আনুপাতিক হারে ভোটের (পিআর) দাবি সামনে এনে জামায়াতে ইসলামী মাঠে আন্দোলনে নেমে বিএনপি নেতাদের ব্যস্ত রাখলেও নিজেরা বর্তমান পদ্ধতিতেই নির্বাচনী প্রস্তুতিতে এগিয়ে আছে। দেশের নির্বাচনী আসনের প্রায় সব কটিতে তারা সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাদের পোস্টারও টানানো হচ্ছে কোথাও কোথাও। স্থানীয় নেতা–কর্মীরা সেটি সানন্দে মেনে নিয়েছেন এবং সম্ভাব্য প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচারও চালাচ্ছেন।

প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়েও তাঁরা আগের মতো—যিনি যত প্রবীণ, তিনি বড় হকদার; এই নীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে দলটি বেশ কিছু আসনে তরুণ নেতাদের বেছে নিয়েছে। এ কারণে প্রবীণ কয়েকজন নেতা বাদ পড়লেও কোনো প্রতিবাদ বা আপত্তি ওঠেনি। এটাই হচ্ছে দলটির সাংগঠনিক শৃঙ্খলা। একসময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতেও এই শৃঙ্খলা বজায় ছিল। এখন সেখানেও গ্রুপিং, ভাগাভাগি।

আরও পড়ুনবিএনপি যখন সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার৩১ আগস্ট ২০২৫

অন্যদিকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন করার আগে দলীয় সংঘাত মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে বলা হলো, এ পর্যন্ত সাত হাজার নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কতটি সংঘাতের ঘটনায় কতজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই হিসাব দিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব আত্মতৃপ্তি পেতে পারেন; কিন্তু মানুষ দেখতে চায় দলের নেতা–কর্মীদের সংঘাত বন্ধ হচ্ছে কি না। শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে কি না।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত আট মাসে ৭৬ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে কেবল বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় মারা গেছেন ৫৮ জন। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর হিসাব করলে এই সংখ্যা শতকের ঘর ছাড়িয়ে যাবে।

এ ক্ষেত্রে বিএনপির নেতারা যেসব দোহাই দেন, সেটি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতারাও দিতেন। তঁাদের বড় দল, বিশাল কর্মী বাহিনী। দু–চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে; কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কী হবে? তারা কার কাছে প্রতিকার চাইবে? এখানে বলার সুযোগ নেই যে অনুপ্রবেশকারীরা এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

এখানেও বিএনপি পিছিয়ে আছে। জামায়াতের এ কৌশল মোকাবিলায় নারী ভোটারদের লক্ষ্য করে বিএনপিও নারীসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিচ্ছে। ১৪ অক্টোবর খুলনা থেকে তাদের এই কর্মসূচি শুরু হবে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব এত দিন সময় নিল কেন? মাঠে তো তাঁরাই নির্বাচনের কথা বেশি বলছেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতিতে কেন তাঁরা পিছিয়ে?

এখানে তিনটি উদাহরণ দিই। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ২৯ সেপ্টেম্বর নরসিংদী সদরের চরাঞ্চলে আবারও বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবদলের স্থানীয় এক নেতা নিহত হয়েছেন। সেপ্টেম্বর মাসে ওই এলাকায় এ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি যখন নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার, তখনো অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নরসিংদীতে দলীয় নেতা–কর্মী মারা গেছেন।

নরসিংদীর পাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিস্থিতিও কম উদ্বেগজনক নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানাকে ‘বহিরাগত’ উল্লেখ করে তাঁকে ঠেকাতে একজোট হয়েছেন দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাত নেতা। আগামী নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে প্রার্থী হতে চান বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক রুমিন ফারহানা। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি চট্টগ্রাম–৬ (রাউজান) আসনে। সেখানে এখন পর্যন্ত ১৫ জন খুন হয়েছেন। আসনটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও উত্তর জেলা বিএনপির সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার। এই দুই নেতার অনুসারীরাই সেখানে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। অথচ আওয়ামী লীগ আমলে উভয় পক্ষের অনুসারীরাই নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, মামলা–গ্রেপ্তারের কারণে দীর্ঘদিন ঘরছাড়া ছিলেন।

আরও পড়ুনবিএনপিই কি তবে মধ্যপন্থী রাজনীতির শেষ ভরসা২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কেবল নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাউজান নয়; দেশের অনেক জেলা–উপজেলায় যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, তার পেছনেও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তাঁরা ভাবেন পেশিশক্তি দেখাতে পারলেই মনোনয়ন পেয়ে যাবেন। এর সমাধান হতে পারত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রার্থী মনোনয়ন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের দলের নেতৃত্ব গঠন। বিএনপির নেতারা বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে তাঁরা ঠিকমতো সম্মেলন করতে পারেননি। কিন্তু মুক্ত স্বাধীন ১১ মাসে তাঁরা কতটি উপজেলা, জেলা, পৌরসভা ও মহানগর কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে করেছেন, এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না।

প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে বিএনপি নেতৃত্ব এখন বলছেন, যেসব আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি বা প্রার্থিতা নিয়ে সাংঘাতিক বিরোধ রয়েছে, যা মিটমাট না হলে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা আছে, এমন এলাকাগুলোর দিকেই তাঁরা নজর দিচ্ছেন। সে জন্য স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতাকে বিভাগভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা দলের একক প্রার্থী নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদের একসঙ্গে গুলশানের কার্যালয়ে ডেকে কথা বলছেন। কাজটি অনেক আগেই করা যেত। দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বেশ সতর্কতার সঙ্গে বলেছেন, এটি চূড়ান্ত তালিকা নয়; বরং নির্বাচনপূর্ব ‘প্রাক্‌–রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সেটি দলীয় কোন্দল মেটাবে কি না বড় প্রশ্ন।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, এবার প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় দলটি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক দক্ষতা, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং এলাকার জনসম্পৃক্ততাকে। অতীতে আর্থিক সামর্থ্য ও প্রভাবশালীদের ওপর নির্ভর করার প্রবণতা থাকলেও এবার তৃণমূল নেতাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। নীতিগত সিদ্ধান্ত আর কার্যকারিতার মাঝখানে যে বিরাট ফারাক আছে, সেটিও তাঁদের মনে করিয়ে দিই। এমন অনেক আসন আছে, যেখানে বিএনপির একাধিক বড় নেতা আছেন, সেসব আসনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবেন, সেটিও ভাবার বিষয়। বিএনপি তো এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। ২০১৮ সালে নিগৃহীত অবস্থায়ও মনোনয়ন নিয়ে মারামারি, মহাসচিবের বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটতে দেখেছি। ফলে নেতাদের আশ্বাস ও জরিপ কতটা কাজে লাগবে, সেসব ভেবে দেখার বিষয়।  

আরেকটি সমস্যা হলো, যেসব আসন বিএনপি সহযোগীদের ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে, সেসব আসনে দলের নেতাদের সামাল দিতে পারবে কি না? ইতিমধ্যে বেশ কিছু আসনে সহযোগীদের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। সহযোগী একটি দলের প্রধান আক্ষেপ করে জানিয়েছেন, ‘তাঁকে নিজ এলাকায় সমাবেশ করতে লন্ডনে ফোন করতে হয়েছে। স্থানীয় বিএনপির নেতারা এতটাই বেপরোয়া।’

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নারী ভোটারদের লক্ষ্য করে জামায়াত সারা দেশে নিজেদের মহিলা বিভাগের কর্মীদের মাঠে নামিয়েছে। কুমিল্লার বরুড়া থেকে এক সাংবাদিক বন্ধু জানান, সেখানে ঘরে ঘরে জামায়াতের নারী কর্মীরা প্রচারে নেমেছেন। তাঁরা প্রতিটি বাড়িতে যাচ্ছেন, তাঁদের সমস্যার কথা জানতে চাইছেন। আর পুরুষ কর্মীরা হাটবাজারে সমাবেশ করছেন, মসজিদে মুসল্লিদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন।

এখানেও বিএনপি পিছিয়ে আছে। জামায়াতের এ কৌশল মোকাবিলায় নারী ভোটারদের লক্ষ্য করে বিএনপিও নারীসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিচ্ছে। ১৪ অক্টোবর খুলনা থেকে তাদের এই কর্মসূচি শুরু হবে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব এত দিন সময় নিল কেন? মাঠে তো তাঁরাই নির্বাচনের কথা বেশি বলছেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতিতে কেন তাঁরা পিছিয়ে?

সোহরাব হাসান সাংবাদিক ও কবি

[email protected]

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় স প ট ম বর প রক র য় র লক ষ য ব এনপ র সব আসন স ঘর ষ কর ম র হয় ছ ন গঠন ক বলছ ন আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপি কেন প্রার্থী বাছাইয়ে পিছিয়ে...

আনুপাতিক হারে ভোটের (পিআর) দাবি সামনে এনে জামায়াতে ইসলামী মাঠে আন্দোলনে নেমে বিএনপি নেতাদের ব্যস্ত রাখলেও নিজেরা বর্তমান পদ্ধতিতেই নির্বাচনী প্রস্তুতিতে এগিয়ে আছে। দেশের নির্বাচনী আসনের প্রায় সব কটিতে তারা সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাদের পোস্টারও টানানো হচ্ছে কোথাও কোথাও। স্থানীয় নেতা–কর্মীরা সেটি সানন্দে মেনে নিয়েছেন এবং সম্ভাব্য প্রার্থীর পক্ষে জোর প্রচারও চালাচ্ছেন।

প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়েও তাঁরা আগের মতো—যিনি যত প্রবীণ, তিনি বড় হকদার; এই নীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে দলটি বেশ কিছু আসনে তরুণ নেতাদের বেছে নিয়েছে। এ কারণে প্রবীণ কয়েকজন নেতা বাদ পড়লেও কোনো প্রতিবাদ বা আপত্তি ওঠেনি। এটাই হচ্ছে দলটির সাংগঠনিক শৃঙ্খলা। একসময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতেও এই শৃঙ্খলা বজায় ছিল। এখন সেখানেও গ্রুপিং, ভাগাভাগি।

আরও পড়ুনবিএনপি যখন সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার৩১ আগস্ট ২০২৫

অন্যদিকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন করার আগে দলীয় সংঘাত মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে বলা হলো, এ পর্যন্ত সাত হাজার নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কতটি সংঘাতের ঘটনায় কতজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই হিসাব দিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব আত্মতৃপ্তি পেতে পারেন; কিন্তু মানুষ দেখতে চায় দলের নেতা–কর্মীদের সংঘাত বন্ধ হচ্ছে কি না। শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে কি না।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত আট মাসে ৭৬ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে কেবল বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় মারা গেছেন ৫৮ জন। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর হিসাব করলে এই সংখ্যা শতকের ঘর ছাড়িয়ে যাবে।

এ ক্ষেত্রে বিএনপির নেতারা যেসব দোহাই দেন, সেটি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতারাও দিতেন। তঁাদের বড় দল, বিশাল কর্মী বাহিনী। দু–চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে; কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কী হবে? তারা কার কাছে প্রতিকার চাইবে? এখানে বলার সুযোগ নেই যে অনুপ্রবেশকারীরা এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

এখানেও বিএনপি পিছিয়ে আছে। জামায়াতের এ কৌশল মোকাবিলায় নারী ভোটারদের লক্ষ্য করে বিএনপিও নারীসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিচ্ছে। ১৪ অক্টোবর খুলনা থেকে তাদের এই কর্মসূচি শুরু হবে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব এত দিন সময় নিল কেন? মাঠে তো তাঁরাই নির্বাচনের কথা বেশি বলছেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতিতে কেন তাঁরা পিছিয়ে?

এখানে তিনটি উদাহরণ দিই। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ২৯ সেপ্টেম্বর নরসিংদী সদরের চরাঞ্চলে আবারও বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবদলের স্থানীয় এক নেতা নিহত হয়েছেন। সেপ্টেম্বর মাসে ওই এলাকায় এ নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি যখন নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার, তখনো অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নরসিংদীতে দলীয় নেতা–কর্মী মারা গেছেন।

নরসিংদীর পাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিস্থিতিও কম উদ্বেগজনক নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানাকে ‘বহিরাগত’ উল্লেখ করে তাঁকে ঠেকাতে একজোট হয়েছেন দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাত নেতা। আগামী নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে প্রার্থী হতে চান বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক রুমিন ফারহানা। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি চট্টগ্রাম–৬ (রাউজান) আসনে। সেখানে এখন পর্যন্ত ১৫ জন খুন হয়েছেন। আসনটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও উত্তর জেলা বিএনপির সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার। এই দুই নেতার অনুসারীরাই সেখানে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। অথচ আওয়ামী লীগ আমলে উভয় পক্ষের অনুসারীরাই নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, মামলা–গ্রেপ্তারের কারণে দীর্ঘদিন ঘরছাড়া ছিলেন।

আরও পড়ুনবিএনপিই কি তবে মধ্যপন্থী রাজনীতির শেষ ভরসা২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কেবল নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাউজান নয়; দেশের অনেক জেলা–উপজেলায় যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, তার পেছনেও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। তাঁরা ভাবেন পেশিশক্তি দেখাতে পারলেই মনোনয়ন পেয়ে যাবেন। এর সমাধান হতে পারত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রার্থী মনোনয়ন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের দলের নেতৃত্ব গঠন। বিএনপির নেতারা বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে তাঁরা ঠিকমতো সম্মেলন করতে পারেননি। কিন্তু মুক্ত স্বাধীন ১১ মাসে তাঁরা কতটি উপজেলা, জেলা, পৌরসভা ও মহানগর কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে করেছেন, এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না।

প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে বিএনপি নেতৃত্ব এখন বলছেন, যেসব আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি বা প্রার্থিতা নিয়ে সাংঘাতিক বিরোধ রয়েছে, যা মিটমাট না হলে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা আছে, এমন এলাকাগুলোর দিকেই তাঁরা নজর দিচ্ছেন। সে জন্য স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতাকে বিভাগভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা দলের একক প্রার্থী নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদের একসঙ্গে গুলশানের কার্যালয়ে ডেকে কথা বলছেন। কাজটি অনেক আগেই করা যেত। দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বেশ সতর্কতার সঙ্গে বলেছেন, এটি চূড়ান্ত তালিকা নয়; বরং নির্বাচনপূর্ব ‘প্রাক্‌–রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সেটি দলীয় কোন্দল মেটাবে কি না বড় প্রশ্ন।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, এবার প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় দলটি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক দক্ষতা, আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং এলাকার জনসম্পৃক্ততাকে। অতীতে আর্থিক সামর্থ্য ও প্রভাবশালীদের ওপর নির্ভর করার প্রবণতা থাকলেও এবার তৃণমূল নেতাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। নীতিগত সিদ্ধান্ত আর কার্যকারিতার মাঝখানে যে বিরাট ফারাক আছে, সেটিও তাঁদের মনে করিয়ে দিই। এমন অনেক আসন আছে, যেখানে বিএনপির একাধিক বড় নেতা আছেন, সেসব আসনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবেন, সেটিও ভাবার বিষয়। বিএনপি তো এখন ক্ষমতার কাছাকাছি। ২০১৮ সালে নিগৃহীত অবস্থায়ও মনোনয়ন নিয়ে মারামারি, মহাসচিবের বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটতে দেখেছি। ফলে নেতাদের আশ্বাস ও জরিপ কতটা কাজে লাগবে, সেসব ভেবে দেখার বিষয়।  

আরেকটি সমস্যা হলো, যেসব আসন বিএনপি সহযোগীদের ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে, সেসব আসনে দলের নেতাদের সামাল দিতে পারবে কি না? ইতিমধ্যে বেশ কিছু আসনে সহযোগীদের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। সহযোগী একটি দলের প্রধান আক্ষেপ করে জানিয়েছেন, ‘তাঁকে নিজ এলাকায় সমাবেশ করতে লন্ডনে ফোন করতে হয়েছে। স্থানীয় বিএনপির নেতারা এতটাই বেপরোয়া।’

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নারী ভোটারদের লক্ষ্য করে জামায়াত সারা দেশে নিজেদের মহিলা বিভাগের কর্মীদের মাঠে নামিয়েছে। কুমিল্লার বরুড়া থেকে এক সাংবাদিক বন্ধু জানান, সেখানে ঘরে ঘরে জামায়াতের নারী কর্মীরা প্রচারে নেমেছেন। তাঁরা প্রতিটি বাড়িতে যাচ্ছেন, তাঁদের সমস্যার কথা জানতে চাইছেন। আর পুরুষ কর্মীরা হাটবাজারে সমাবেশ করছেন, মসজিদে মুসল্লিদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন।

এখানেও বিএনপি পিছিয়ে আছে। জামায়াতের এ কৌশল মোকাবিলায় নারী ভোটারদের লক্ষ্য করে বিএনপিও নারীসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিচ্ছে। ১৪ অক্টোবর খুলনা থেকে তাদের এই কর্মসূচি শুরু হবে। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব এত দিন সময় নিল কেন? মাঠে তো তাঁরাই নির্বাচনের কথা বেশি বলছেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতিতে কেন তাঁরা পিছিয়ে?

সোহরাব হাসান সাংবাদিক ও কবি

[email protected]

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ