শিক্ষক সমাজ গঠনের প্রধান কারিগর। তাঁরা শুধু জ্ঞান বিতরণ করেন না, বরং তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগান, তাদের স্বপ্ন দেখতে শেখান এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। শিক্ষক দিবস হলো সেই বিশেষ দিন, যেদিন আমরা শিক্ষকদের অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) এই দিনটি ঘোষণা করে। এ বছরের শিক্ষক দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’—যা শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার রূপান্তরমূলক সম্ভাবনা তুলে ধরে।

কেন শিক্ষক দিবস গুরুত্বপূর্ণ

বিশ্বের নানা দেশে শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপিত হয় শিক্ষকদের অবদানকে শ্রদ্ধা জানাতে। আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষক আছেন—যাঁরা জ্ঞান দেন, মূল্যবোধ শেখান, ধৈর্য ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। প্রত্যেক মহান চিন্তকের পেছনেই একজন শিক্ষক আছেন, যিনি তাঁর চিন্তার জগৎকে আলোকিত করেছেন। তাই শিক্ষকের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য অপরিহার্য।

২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য

এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’—শিক্ষকদের একক ও বিচ্ছিন্ন অবস্থান থেকে বের করে এনে একটি সম্মিলিত পেশাগত পরিচয়ে প্রতিষ্ঠার আহ্বান। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকেরা প্রায়ই শ্রেণিকক্ষে একা পাঠদান করেন, অথচ তাঁদের পেশাগত উন্নয়ন, মানসিক সুস্থতা কিংবা আধুনিক পাঠদানের জন্য সহযোগিতামূলক কাঠামো এখনো সীমিত। এই একাকিত্ব শিক্ষার মানকে ব্যাহত করে এবং পেশায় টিকে থাকার আগ্রহকেও কমিয়ে দেয়। তাই ২০২৫ সালের লক্ষ্য হলো শিক্ষকতাকে এমন এক পেশা হিসেবে রূপান্তর করা, যেখানে পারস্পরিক সমর্থন, জ্ঞান বিনিময় ও সম্মিলিত দায়িত্ববোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সহযোগিতা শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন ও সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। নীতি ও পরিবেশে পারস্পরিক সমর্থন, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি এবং যৌথ দায়িত্ববোধ জোরদার করা দরকার। এর মাধ্যমে শিক্ষকেরা হবেন আরও দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী, আর শিক্ষার্থীরা পাবে আরও সমৃদ্ধ ও কার্যকর শিক্ষা—যা শেষ পর্যন্ত জাতির ভবিষ্যৎকে করবে আলোকিত।

শিক্ষকের হাতে ভবিষ্যৎ নির্মাণ

শিক্ষকেরা ভবিষ্যতের স্থপতি। তাঁরা শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতি দেন না; বরং শিক্ষার্থীদের জীবন ও সমাজের জন্য প্রস্তুত করেন। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের আজীবন শিক্ষার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করেন। ইন্টারনেটে তথ্যের প্রাচুর্যের মাঝেও শিক্ষকের কাজ হলো শিক্ষার্থীকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া, সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে শেখানো এবং সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা গড়ে তোলা।

শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীর মধ্যে কৌতূহল, দৃঢ়তা ও দায়িত্ববোধের মতো গুণাবলি তৈরি করেন। এর মাধ্যমে তাঁরা শুধু একজন শিক্ষার্থী নয়, ভবিষ্যতের সচেতন নাগরিক ও নেতৃত্ব তৈরি করেন। বাস্তব উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি—মাত্র তিন দিন আগে আমার এক ছাত্র জাপানে সরকারি (মনবুকাগাকুশো) স্কলারশিপে গেছে। তার একাডেমিক ফলাফল আগে ভালো ছিল না, কিন্তু তিন বছর ধরে তিনি আমার সঙ্গে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন, আমি তাকে গাইড করেছি, সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছি। তার কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং আমার নির্দেশনার ফলে আজ সে আন্তর্জাতিক পরিসরে তার শিক্ষাজীবন শুরু করতে পারছে। এটি প্রমাণ করে—একজন শিক্ষক কেবল পাঠদানকারী নয়, বরং একজন মেন্টর, যিনি শিক্ষার্থীর জীবন ও ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারেন।

২০২৫-এর নতুন শিক্ষণপদ্ধতি

শিক্ষক দিবস ২০২৫-এ একটি বড় আলোচনার বিষয় হলো শিক্ষকদের উদ্ভাবনী শিক্ষণপদ্ধতি। প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন শ্রেণিকক্ষ আরও প্রাণবন্ত ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। ইন্টারেকটিভ হোয়াইটবোর্ড, ভার্চ্যুয়াল ল্যাব, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আরও গভীরভাবে শিখছে।

একই সঙ্গে সামাজিক-মানসিক শিক্ষা শিক্ষার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সহমর্মিতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সমস্যা সমাধান ও সামাজিক দক্ষতা গড়ে তুলতে সাহায্য করছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা কেবল ভালো শিক্ষার্থীই নয়, বরং জীবনের জটিল বাস্তবতার জন্যও প্রস্তুত হয়ে উঠছে।

শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপনের কিছু উপায়

শিক্ষক দিবসকে অর্থবহ করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে—১.

শ্রেণিকক্ষে উদ্‌যাপন: শিক্ষার্থীরা ধন্যবাদপত্র, ছবি, বা ছোট্ট প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে। ২. সর্বজনীন স্বীকৃতি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্থানীয় অনুষ্ঠান বা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষকদের সম্মান জানানো যেতে পারে। ৩. পেশাগত উন্নয়ন কর্মশালা: শিক্ষকদের জন্য কর্মশালা আয়োজন করলে তাঁরা নতুন প্রযুক্তি ও শিক্ষণপদ্ধতির সঙ্গে আপডেট থাকতে পারবেন। ৪. শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ: শিক্ষার্থীরা ভিডিও বার্তা বা ব্যক্তিগত নোটের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে শিক্ষকের মনোবল আরও বৃদ্ধি পায়।

চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

উন্নত দেশগুলো জিডিপির গড়ে ৪-৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করলেও বাংলাদেশে তা মাত্র ২ শতাংশ। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা বাজেট এবং শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার ঘাটতি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে বড় বাধা। অথচ একজন শিক্ষকই পারেন একটি প্রজন্মকে আলোকিত করতে এবং জাতিকে এগিয়ে নিতে। আমার দীর্ঘ ২৪ বছরের শিক্ষকতা জীবনে প্রত্যক্ষ করেছি—একজন শিক্ষকের সঠিক দিকনির্দেশনা শিক্ষার্থীর পুরো জীবন পাল্টে দিতে পারে। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষক কর্মরত আছেন গ্রামীণ বিদ্যালয়ে, যেখানে তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত্তি গড়ে তুলছেন। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে শিক্ষকেরা গবেষণা, উদ্ভাবন ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখছেন। অর্থাৎ গ্রামীণ শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার—সবখানেই শিক্ষকের অবদান জাতি গঠনের মূল চালিকা শক্তি।

জাপানে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সেখানে শিক্ষকদের প্রতি সামাজিক সম্মান প্রায় পূর্ণতা পেয়েছে। শিক্ষককে বলা হয় ‘সেনসেই’—যা জীবন-প্রদর্শকের প্রতীক। সমাজে তাঁদের অবস্থান এত উচ্চ যে প্রায়ই ‘কামিসামা’ বা দেবতার মর্যাদা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জাপান জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে, নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতও মানসম্মত রাখে।

আমাদের দেশেও যদি আমরা একইভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযথ বাজেট বরাদ্দ করি, নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত উন্নত রাখি, তাহলে মালালা ইউসুফজাইয়ের সেই কথার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে—‘একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি বই, এক কলম পৃথিবী পরিবর্তন করতে পারে।’

এতে শিক্ষার মান উন্নত হবে এবং জাতির ভবিষ্যৎ আরও শক্তিশালী হবে। তাই এখনই প্রয়োজন জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ, তরুণদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করা এবং শিক্ষকদের মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।

শিক্ষক দিবস ২০২৫ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—শিক্ষকেরা কেবল জ্ঞান দেন না, বরং শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ, দক্ষতা ও স্বপ্ন গড়ে তোলেন। নতুন প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী শিক্ষণপদ্ধতি আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে শিক্ষকেরা ভবিষ্যতের বিশ্বনাগরিক তৈরি করছেন। আজকের দিনে আমরা যদি শিক্ষকদের যথাযথ স্বীকৃতি, সম্মান ও সহায়তা দিতে পারি, তবে তাঁরা আরও শক্তি ও অনুপ্রেরণা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। শিক্ষকেরাই সেই নীরব নায়ক, যাঁদের হাত ধরে নতুন প্রজন্মের আলোকিত পথচলা শুরু হয়। আর জাতির টেকসই অগ্রযাত্রা নির্ভর করছে তাঁদের হাতেই।

ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও গবেষক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক ষ ব যবস থ একজন শ ক ষ শ ক ষকদ র প রস ত ত প রজন ম র অবদ ন শ ক ষকত নত ন প আল ক ত র জন য প শ গত সহয গ

এছাড়াও পড়ুন:

সীমান্ত ব্যাংকে চাকরি, আবেদন অনলাইনে

সীমান্ত ব্যাংক পিএলসি জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। ব্যাংকটিতে ‘অফিসার-অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজারের (অফিসার-প্রিন্সিপাল অফিসার)’ শূন্য পদে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হবে। ১ অক্টোবর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আবেদন করতে হবে অনলাইনে।

পদের নাম: অফিসার-অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার (অফিসার-প্রিন্সিপাল অফিসার), প্রোকিউরমেন্ট।

পদসংখ্যা: নির্ধারিত নয়।

শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্নাতক অথবা সমমান।

অভিজ্ঞতা: সংশ্লিষ্ট কাজে প্রার্থীদের ৩-৭ বছরের অভিজ্ঞতা থাকেত হবে।

আবেদনে বয়সসীমা: ৩০-৪০ বছর।

কর্মস্থল: ঢাকা।

বেতন: আলোচনা সাপেক্ষে।

সুযোগ–সুবিধা: বেতন ছাড়াও নির্বাচিত প্রার্থীদের আরও সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে।

আবেদনের পদ্ধতি: আগ্রহী প্রার্থীরা এখানে ক্লিক https://jobs.bdjobs.com/jobdetails/?id=1413564&fcatId=2&ln=1 করে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন।

আবেদনের শেষ সময়: ৭ অক্টোবর, ২০২৫।

আরও পড়ুনট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পদে নিয়োগ দিচ্ছে ইসলামী ব্যাংক২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫আরও পড়ুনজাহাঙ্গীরনগরের সামিয়া ইসলাম চার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কেন অক্সফোর্ডকেই বেছে নিলেন০১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আজ টিভিতে যা দেখবেন (৫ অক্টোবর ২০২৫)
  • আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২৫
  • রাবির ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা ১৬ জানুয়ারি
  • দুর্নীতি দমন কমিশনে ৮৫ পদে নিয়োগ, আবেদন করুন দ্রুত
  • অক্সফামে নিয়োগ, বছরে বেতন ২৯ লাখ ১৮ হাজার
  • আজ প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা
  • আজ টিভিতে যা দেখবেন (৪ অক্টোবর ২০২৫)
  • আজ টিভিতে যা দেখবেন (৩ অক্টোবর ২০২৫)
  • সীমান্ত ব্যাংকে চাকরি, আবেদন অনলাইনে