বিচার গান আমাদের সংস্কৃতির একটি অসাধারণ অঙ্গ। কোনো একটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ তর্কে মাতেন দুই পক্ষ, কথা বলেন, গান গান, প্রশ্নের উত্তর দেন, নতুন প্রশ্নও তোলেন। এভাবে আলাপে আলাপে শরিয়ত-মারেফত, জীবাত্মা-পরমাত্মা, নারী-পুরুষ, গুরু-শিষ্য—বিবিধ বিষয়ে শ্রোতারা পক্ষ আর বিপক্ষের যুক্তিগুলোর সাথে পরিচিত হন।

গুরুগম্ভীর তত্ত্বের আলাপ সেখানে যে ভঙ্গিতে উত্থাপিত হয়, সমবেতমণ্ডলী তাতে কখনো হেসে ফেলেন, কখনো গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। গায়কেরা সেখানে চর্বিতচর্বণ উপস্থাপন করেন না, নতুন নতুন ভাবনার খোরাক দিতে না পারলে তিনি আকর্ষণ হারাবেন। ফলে মুখস্থ করা কথা আর রপ্ত করা সুর আদৌ যথেষ্ট না; সংগত কারণেই বিচারগানের কিংবদন্তিরা নিজেরাও একেকজন মৌলিক ভাবুক। গুরুর সঙ্গে থেকে থেকেই শিষ্যরা রপ্ত করেন তাঁদের কৌশল।

বিচারগান উপস্থাপন কৌশল যেমন, একই সঙ্গে তা বুদ্ধিবৃত্তিরও চর্চা। আরবি-ফারসি সংস্কৃত–ঐতিহ্য থেকে আসা পরিভাষা ও ভাবনার ছড়াছড়ি সেখানে—নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠায় তারা হাতড়ে বেড়ান তামাম দুনিয়া।

হাঙ্গামা যে লাগত না, তা নয়। সব চাইতে বেশি হাঙ্গামা শরিয়ত-মারেফত নিয়ে। শরিয়তে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে একটা পর্যায়ের পর ভাবারও অনুমতি নেই ধর্মীয় নির্দেশনায়। কিন্তু এর পরও মানুষের মন কি মানে! ভাবনার এই প্রেরণাও তো অনেকে পান ধর্মগ্রন্থ থেকে।

জগতের অসীমতা উপলব্ধি করতে এই মানবিক সীমাবদ্ধতা নিয়েই অসীমের ভাড়ারে উঁকি দেয়ার যে চেষ্টা শতকের পর শতক ধরে বাংলার ভাবুকদের মধ্যে চলমান, বিচার গানে তারই ধারাটি বয়ে চলেছে। আবুল সরকার তাঁর গ্রেফতার হওয়ার দিনেও গানে গানে যখন বলেন—

‘দয়ালরে, ও দয়াময়

তুমি জুড়িয়াছ পুতুল খেলা

আমার তাতে কিসের জ্বালা

পরাজয় কি জয়ের মালা

পরাও তোমার মন মতন

তবে কেন দোষী আমি

ওহে প্রভু নিরঞ্জন’

এই গানের মাঝে সেই বিস্ময়ই আছে, যে বিস্ময়ে আরবের ‘জাবারিয়া’ আর ‘কাদারিয়া’রা মানবভাগ্য পূর্বনির্ধারিত কি না, নির্ধারিত হলে মানুষের পাপ–পুণ্যের বিচার কীভাবে সম্ভব—সেই তর্কগুলো করেছেন। ধর্মত্তত্ব, দর্শন ও জ্ঞানের এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা চায় মানুষ, বিচার গানে আসলে চির অমীমাংসিত সেই বিষয়গুলো নিয়েই নিত্য আলোচনা হয়। তর্কযুদ্ধে প্রশ্নের ছলে পরস্পরকে ঠেস দেওয়া, শ্লেষ করা চলে, কখনো কখনো তর্ক চলে যায় উষ্মার পর্যায়ে—কিন্তু বহুবার দেখেছি দুই বিবদমান পক্ষ বিচার শেষে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন, প্রশংসা করেন, শ্রদ্ধা জানান।

দর্শক শ্রোতাদের মনেও কি এই তর্কশেষের মিলনের অনুভূতিটা গভীরভাবে কাজ করে না? অজস্র প্রশ্ন আর ভাবনা নিয়ে তারা বাড়ি ফেরেন, প্রশ্ন আর জবাবগুলো ছড়িয়ে দেন গ্রামান্তরে, নতুন নতুন প্রশ্ন আর জবাবও তৈরি করেন নিজের জন্য।

এই তো আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে সহিষ্ণুতার ভিত্তি!

পালাগানের আসরে আবুল সরকার.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

হংকংয়ে আবাসিক কমপ্লেক্সে লাগা আগুন ৪২ ঘণ্টা পর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, মৃতের সংখ্যা ১২৮

হংকং শহরে প্রায় ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বিশাল আবাসিক ভবন কমপ্লেক্সে উদ্ধার অভিযান আজ শুক্রবার শেষ করার আশা করছে স্থানীয় দমকল কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছে, এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১২৮ হয়েছে। এখনো নিখোঁজ প্রায় ২০০ জন। এ ছাড়া ৪২ ঘণ্টা পর এ আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

আমরা সাতটি ভবনের সব ইউনিটে ঢুকে খুঁজে দেখব, যেন নিশ্চিত হতে পারি, আর কেউ ভেতরে আটকে নেই।ডেরেক চ্যান, হংকংয়ের দমকল বিভাগের উপপরিচালক

উত্তরাঞ্চলীয় তাই পো এলাকায় অবস্থিত ‘ওয়াং ফুক কোর্ট’ আবাসন কমপ্লেক্সে ওই আগুন লাগার পর দমকল সদস্যরা আজ সকালেও কাজ করছিলেন। ৮টি ভবন নিয়ে গড়া এ কমপ্লেক্সে ৪ হাজার ৬০০-এর বেশি মানুষ থাকতেন। ভবনগুলোতে সংস্কারকাজ চলছিল এবং পুরো কমপ্লেক্স বাঁশের মাচা ও সবুজ নিরাপত্তা জালে ঢাকা ছিল। ফলে গত বুধবার বিকেলের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

পুলিশ বলেছে, জানালায় দাহ্য ফোম বোর্ডসহ ভবনগুলোতে অনিরাপদ নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় এক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মকর্তাকে অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দমকল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আজই তারা শেষবারের মতো অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা আজ সকালে ৯৪ বলে জানানো হলেও পরে তা বেড়ে ১২৮ হয়েছে। এটি আরও বাড়তে পারে। আহত হয়েছেন অন্তত ৭৯ জন।

বৃহস্পতিবার ভোরে নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২৭৯। আজ হালনাগাদ করে তা ২০০ জানানো হয়। গতকাল উৎকণ্ঠিত এক মা তাঁর মেয়ের স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠানের ছবি হাতে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে মেয়েকে খুঁজছিলেন। আটটি আশ্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে ৯০০ জন রয়েছেন বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

আজ সকালে দমকল বিভাগের উপপরিচালক ডেরেক চ্যান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সাতটি ভবনের সব ইউনিটে ঢুকে খুঁজে দেখব, যেন নিশ্চিত হতে পারি, আর কেউ ভেতরে আটকে নেই।’

গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২৭৯। গত ২৪ ঘণ্টায় এ সংখ্যা হালনাগাদ করে ২০০ বলে জানানো হয়। চ্যান বলেন, তাঁদের দপ্তরে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে করা ২৫টি ফোনকল এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক তিনটি কলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুনহংকংয়ের অগ্নিকাণ্ড ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৯৪৭ ঘণ্টা আগেওয়াং ফুক কোর্ট আবাসন কমপ্লেক্সে আগের দিন লাগা ভয়াবহ আগুনের স্থানের কাছে হাঁটছেন এক ব্যক্তি। গতকাল বৃহস্পতিবারও সেখানে আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছিল। হংকং, চীন, ২৭ নভেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ