আত্তাহিয়াতু শেষ করে কেবল সালাম ফিরিয়েছেন, মোনাজাতের জন্য তখনো হাত তোলেননি। বাইরে রাত কেটে আলো ফুটেছে কিন্তু ফিনকি দিয়ে সে আলোর ফালি ছড়িয়ে পড়েনি তখনো। ফজরের নামাজের প্রান্তে মোনাজাতের আদ্যক্ষণে প্রকৃতির সমস্ত সাদা পবিত্রতাকে চিরে, ছিঁড়ে খানখান করে উত্তর বাড়ির প্রাঙ্গণ থেকে আকাশের দিকে উঠে গেল একটা বিকট অশ্রাব্য সম্ভাষণ। চৌধুরী বাড়ির মুন্সি আফজাল সাহেব জায়নামাজের ওপরই একবার মুখ বিকৃত করে ফেললেন সে শব্দে। চেষ্টা করলেন, দুকানকে কিছু না শুনিয়ে শূন্যে এমনি ঝুলিয়ে রাখতে। প্রাণপণ চেষ্টা করলেন জোড়া হাতের প্রশস্ত গহ্বরে মনকে নিমজ্জিত করে আল্লাহর কাছে পৌঁছুতে। পৃথিবী থেকে পালিয়ে সম্পূর্ণ মায়ামুক্ত দিল দিয়ে চাইলেন জলদি জলদি মোনাজাত খতম করতে।
আফজাল সাহেব পরহেজগার মুসল্লি হলেও এমন কিছু সুফি আউলিয়া ছিলেন না, কাজেই মোনাজাত করবার সময়ও উত্তর বাড়ির প্রাঙ্গণ থেকে ছদু মিয়ার কণ্ঠস্বর তিনি সর্বক্ষণ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন। ছদু মিয়ার যেমন গলা তেমনি ভাষা। অর্থজ্ঞাপক অঙ্গভঙ্গিও যে নিশ্চয়ই সব সময় ভাষাপ্রয়োগকে টীকা হিসেবে অনুসরণ করে চলছিল, তা-ও আফজাল সাহেব অজু করা রেখাঙ্কিত হাতে স্পষ্ট দেখতে পান।
ছদু মিয়া গালি দিচ্ছে। লক্ষ্যবস্তু বাড়ির কেউ। বেশি দূরে হলেও সে নিশ্চয়ই পাঁচ-দশ হাতের মধ্যেই উপস্থিত আছে; কিন্তু গলার স্বর গ্রামের দূরতম গৃহকোণের গভীরতম নিদ্রায় মগ্ন মানুষকে হঠাৎ উচ্চকিত করে তুলবার পক্ষে যথেষ্ট। আর যে বিষয়বস্তু সে কণ্ঠ দিয়ে নিঃসৃত হচ্ছিল, তার ভাবার্থ হয় না। দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তিও সম্ভব নয়। যেমন তার বেগ, তেমনি তার আবেগ। সে গালিগালাজ দুপুর অবধি চললেও মনে হবে যেন ছদু মিয়ার নিরবচ্ছিন্ন প্রথম বাক্যটাই ব্যাকরণসম্মতভাবে এখনো শেষ হয়নি। প্রতি উচ্চারণেই সে একটা করে নতুন যৌন সম্পর্ক স্থাপন করছে। এই মুহূর্তে নিজের আপন ভাইকে, মাকে, বউকে, বোনকে সম্বোধন করছে নিজের ঔরসজাত সন্তান বলে। আবার পরমুহূর্তেই এদের প্রত্যেকের আগত এবং অনাগত প্রতিটি সন্তানের দেহসংগত জন্মদাতা বলে নিজের দাবিও জানিয়ে রাখছে নির্বিকার চিত্তে।
তসবির ছড়া লম্বা কোর্তার পকেটে পুরে আফজাল মুন্সি এবার উঠে দাঁড়ালেন। আকাশ ভরে এখন ছদু মিয়ার কণ্ঠস্বর, সে বিষ ঠেলে আরও ওপরের কোনো পুণ্যস্তরে ভক্তের পবিত্র আর্তনাদ হয়তো পৌঁছাবে না। ছদু মিয়ার প্রতিটি স্পষ্ট উক্তি কখন যেন অলক্ষ্যে পিছলে ঢুকে পড়েছে মুন্সি সাহেবের মনের মধ্যেও চকচকে সাপের পিঠের মতো ইচ্ছেমতো কিলবিল করে বেড়াচ্ছে এখন।
চারদিক আবার শান্ত না হলে খোদার কথায় মন দেওয়া মুন্সি সাহেবের পক্ষে সম্ভব নয়। নামাজের পাটি থেকে উঠে খড়ম জোড়া পায়ে দিলেন। পুকুরের ডান পাড় দিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন উত্তর বাড়ির দিকে। অনেক রকম বিলাপ ও গর্জনের মধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু ছদু মিয়ার কণ্ঠ একাগ্রচিত্তে শুনেছেন। আর তার খণ্ড খণ্ড সূত্র ধরে প্রাণপণে বুঝতে চেষ্টা করছেন পুরো ঘটনাটা।
উত্তর বাড়ির আঙিনায় ঢুকে মুন্সি সাহেব আরও হকচকিয়ে গেলেন। ছদু মিয়া একটা ভাঙা পুরানো নৌকার বইঠা তুলে বারবার চেষ্টা করছে পাশের বন্ধ দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। হুংকারে হুংকারে ঘোষণা করছে, হত্যা করার অটল সংকল্প। পাশের মসজিদে যারা নামাজ পড়তে এসেছিল, তারাই ভিড় করে রয়েছে ছদু মিয়াকে ঘিরে।উত্তর বাড়ির আঙিনায় ঢুকে মুন্সি সাহেব আরও হকচকিয়ে গেলেন। ছদু মিয়া একটা ভাঙা পুরানো নৌকার বইঠা তুলে বারবার চেষ্টা করছে পাশের বন্ধ দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। হুংকারে হুংকারে ঘোষণা করছে, হত্যা করার অটল সংকল্প। পাশের মসজিদে যারা নামাজ পড়তে এসেছিল, তারাই ভিড় করে রয়েছে ছদু মিয়াকে ঘিরে। চার-পাঁচজন চেপে ধরে রেখেছে অসংবৃত লুঙ্গিতে আধঢাকা কামিজহীন, ছদু মিয়ার স্ফীত মাংসপেশির ঘর্মাক্ত কালো বলিষ্ঠ দেহটাকে। কেউ তাকে উপদেশ দিচ্ছে, কেউ হুমকি, কেউ অনুনয়ও করছে। কিন্তু ছদু অপরিবর্তিত; শরীরে, আওয়াজে, ভাষায় ভয়ংকর রকম বেসামাল।
মুন্সি সাহেব বুঝলেন, বন্ধ ঘরের মধ্যেই এমন একটি লোক আছে, যাকে ছদু খুন করতে চায়, কিন্তু কেন? আশ্চর্য, আজ উঠানের একটি লোকও মুন্সি সাহেবের শান্ত, সৌম্য, গম্ভীর মুখ দেখে একবারের জন্যও সসম্ভ্রমে সালাম জানাল না। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দেখেও কেউ একটি পিঁড়ি এনে দিল না। অথচ এই মুন্সি সাহেবের মুখের কথা এ গাঁয়েই শরিয়তের শেষ ফতোয়ার মতো মান্য। উত্তেজনায় এত বেখেয়াল হয়ে আছে সবাই। এমনি নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ আর এমন চাঞ্চল্যকর দৃশ্য দেখা চলে। মুন্সি সাহেবেরও ধৈর্যের সীমা আছে, কৌতূহলের শুরু হয়। একবার মুন্সি সাহেব ইশারা করে একে ডাকেন, আবার ওকে। আদ্যোপান্ত সব ঘটনা জানার জন্য মুন্সি সাহেব ব্যগ্র, চঞ্চল, রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
কয়েক মাস আগে ছদু খেতে গেছে ধান নিড়াতে। রান্নার কাজ সেরে তফুরী বিবি ঘরের দাওয়ায় বসে পাটি বুনছিল। স্বামীর কিশোরী ছোট বোন হঠাৎ কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এসে ভাবির গলা জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। একটা বেতের চাঁছা লতা ঠিক ঘর মতো বসাতে যাবে, এমন সময় ননদের আকস্মিক সোহাগ এসে বাধা দিল কাজে। কৃত্রিম রাগের ঢঙে ধমকে উঠল,
‘এইলা উলালে দেখি একছার বাছছ না আর। তোর কি আইজ হাঙ্গা লাইগছে নি। ছাড়, গলা ছাড়ি দে।’
‘একখানে অ্যাক মজার ছিজ দ্যেই আইছি ভাবি, কইত্যাম না আঁই।’
মজার জিনিস আবিষ্কার করে যে অত উৎফুল্ল হয়ে ভাবির কাছে তা প্রকাশ করতে ছুটে আসে, সে জিনিস সম্পর্কে কিছুই গোপন রাখা যে ফজিলতের উদ্দেশ্য নয়, এ কথা বোঝা পানির মতো সোজা। বরঞ্চ প্রথমে রহস্য সৃষ্টি করে, পরে প্রকাশের ইচ্ছের মধ্যে একটা কিছু স্বার্থ লুকোনো থাকা সম্ভব। তফুরীর কল্পনা মিছে নয়। ভাবিকে চুপ করে থাকতে দেখে ফজিলতই আবার গায়ে পড়ে বলে, ‘এক খাওনের জিনিস, বড় মজার। হুইনলেই জিহ্বাৎ হানি আইব।’
মুনীর চৌধুরীর গল্পগ্রন্থ একটি তালাকের কাহিনি ও অন্যান্য গল্প অর্ডার করতে ক্লিক করুন
প্রথমা থেকে প্রকাশিত ‘একটি তালাকের কাহিনি ও অন্যান্য গল্প’.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
স্মৃতির আলোয় নতুন করে দেখা
জন্মশতবর্ষে দুই স্বনামখ্যাত শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণায় বিস্মৃতির আড়াল থেকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হলেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
বহুভাবেই শহীদ মুনীর চৌধুরীর পরিচয় দেওয়া যায়। তিনি দেশের প্রাগ্রসর চেতনার অগ্রগামী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য শিক্ষক, কৃতী ভাষাবিদ, গবেষক, দেশের আধুনিক নাটকের জনক, অনুবাদক, বাম রাজনীতিক আর শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো বক্তা। তাঁর সেই গুণাবলির বিশদ পরিচয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। উপলক্ষ ছিল মুনীর চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন।
মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই আয়োজন করে নাট্যদল থিয়েটার। অনুষ্ঠানের ছিল দুটি পর্ব। ‘মহারাজ, একি সাজে এলে’ গানের সঙ্গে তাহেনানিয়া ইসলামের নৃত্য পরিবেশনা দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। এরপর ছিল থিয়েটার প্রবর্তিত ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’ ও মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতি পুরস্কার প্রদান।
মুনীর চৌধুরী সম্মাননা দুই বছর পরপর দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের এই সম্মাননা পেয়েছেন নাট্যজন শিমূল ইউসুফ। তরুণ নাট্যকর্মীদের জন্য মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন বাকা বাবুল (২০২৩) ও আবদুল্লাহ আরিফ (২০২৪)। অতিথিরা তাঁদের হাতে স্মারক ও অর্থমূল্যের চেক তুলে দেন।
শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর দুই স্বনামখ্যাত শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে