রেলস্টেশনে জন্মের পর হাসপাতালে রেখে নিখোঁজ মা, নতুন পরিবারে ঠাঁই পেল নবজাতক
Published: 28th, November 2025 GMT
শীতের গভীর রাত। কুয়াশায় ডুবে থাকা রেলস্টেশনের নিস্তব্ধতা ভাঙে এক নবজাতকের কান্নায়। প্ল্যাটফর্মের এক পাশে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীর কোলে জন্ম নেয় ফুটফুটে কন্যাশিশুটি। কান্নার আওয়াজ পেয়ে সেখানে ছুটে যান স্থানীয় কয়েকজন নারী। তাঁরাই মা ও নবজাতককে নিয়ে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু ওই রাতে নবজাতকটিকে ফেলে নিখোঁজ হন মা।
অসহায় সেই নবজাতকের খবর পৌঁছে যায় দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা প্রশাসনের কাছে। চিকিৎসক-নার্সদের যত্নের পর আইনি প্রক্রিয়া মেনে অবশেষে নতুন আশ্রয় পেয়েছে নবজাতকটি। গতকাল বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে ওই নবজাতককে তুলে দেওয়া হয় ইকবাল হোসেন-সাবিনা আক্তার দম্পতির কোলে। তাঁরা আগে থেকেই নবজাতকের নাম ফাতেমা জান্নাত তুবা ভেবে রেখেছিলেন। তাকে কোলে নিয়ে আনন্দে সেই নামে ডেকে ওঠেন তাঁরা।
ওই নবজাতকের অভিভাবকত্ব পেয়েছেন ইকবাল হোসেন। তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার। তাঁর স্ত্রী সাবিনা আক্তার গৃহিণী। তাঁরা বিরামপুর পৌর শহরের কলেজ বাজার এলাকার বাসিন্দা। এই দম্পতির দুই ছেলে। তাঁরা নাম-পরিচয়হীন ওই মেয়ে নবজাতককে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন।
বিরামপুর রেলস্টেশনের দোকানি ও স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, দুই-তিন মাস ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন ও অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী স্টেশন ও এর আশপাশে ঘুরে বেড়াতেন। কেউ খাবার দিলে খেতেন। রাতে প্ল্যাটফর্মেই ঘুমাতেন। ৯ নভেম্বর রাতে স্টেশনটির প্ল্যাটফর্মে একটি মেয়েসন্তানের জন্ম দেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নবজাতকটির জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মা উধাও হন। খবর পেয়ে অনেকেই অসহায় নবজাতকের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখান। পরে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন পাঁচ দম্পতি। একপর্যায়ে বিকল্প পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে নবজাতকটির নামে জমি লিখে দেওয়ার শর্ত দেয় উপজেলা প্রশাসন। শর্ত মেনে ইকবাল-সাবিনা দম্পতি ২২ শতাংশ জমি লিখে দিতে রাজি হন। অবশেষে দালিলিকভাবে শর্ত পূরণ করায় নবজাতকটিকে ওই দম্পতির কাছে তুলে দেওয়া হয়।
নবজাতককে কোলে নিয়ে উচ্ছ্বাস করেন ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মেয়েসন্তান নেই। মেয়েটির জন্মের খবর পাওয়ার পর আমার দুই ছেলে এই নবজাতককে নেওয়ার অনুরোধ করে। উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মেয়েটি নিলাম। আমি যেন মেয়েটিকে মানুষ করতে পারি এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি।’
নবজাতকের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, লালন-পালনের সক্ষমতা ও ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বিকল্প পরিচর্যক হিসেবে ওই দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইউএনও নুজহাত তাসনীম। তিনি বলেন, ‘নবজাতককে কোথায় বা কার কাছে দেব, এটি আমাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সে যেন ভালো একটি পরিবারে যায়, এ জন্য আমরা সবার সঙ্গে পরামর্শ করেছি। ভবিষ্যতেও তার খোঁজখবর নেবে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা সমাজসেবা দপ্তর।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নবজ তকট নবজ তকক উপজ ল ইকব ল
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষাব্যবস্থায় টিউশননির্ভরতা, সমাধান কোথায়
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমেই টিউশননির্ভর হয়ে উঠছে। স্কুল-কলেজে নিয়মিত ক্লাস থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিউশন ছাড়া স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। ফলে শিক্ষার মান, শিক্ষকের ভূমিকা ও পারিবারিক ব্যয়—সবকিছুতেই সৃষ্টি হচ্ছে এক অদৃশ্য চাপ।
টিউশননির্ভরতার প্রধান কারণ হলো শ্রেণিকক্ষে কার্যকর পাঠদানের অভাব। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীসংখ্যা বেশি, শিক্ষক কম; ফলে ব্যক্তিগত মনোযোগ পাওয়া কঠিন। অনেক শিক্ষক স্কুলের ক্লাসে কম মনোযোগ দিয়ে টিউশনকে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন। ফলে শিক্ষার্থীরা মনে করে, ভালোভাবে বোঝার জন্য দায়বদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়; বরং ব্যক্তিগত কোচিংয়ে যেতে হবে। এ ধারণা ধীরে ধীরে সমাজে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে অভিভাবকেরাও নিরাপত্তার চাদর হিসেবে টিউশনকে বেছে নেন। তাঁদের বিশ্বাস, টিউশন ছাড়া সন্তান প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এতে শিক্ষাগত ব্যয় অযথা বেড়ে যাচ্ছে, আর শিক্ষার্থীরা জ্ঞান নয়, শুধু পরীক্ষাকেন্দ্রিক প্রস্তুতিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
সমাধান খুঁজতে হলে প্রথমে প্রয়োজন স্কুল ও কলেজে পাঠদানের মান উন্নয়ন। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি এবং শ্রেণিকক্ষে আধুনিক শিক্ষণ-পদ্ধতি কার্যকর করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের ছোট দলে বিভক্ত করে ‘ফোকাসড লার্নিং’ চালু করা যেতে পারে। পাশাপাশি অভিভাবকদের বোঝাতে হবে—শিক্ষার আসল শক্তি হচ্ছে বোঝাপড়া, শুধু মুখস্থবিদ্যায় নয়।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত থাকলেও টিউশন ছাড়া আত্মবিশ্বাস পায় না। ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের যথেষ্ট মনোযোগ না পাওয়াই টিউশননির্ভরতার প্রধান কারণ। অন্যদিকে ৫২ শতাংশ অভিভাবক বিশ্বাস করেন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য টিউশন অপরিহার্য। আকর্ষণীয়ভাবে, ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায়, টিউশন তাদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ায়। জরিপে আরও উঠে এসেছে, ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী চায়, স্কুলেই যদি মানসম্মত পাঠদান হতো, তবে টিউশনের প্রয়োজন অনেকটাই কমে যেত।
টিউশননির্ভরতা কমাতে সবচেয়ে জরুরি হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল ক্লাসকে কার্যকর ও আকর্ষণীয় করে তোলা। প্রথমত, শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ ও নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে তাঁরা আধুনিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব পদ্ধতিতে পাঠদান করতে পারেন। শ্রেণিকক্ষ ছোট দলে ভাগ করে ‘ফোকাসড লার্নিং’ ব্যবস্থা চালু করলে প্রতিটি শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত মনোযোগ পাবে এবং টিউশনের প্রয়োজন কমবে। অভিভাবকদের সচেতন করাও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের বোঝাতে হবে, সন্তানকে টিউশনের চাপ নয়; বরং বাড়িতে পড়ার অভ্যাস, সময় ব্যবস্থাপনা ও স্বনির্ভর শেখার দক্ষতা গড়ে তোলা বেশি জরুরি। টিউশনকে অপরিহার্য হিসেবে নয়; বরং অতিরিক্ত সহায়তা হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
সবশেষে স্কুলে একটি ‘হেল্প সেশন’ বা ‘রেমিডিয়াল ক্লাস’ চালু করা যেতে পারে, যেখানে দুর্বল শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত সহায়তা পাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান ও জবাবদিহি বাড়াতে পারলেই ধীরে ধীরে টিউশননির্ভরতার চক্র ভাঙা সম্ভব।
টিউশননির্ভরতা যে ক্ষতিকর চক্র তৈরি করেছে, তা ভাঙতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। মূল ক্লাসকে কার্যকর করা, শিক্ষকের দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীর বোঝাপড়া নিশ্চিত করাই সমাধানের প্রকৃত পথ। টিউশন বিকল্প সহায়তা হতে পারে, কিন্তু মূল শিক্ষা কখনোই নয়। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষ—সব পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই আমরা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারব, যেখানে টিউশনের ওপর চাপ কমে গিয়ে স্কুলই হবে শেখার প্রধান ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ স্থান। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাই টিউশননির্ভরতা কমানোর সর্বশেষ উপসংহার।
সানিয়া তাসনিম শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়