকম একজন আরেকজন কলার ধরে ফেলত কিছুদিন আগেও। সেই তুলনায় এটা একটা বিরাট উত্তরণ।’
নাগরিকেরা ভোটাধিকার প্রয়োগে সচেতন বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান। দেশের প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া এবং নারীদের অবস্থার উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন স্ট্রাগলটা ডাইরেক্টলি (সরাসরি লড়াই) জীবনের সাথে, অর্থনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ...মানুষের জীবন পরিবর্তন করাটাই তো আমার রাজনীতি।’ দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারায় বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলারও আহ্বান জানান তিনি।
আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গণ–অভ্যুত্থান যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে, সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যে রাজনৈতিক শক্তি লাগে, সেটা না থাকলে গণ–অভ্যুত্থানের বিপরীতে ফ্যাসিবাদীদেরই আরেকটা নতুন রূপ হাজির হতে পারে। সে জন্য বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একটি বিকল্প রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলার আহ্বানও জানান তিনি।
ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার হতে হবে উল্লেখ করে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘স্পষ্ট করেই বলা দরকার, জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি রাজনৈতিক দল তারা পরিষ্কার করে বলেছে যে তাদের দাবি না পূরণ হলে নির্বাচন তারা হতে দেবে না। এইটার অর্থ কী? এই হুমকি তারা কাকে দিচ্ছে? তাদের মত শুনতে হবে, এই জবরদস্তির রাজনীতি একমাত্র নয়। এটা যদি অপর পক্ষ বিএনপিও দেয়। তাহলে আমাদের ভাবতে হবে যে এখানে আসলে একই জবরদস্তির রাজনীতির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে?’
মাওলানা ভাসানী কখনো ন্যায়ের পক্ষ ত্যাগ করেননি উল্লেখ করে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানান বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম। তিনি বলেন, ‘এবারের যে নির্বাচন, এই নির্বাচনে যারা আসলে নির্বাচিত হয়ে আসবে, তাদের সংবিধান সংস্কার করার ক্ষমতা দেওয়া হবে। এইটুকু পার্থক্য, মানে একদিক থেকে তার কনস্টিটিয়েন্ট পাওয়ার (সাংবিধানিক ক্ষমতা) এবং একদিক থেকে এটা লিমিটেড। এই যে নির্বাচন ঘটতে যাচ্ছে, এইটা হচ্ছে ’৭০–এর পরে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে।’ সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর এ নির্বাচনে বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ দেখছেন না তিনি। কোনো দল সেটি করলে তা আত্মঘাতী হবে বলেও মনে করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু মাওলানা ভাসানীর স্বপ্ন এবং আদর্শকে ধারণ করে আগামীর বাংলাদেশে নতুন রাজনীতি করার আহ্বান জানান। সে জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে গিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার ওপর জোর দেন তিনি।
রাজনৈতিক চরিত্র বদল না হলে ’২৪-এর অভ্যুত্থানের স্বপ্ন পূরণ হবে না উল্লেখ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জেএসডির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তানিয়া রব বলেন, শক্তির মহড়া, প্রচুর টাকার খেলা ও দলীয় আনুগত্যের প্রদর্শন রাজনীতিকে দূষিত করে তুলছে। এতে ’২৪–এর অভ্যুত্থানের পর যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা অধরাই রয়ে যাবে।
বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, ‘অবশ্যই নির্বাচন প্রয়োজন। নির্বাচন আমরা চাই। কিন্তু শুধুমাত্র নির্বাচন হয়ে গেলেই এই সংকট থেকে আমরা উত্তরণের পথের দিকে যেতে পারব না। তার জন্য আমাদের একটা রাজনৈতিক সমঝোতা, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, একটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।’
আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। সভায় আরও বক্তব্য দেন ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।