‘মারিয়া কোরিনা মাচাদো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন’—এ শিরোনাম প্রথম যখন দেখলাম, তখন খুশি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি; কারণ, এতে খুশির কিছু নেই। যাঁর রাজনীতি অগণিত মানুষের জীবনে অনন্ত দুর্ভোগ এনেছে, সেই ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা নিছক ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়।

মাচাদো আসলে কিসের প্রতীক, তা যাঁরা বোঝেন, তাঁরা জানেন, তাঁর রাজনীতির সঙ্গে ‘শান্তি’ শব্দটির কোনো সম্পর্কই নেই। যদি ২০২৫ সালের ‘শান্তি’ বলতে এটাই বোঝানো হয়, তাহলে বলা যেতে পারে, নোবেল পুরস্কার তার সব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।

আমি ভেনেজুয়েলায় জন্মগ্রহণকারী একজন আমেরিকান। আমি খুব ভালো জানি মাচাদো কিসের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি হলেন ওয়াশিংটনের রেজিম চেঞ্জ যন্ত্রের (কোনো দেশের এক সরকারকে ফেলে দিয়ে অন্য সরকারকে বসানোর ব্যবস্থা) হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তিনি হলেন নিষেধাজ্ঞা, বেসরকারীকরণ ও বিদেশি হস্তক্ষেপকে ‘গণতন্ত্র’ নামে সাজিয়ে তোলার এক সুশীল কণ্ঠস্বর। মাচাদোর রাজনীতি সহিংসতায় ভরপুর। তিনি প্রকাশ্যে বিদেশি হস্তক্ষেপকে আহ্বান জানিয়েছেন।

এমনকি গাজা ধ্বংসের খলনায়ক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকেও তিনি বলেছেন, তিনি যেন বোমা মেরে ভেনেজুয়েলাকে ‘মুক্ত’ করেন। তিনি নিজের দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন; অথচ তিনি জানেন, অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা নীরব যুদ্ধেরই একটি রূপ।

মাচাদোর জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিভাজন সৃষ্টি করে, ভেনেজুয়েলার সার্বভৌমত্ব ক্ষয় করে এবং জনগণের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার কেড়ে নিয়ে তিনি তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবন কাটিয়েছেন।

মারিয়া কোরিনা মাচাদো ২০০২ সালের সেই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টকে অল্প সময়ের জন্য উৎখাত করেছিল। তিনি ‘কারমোনা ডিক্রি’-তে স্বাক্ষর করেছিলেন, যা কিনা রাতারাতি সংবিধান বিলুপ্ত ও সব সরকারি প্রতিষ্ঠান বাতিল করে দিয়েছিল। তিনি ওয়াশিংটনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘রেজিম চেঞ্জ’কে ন্যায্যতা দিতে কাজ করেছেন। তিনি বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ‘বলপ্রয়োগের মাধ্যমে’ ভেনেজুয়েলাকে ‘মুক্ত’ করা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী বক্তব্য ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত ‘মাদকবিরোধী অভিযানের’ নামে এক সম্ভাব্য আঞ্চলিক যুদ্ধের ইন্ধন জুগিয়েছে, মাচাদো সেই বক্তব্য ও সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।

ট্রাম্প যখন ভেনেজুয়েলার সম্পদ জব্দ করছিলেন, মাচাদো তখন ট্রাম্পের স্থানীয় প্রতিনিধি হতে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ট্রাম্পের হাতে তুলে দিতে তৈরি ছিলেন।

মাচাদো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে কাজ করেছেন। অথচ তিনি ভালো করেই জানতেন, গরিব, অসুস্থ ও শ্রমজীবী মানুষদের এর মূল্য দিতে হবে। তিনি সেই তথাকথিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন, যা আসলে ওয়াশিংটনের অর্থায়নে পরিচালিত এক পুতুল প্রশাসনের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট দ্বারা পরিচালিত। দেশে শিশুরা অনাহারে যখন মারা যাচ্ছিল, তখন সেই প্রেসিডেন্ট দেশের সম্পদ লুট করে বাইরে পাচার করছিলেন।

মাচাদো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি জেরুজালেমে ভেনেজুয়েলার দূতাবাস পুনরায় চালু করবেন। অর্থাৎ তিনি সেই একই বর্ণবাদী রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াবেন, যারা ‘আত্মরক্ষা’র কথা বলে হাসপাতালে বোমা মারে। এখন তিনি দেশের তেল, পানি ও অবকাঠামো বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চান।

যে নব্য–উদার ফর্মুলা নব্বইয়ের দশকে লাতিন আমেরিকাকে দুর্ভোগের পরীক্ষাগারে পরিণত করেছিল, তিনি ঠিক সেই ফর্মুলা অনুসরণ করেন।

২০১৪ সালের ‘লা সালিদা’ নামে যে সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল, মাচাদো তার অন্যতম স্থপতি ছিলেন। ওই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের পতন ঘটানো। বিদেশি সংবাদমাধ্যম এগুলোকে ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ’ বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে তখন রাস্তা অবরোধ করে, বিভিন্ন স্থাপনা জ্বালিয়ে, শ্রমিকবাহী বাস পুড়িয়ে সহিংস বিক্ষোভ করা হচ্ছিল।

সে সময় কাউকে হুগো চাভেজের অনুসারী মনে হলে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা পর্যন্ত হয়েছে। চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স, এমনকি কিউবার চিকিৎসা ব্রিগেডকেও সে সময় আক্রমণ করা হয়েছিল। কেউ কেউ তখন আগুনে পুড়ে মরতে বসেছিল। ধ্বংস করা হয়েছিল সরকারি ভবন, খাদ্যবাহী ট্রাক, স্কুল। পুরো এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে। আর সেই সময় মাচাদো টেলিভিশনে তাকে ‘প্রতিরোধ’ বলে প্রশংসা করেছেন।

ট্রাম্প যে পদক্ষেপের মাধ্যমে অভিবাসী শিশুদের খাঁচায় আটকে রেখেছিলেন, অনেক পরিবারকে আলাদা করে দিয়েছিলেন এবং ট্রাম্পের যে নীতির কারণে আজ হাজারো ভেনেজুয়েলান মা তাঁদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে ফিরছেন, সেই কুৎসিত উদ্যোগ ও নীতিকে মাচাদো ‘দৃঢ় পদক্ষেপ’ বলে প্রশংসা করেছেন।

এ–ই যদি হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের যোগ্যতা, তবে শান্তি শব্দটা অপমানিত হবে। আসলে মাচাদো শান্তির প্রতীক নন। তিনি আসলে বৈশ্বিক এক জোটের অংশ, যেখানে ফ্যাসিবাদ, জায়নবাদ ও নব্য–উদারনীতি (নিওলিবারালিজম) জড়িত।

এই জোট মুখে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘শান্তি’র কথা বলে, কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্য হলো দমন ও আধিপত্য। ভেনেজুয়েলায় এই মতবাদ মানে ছিল অভ্যুত্থান, নিষেধাজ্ঞা ও বেসরকারীকরণ। গাজায় এর মানে হলো গণহত্যা ও জাতিগতভাবে ফিলিস্তিনিদের সত্তাকে মুছে ফেলা। দুই জায়গায় নীতিটা এক। এই নীতির কাছে কিছু জীবন তুচ্ছ; সার্বভৌমত্ব বিক্রিযোগ্য আর সহিংসতাকে ‘শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা’ বলে বিক্রিও করা যায়।

তবে হেনরি কিসিঞ্জার যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন, তবে মারিয়া কোরিনা মাচাদো কেন পাবেন না? ‘অধিকার দখলের মধ্যেও সহানুভূতি’ দেখানোর জন্য হয়তো আগামী বছর ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ও এই পুরস্কার পেয়ে যেতে পারে। প্রতিবার যখন এই পুরস্কার কোনো সহিংসতার স্থপতিকে ‘কূটনীতিক’ সাজিয়ে দেওয়া হয়, তখন তা প্রকৃত শান্তিকর্মীদের মুখে থুতু ছিটানোর মতো মনে হয়।

অথচ প্রকৃত শান্তিকর্মীরা হলেন গাজার ধ্বংসস্তূপে লাশ তোলা চিকিৎসকেরা, জীবন বাজি রেখে সত্য তুলে ধরা সাংবাদিকেরা আর সেই মানবিক ত্রাণকর্মীরা, যাঁরা ফ্লোটিলায় করে শিশুদের জন্য খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দিতে গিয়ে ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু আসল শান্তি কোনো পুরস্কার বা বড় সম্মেলনে তৈরি হয় না। সেই পুরস্কার গড়ে ওঠে অবরোধের সময় মানুষকে খাওয়াতে এগিয়ে আসা নারীদের হাতে, নদী রক্ষায় লড়াই করা আদিবাসীদের ঐক্যে, শ্রমিকদের অবিচল সংগ্রামে আর সেই ভেনেজুয়েলান মায়েদের প্রতিবাদে, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির কারণে হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের ফেরত চান।

এই শান্তি পুরস্কার প্রাপ্য ভেনেজুয়েলা, কিউবা, ফিলিস্তিন ও পুরো বৈশ্বিক দক্ষিণের—যে শান্তি আত্মসমর্পণের নয়, বরং স্বাধীনতা ও মর্যাদার পক্ষে দাঁড়ায়।

মিশেল এলনার কোডপিংক নামের নারী আন্দোলনমূলক একটি শান্তি ও সামাজিক সংগঠনের সমন্বয়ক

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত বামপন্থী ধারার ওয়েবসাইট কমন ড্রিমস থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ব ল প রস ক র প রস ক র প ব সরক র কর ছ ন র জন ত অবর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

টকদইয়ের সঙ্গে যেসব খাবার খেলে হিতে বিপরীত

স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের কাছে টকদই খুবই সমাদৃত খাবার। ডায়েটে টকদই রাখলে একাধিক রোগের ঝুঁকি এড়ানো যায়। যারা স্লিম থাকতে চান, তারা ব্রেকফাস্টে ওটসের সঙ্গে দই খান, আবার কেউ দুপুরে রায়তা বানিয়ে খান। টকদইয়ের সঙ্গে ভাত থেকে শুরু করে বাদাম, মধুর মতো বিভিন্ন নির্ভয়ে খাওয়া যায়। তবে তবে এমন কিছু খাবার রয়েছে, যা দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। 

পেঁয়াজ
অনেকেই পেঁয়াজ দিয়ে রায়তা বানান। এতে গ্যাস-অম্বলের সমস্যা বাড়ে। টকদইয়ের সঙ্গে পেঁয়াজ খেলে শরীর গরম হয়ে যায়। পেঁয়াজ ও টইদই একসঙ্গে খেলে এটি সহজে হজম হবে না। ত্বকেও এর প্রভাব পড়তে পারে।

আরো পড়ুন:

‘সঠিক চিকিৎসা নিলে স্তন ক্যানসার থেকে বাঁচা সম্ভব’

আজ বিশ্ব ডিম দিবস

টক ফল
টকদইয়ের সঙ্গে স্ট্রবেরি, ব্লুবেরির মতো ফল খাওয়া যায়। কিন্তু লেবুজাতীয় ফল একেবারেই খাওয়া চলে না। এমনকী যে সব ফলে অ্যাসিডের পরিমাণ অত্যধিক বেশি, সেগুলো দইয়ের সঙ্গে খাবেন না। এতে শরীরে টক্সিনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা দেখা দেয়। 

দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার
দুধ থেকেই দই তৈরি হয়। কিন্তু দুধ ও দই একসঙ্গে খাওয়া যায় না। এই দুই খাবারেই প্রোটিন ও ফ্যাট রয়েছে। দুধ ও দই একসঙ্গে খেলে বুক জ্বালা, পেট ব্যথা, গা গোলানোর মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এই দুই খাবার আলাদা খাওয়াই ভালো।

চা
খাওয়ার পরেই দই খাবেন না। এমনকি দই খাওয়া শেষ হলেই চায়ে চুমুক দেওয়া চলবে না। এতে শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়তে পারে। বমি, পেট খারাপ হতে পারে। বদহজম এড়াতে চা ও দই একসঙ্গে খাবেন না।

ভাজাপোড়া খাবার
অনেকেই পরোটার সঙ্গে টকদই খান। এই অভ্যাস মোটেই ভালো নয়। ভাজাভুজি খাবারের সঙ্গে টকদই খেলে মারাত্মক অ্যাসিডিটি হয়। এতে বদহজমের সমস্যা বাড়ে। তাই সুস্থ থাকতে ভাজাভুজি খাবারের সঙ্গে টকদই সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলুন। 

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টকদইয়ের সঙ্গে যেসব খাবার খেলে হিতে বিপরীত
  • রেখার সিঁদুর রহস্য