বিবিসির সাক্ষাৎকারে ‘নতুন’ তারেক রহমান
Published: 7th, October 2025 GMT
প্রায় ১৭ বছর পর গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা গেল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে। এর আগে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তিনি তাঁর দলের নেতৃত্বের শীর্ষে যেমন ছিলেন না, তেমনি অভিজ্ঞতার ঝুলিটাও এতটা সমৃদ্ধ ছিল না।
আজকের মতো অনির্ধারিত প্রশ্নোত্তর, ১৭ বছরের লম্বা বিরতি, জমে থাকা হাজারো প্রশ্ন, বিব্রতকর জিজ্ঞাসা, ব্যক্তিগত–পারিবারিক তথ্যানুসন্ধান, সুদীর্ঘ কথোপকথন—এই সবকিছুর মুখোমুখি হয়ে কতটা সপ্রতিভ থাকতে পারবেন তিনি, সে জিজ্ঞাসা ছিল অনেকেরই। শুরুতে আড়ষ্টতা কিছুটা ছিল না, তেমন বোধ হয় বলা যাবে না। তবে সময় যত গড়িয়েছে, ততটাই স্বচ্ছন্দে তিনি সব প্রশ্ন সামলেছেন।
পুরোটা দেখে মনে হয়েছে, উত্তর দেওয়ার সময় তাঁর মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি অন্তর দিয়ে যেটা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেছেন নির্দ্বিধায়। প্রচলিত রাজনীতিতে অস্পষ্টতা রেখে, পরোক্ষ বা গা বাঁচানো উত্তর দেওয়াটাই যখন প্রায় প্রথাসিদ্ধ বলেই সবাই জানে। কোনো প্রশ্ন পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছেন এমনও নয়, কথা বলেছেন বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী অবস্থান থেকে। এটা তাঁর অনুসারী, দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করবে সন্দেহ নেই।
পতিত স্বৈরাচারের বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে সাবলীলভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন, ‘নির্যাতনকারী প্রত্যেকের বিচার হতে হবে। এটা প্রতিশোধের বিষয় নয়। এটা ন্যায়ের কথা, আইনের কথা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্যায় করে থাকলে দেশের আইন অনুযায়ী তারও বিচার হতে হবে।’কথা বলার সময় তিনি যতটা না দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অবস্থান থেকে কথা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সচেষ্ট ছিলেন তাঁর কথোপকথনে জাতীয় ঐক্যের সুরটা যেন আরও বেশি বলিষ্ঠ শোনা যায়।
তাঁর বক্তব্যের এ ধারা দেশের রাজনৈতিক সুস্থতার জন্য অনেক প্রয়োজন। প্রতিপক্ষকে অনাবশ্যক আক্রমণের সুযোগ যেমন নেননি, তেমনি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এক সাধারণ মানুষের মতো ভদ্রোচিত অস্বস্তিতে ছিলেন, যেন তাঁর কোনো কথাতেই আত্মম্ভরিতা বা অহংকার প্রকাশিত না হয়। শ্রোতা–দর্শকের কাছে তাঁর এ অভিব্যক্তি নিশ্চয়ই নজর এড়াবে না।
সাবেক রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর সন্তান, এমন সৌভাগ্যের সঙ্গে জনগণকে তাচ্ছিল্য করার প্রচলিত সংস্কৃতির সঙ্গে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া দর্শক–শ্রোতাকে আবারও সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি, সেটাও এ সাক্ষাৎকারে অন্যতম প্রাপ্তি।
আরও পড়ুনজামায়াত এগিয়ে, বিএনপি কেন পিছিয়ে ০৪ অক্টোবর ২০২৫তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে এত দিন যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে দলের নেতা-কর্মীরা প্রায়ই অস্পষ্টতার আশ্রয় নিতেন, সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই সেটা স্পষ্ট করেছেন অনেকটাই। বলেছেন, ‘কিছু সংগত কারণে এখনো দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনি। এখন ফেরার সময় চলে এসেছে। দ্রুতই দেশে ফিরব ইনশা আল্লাহ।’
সেই সংগত কারণের মধ্যে নিরাপত্তা ছাড়াও হয়তো এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেটা আমাদের মতো সাধারণের বোধের বিষয় নয়। তবে তাঁর বা জিয়া পরিবারের নিরাপত্তার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর বাংলাদেশের খোলনলচে বদলে যাওয়ার মতো ঝুঁকি যে আছে, সেটা সম্ভবত সাধারণের অজানা নয়। স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? নির্বাচনের সময় জনগণের সঙ্গে, জনগণের মধ্যেই থাকব ইনশা আল্লাহ।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। সবিনয়ে যথার্থই বলেছেন, এখানে মাস্টারমাইন্ড কোনো ব্যক্তি বা দল নয়। দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণই গণ-অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড। এ উপলব্ধি সর্বজনীন হলে আমরা জাতীয় ঐক্যের অনেক কাছাকাছি পৌঁছাতে পারতাম।
আরও পড়ুনবিএনপি কি এখন নতুন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫পতিত স্বৈরাচারের বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে সাবলীলভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন, ‘নির্যাতনকারী প্রত্যেকের বিচার হতে হবে। এটা প্রতিশোধের বিষয় নয়। এটা ন্যায়ের কথা, আইনের কথা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্যায় করে থাকলে দেশের আইন অনুযায়ী তারও বিচার হতে হবে।’
এ স্পষ্ট কথাগুলো বলে তিনি আওয়ামী লীগকে নিয়ে তার দলের বিরুদ্ধে তথাকথিত প্রশ্রয় বা নমনীয়তা নিয়ে যে অভিযোগ বা অনুযোগ রয়েছে, সেটার নিষ্পত্তি তিনি কোনো রাখঢাক ছাড়াই করে দিয়েছেন।
আগামী নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে তিনি প্রচলিত গৎবাঁধা কথার বাইরে যেতে পেরেছেন, সেটাও এ পরিবর্তিত বাংলাদেশের জন্য নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘তাঁকেই মনোনয়ন দিতে চাই, যিনি তাঁর এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ, তরুণ, নারী, মুরব্বি, ছাত্রছাত্রী—সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। জনসমর্থনকে যিনি তাঁর সঙ্গে রাখতে পারেন। আমরা দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছি না; বরং এমন মানুষ খুঁজে বের করতে চাই যাঁর প্রতি এলাকার মানুষের সমর্থন রয়েছে, শুধু দলের সমর্থন নয়—এমন মানুষ।’
আরও পড়ুনবিএনপি কি জয়ের আভাস পেয়ে প্রচলিত পথেই হাঁটছে২৯ মে ২০২৫তাঁর কথায় প্রচলিত রাজনীতির চলমান ধারার বাইরের কথাগুলো তাঁর অন্তরের কথা হলে ভবিষ্যতে দলের প্রার্থী নির্বাচনে আমরা ‘প্রকৃত’ যোগ্য প্রার্থীর সমাগম দেখতে পাব, এমন প্রত্যাশা রাখতে চাই।
পারিবারিক ধারাবাহিকতায় উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরণ কি না? এমন স্পর্শকাতর প্রশ্নেও অভিব্যক্তির ভাবান্তর না ঘটিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই বলেছেন, বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারায় মামলা, নির্যাতন, পারিবারিক বঞ্চনা—এগুলো যেমন স্বাভাবিক পুরস্কার, সেগুলোর প্রতিটি পর্বই তাঁর জীবনে এসেছে নির্মমভাবে।
জেলযাত্রার আগে সুস্থ মা জেল থেকে ফিরেছেন মরণব্যাধি সঙ্গে নিয়ে। বিনা চিকিৎসায় বিদেশে মৃত্যুবরণ করেছেন একমাত্র ভাই। স্ত্রীকে বাংলাদেশে সম্মানজনক চিকিৎসা পেশায় সুযোগ বঞ্চিত হতে হয়েছে, একমাত্র মেয়ে বঞ্চিত হয়েছেন কৈশোর ও তারুণ্য থেকে। নিজে বঞ্চিত হয়েছেন নেতা-কর্মী আর মায়ের সান্নিধ্য থেকে। এক দিন, দুই দিন নয়, পুরো দেড় যুগ।
আরও পড়ুনবিএনপি কি তরুণ প্রজন্মের চাওয়া বুঝতে পারছে০৬ এপ্রিল ২০২৫দূর প্রবাস থেকে চরম অসহায়ত্বে দর্শক হয়ে থেকেছেন, যখন আশৈশব স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মায়ের অসম্মানজনক উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে শুনেছেন কেমন চরম আক্রোশে সেই বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক অভিযাত্রায় তিনি যে জবরদখল করেননি, সেটার ইতিহাসও সবার জানা। শুরু করেছেন তৃণমূলের কর্মী হিসেবে। তারপর ওয়ান ইলেভেনের যন্ত্রণা সয়েছেন, যখন দলের যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।
বিবিসির সাক্ষাৎকারে সম্মানের সঙ্গে মা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকারের অবশিষ্টাংশ শুনতে পেলে হয়তো শেষের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ থাকবে। তবে প্রচলিত রাজনৈতিক কদর্যতা, চরিত্রহনন আর অশ্লীল আক্রমণের বাইরে একটা শোভন সাক্ষাৎকারের স্মৃতি শ্রোতা–দর্শক অনেক দিনই মনে রাখবেন।
আরও পড়ুনপানি সমস্যায় সরকার ও বিএনপি কি আশা দেখাচ্ছে২৭ এপ্রিল ২০২৫শেষ কথা, একজন জাতীয় নেতার কাছে জনগণ যে আন্তরিকতা খুঁজতে চায়, তারেক রহমান সে প্রত্যাশার কাছাকাছি নিজেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকভাবে। বিব্রতকর বা স্পর্শকাতর বলে এত দিন যে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা অস্বস্তি বোধ করতাম, তিনি সেগুলো এত পরিষ্কার আর প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করেছেন যে প্রচলিত রাজনীতিতে আজ যাঁরা হেভিওয়েট, তাঁরা জনগণের মনের গভীরে স্থান নিতে চাইলে নিজেদের বদলাতেই হবে।
অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর সাবেক অধ্যক্ষ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া
*মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব চ র হত র জন ত ক অবস থ ন বল ছ ন অন য য় কর ছ ন রহম ন র সময় ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
ফতুল্লায় বাসের ধাক্কায় পথচারীর মৃত্যু, আহত ২ : বাস ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে মৌমিতা বাসের ধাক্কায় মোজাম্মেল হক (৫৫) নামে এক পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এসময় বাসের আঘাতে দুই ইজিবাইক চালক গুরুতর আহত হোন।
এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনগণ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বাসটি ভাঙচুর করে সড়কে অগ্নিসংযোগ করেন।
পরে তারা বাসচালক রুবেল (২৪) ও হেলপার নাঈম শেখকে (২৫) গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। সোমবার (৬ অক্টোবর) দুপুর আড়াইটার দিকে লিংক রোডের জেলা পরিষদের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতের মোজাম্মেল হক ফতুল্লার দক্ষিণ সস্তাপুর এলাকার মোক্তার হোসেনের পুত্র। আহত দুই ইজিবাইক চালক আনিসুর রহমান (৩৮) মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের বসতগাঁও এলাকার মৃত আজিজুর রহমানের ও রানা বাবু (৪০) জয়পুরহাট জেলার নিক্তিপাড়ার তমিজউদদীন প্রামাণিকের ছেলে।
ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন জানান, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জগামী মৌমিতা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস সড়কে অপেক্ষমান দুইটা ইজিবাইকে সজোরে ধাক্কা মারে।
এতে আনিসুর রহমান ও রানা বাবু নামের দুই অটোরিকশা চালক গুরুতর আহত হয়। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনগণ বাসচালক ও হেলপারকে গণধোলাই দেয়। আহত চারজনই নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিহতের খবর জানাতে না পারলেও নারায়ণগঞ্জ ৩শ শয্যা হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা.শাহাদাত হোসেন জানান, সড়ক দূর্ঘটনায় মোজাম্মেল হক (৫৫) নামের একজন নিহত হয়েছে। আহত আরো দুজনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এছাড়াও গণপিটুনিতে আহত বাসের চালক ও হেলপারকে এখানে আনা হয়েছে। তাদেরকেও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।