মানুষের জীবন এক অনন্ত জিজ্ঞাসা ও প্রত্যাশার নাম। আমরা প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখি, আকাঙ্ক্ষা করি এমন কিছু যা আমাদের বর্তমানকে ছাপিয়ে যায়—আরও সুন্দর, আরও নিখুঁত। দুনিয়ার জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ, দ্রুতগামী বিলাসবহুল গাড়ি কিংবা প্রযুক্তির অভাবনীয় সব আবিষ্কার—এসবই মানুষের মনকে ক্ষণিকের জন্য তৃপ্তি দেয়, কিন্তু সেই তৃপ্তি দ্রুতই ফুরিয়ে যায়।
মন তখন নতুন কিছুর খোঁজে হাঁসফাঁস করে। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাসের বাইরেও কি এমন কোনো সুখ আছে যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কোনো মানব হৃদয়েও যার কল্পনা আসেনি? ইসলামি বিশ্বাসে, মুমিনদের জন্য মহান আল্লাহ তেমনই এক চিরন্তন সুখের জগত প্রস্তুত করে রেখেছেন, যা আমাদের সীমিত কল্পনাকে অতিক্রম করে যায়।
যা চোখে দেখেনি কেউএকটি হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ এই চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.
এই হাদিসের কয়েকটি বর্ণনায় আরও বলা হয়েছে, "তা কোনো নিকটবর্তী ফেরেশতা বা কোনো প্রেরিত নবীও জানেন না।" এই কথাটি জান্নাতের নিয়ামতসমূহের এক অপার্থিব মর্যাদা তুলে ধরে। এটি এমন এক গুপ্ত ধন, যা মানুষের সীমিত উপলব্ধি ও অনুভূতির ঊর্ধ্বে।
আরও পড়ুনজান্নাত ও জাহান্নাম থেকে মানুষ কখন কতটা দূরে১৩ এপ্রিল ২০২৪“তোমাকে তা দেওয়া হলো এবং তার সমপরিমাণ আরও দশ গুণ দেওয়া হলো, আর তোমার জন্য রয়েছে যা তোমার মন কামনা করবে এবং তোমার চোখ তৃপ্তি পাবে।” সে বলবে, আল্লাহ, আমি সন্তুষ্ট।মুসা (আ.)-এর জিজ্ঞাসা ও জান্নাতের স্তরএই হাদিসের পটভূমি নিয়ে আলিমগণ আলোচনা করেছেন।
নবী মুসা (আ.) একবার তাঁর প্রতিপালককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জান্নাতবাসীদের মধ্যে সর্বনিম্ন মর্যাদার অধিকারী কে হবেন। আল্লাহ তাআলা জবাবে বললেন, সে এমন একজন ব্যক্তি হবে, যে জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশের পর আসবে। তাকে বলা হবে, জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক, কীভাবে? যখন সবাই নিজ নিজ মর্যাদা গ্রহণ করেছে এবং তাদের প্রাপ্তিগুলো নিয়ে নিয়েছে?
তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট হবে যে তোমাকে দুনিয়ার রাজাদের মধ্যে একজনের রাজত্বের মতো সম্পত্তি দেওয়া হবে? সে বলবে, আমি সন্তুষ্ট। আল্লাহ বলবেন, “তোমাকে তা দেওয়া হলো এবং তার সমপরিমাণ আরও দশ গুণ দেওয়া হলো, আর তোমার জন্য রয়েছে যা তোমার মন কামনা করবে এবং তোমার চোখ তৃপ্তি পাবে।” সে বলবে, আল্লাহ, আমি সন্তুষ্ট। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৮৯)
এরপর মুসা (আ.) জিজ্ঞাসা করলেন, হে আমার প্রতিপালক, আর তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী কারা হবেন?
আল্লাহ বললেন, “তারা তারাই যাদেরকে আমি চেয়েছি। আমি নিজ হাতে তাদের সম্মান রোপণ করেছি এবং তাতে মোহর এঁটে দিয়েছি। ফলে তা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং কোনো মানুষের হৃদয়ে কল্পনাতেও আসেনি।”
এই কথার সমর্থন কোরআনেও পাওয়া যায়, “সুতরাং কোনো প্রাণীই জানে না, তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ নয়ন-প্রীতিকর কী কী লুক্কায়িত রাখা হয়েছে।” (সুরা সাজদাহ, আয়াত: ১৭)
এই কথোপকথনটি জান্নাতের নেয়ামতসমূহের দুটি দিক তুলে ধরে: প্রথমত, সর্বনিম্ন স্তরের সুখের যে বর্ণনা, তা আমাদের পরিচিত দুনিয়াবি রাজত্বের দশ গুণ বেশি; দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ স্তর এমন যা মানুষের কল্পনারও বাইরে, স্বয়ং আল্লাহ নিজ হাতে যা প্রস্তুত করেছেন।
দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও শেষ বিচারের দিনআমরা যখন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার মতো জায়গায় তৈরি হওয়া কোনো বিলাসবহুল বাড়ির বা প্রাসাদের রিপোর্ট দেখি, যা মালিকের প্রতিটি আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে—কোথায় সে বিশ্রাম নেবে, কোথায় কফি পান করবে, কোথায় বই পড়বে, তার সিনেমা হল বা গাড়ির পার্কিং—তখন স্বভাবতই আমাদের মনে এক বিশেষ আকাঙ্ক্ষা জাগে।
কেউ যদি প্রস্তাব দেয় যে, এই বাড়িতে কিছুকাল বসবাস করে যদি ভালো লাগে, তবে বাড়িটি তার হয়ে যাবে—এমন লোভনীয় প্রস্তাব কি কেউ সহজে প্রত্যাখ্যান করতে পারে?
আরও পড়ুনবেহেশত মায়ের পায়ের নিচে০৮ মে ২০২১আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি সেইরূপ আচরণ করেন, যেইরূপ বান্দা তাঁর প্রতি ধারণা রাখে।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৭৫তবে সবাই যে দুনিয়ার এই চাকচিক্যেই সুখ খুঁজে পায়, তা নয়। কারো কারো কাছে হয়তো প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের ছোট্ট কুঁড়েঘর বা পাহাড়ের ঢালে থাকা শান্তির আবাসই বেশি প্রিয়। এটি মানুষের ব্যক্তিগত রুচি ও মেজাজের ভিন্নতার কারণে হয়ে থাকে।
কিন্তু মূল জিজ্ঞাসা এখানেই: যখন আমরা দুনিয়ার কোনো বস্তুগত সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই এবং তাতে সামান্য সুখ খুঁজে পাই, তখন কি একবারও আমাদের মনে হয় না যে, আখিরাতের অনন্ত সুখ কেমন হতে পারে? মানুষ তার সীমিত কল্পনা দিয়ে কীভাবে ‘জান্নাতুল আদন’ বা ফিরদাউসের নিয়ামতসমূহ তুলনা করবে?
এই প্রশ্নগুলো তাদের জন্য যারা আখিরাতে বিশ্বাসী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক শ্রেণির মানুষ, এমনকি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক হয়েও, ধর্মের দেওয়া আখিরাতের সত্যকে নিছক কল্পনা বা বিভ্রম বলে মনে করে। মক্কার মুশরিকদের মতো, যারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে সত্য শোনার পরেও তা অস্বীকার করেছিল, এই যুগের এমন অনেক জ্ঞানী মানুষও আখিরাতের জীবনকে প্রত্যাখ্যান করে।
দুনিয়ার সুখও ইমান বাড়াতে পারেএই মুহূর্তে আমরা যে জীবনযাপন করছি, তা প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাহদের (যেমন রোমের কাইজার বা পারস্যের কিসরা) কল্পনারও অতীত। আমাদের বর্তমানের আরাম-আয়েশ এবং প্রাচুর্য, যদিও তা সবার মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত নয়, তবুও তা আমাদেরকে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আখিরাতের নিয়ামতের দিকে তাকানোর সুযোগ করে দেয়।
যখন আমরা অনুভব করি যে, আল্লাহর দেওয়া ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার নিয়ামতগুলোই এত আনন্দদায়ক, তখন আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে যে, যে জান্নাত চিরস্থায়ী এবং যেখানে সুখের কোনো সীমা নেই, সেই স্থানটি কতই না মনোমুগ্ধকর হতে পারে! এই উপলব্ধি আমাদের ইমান ও আল্লাহ তায়ালার প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করে।
আসলে, আল্লাহ আমাদেরকে এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের ভোগ-বিলাসের জন্য সৃষ্টি করেননি, বরং একে তিনি আখিরাতের জন্য একটি বাহন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
সুতরাং, আমাদের উচিত হবে দুনিয়ার এই নিয়ামত ও সুখকে আখিরাতের অনন্ত সুখের জন্য একটি পথ ও উপায় হিসেবে গ্রহণ করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি সেইরূপ আচরণ করেন, যেইরূপ বান্দা তাঁর প্রতি ধারণা রাখে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৭৫)
এই উত্তম ধারণা নিয়ে যদি আমরা জীবনের পথে এগিয়ে যাই, তবে সেই মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং যা কোনো মানুষের হৃদয়ে কল্পনাতেও আসেনি।
আরও পড়ুনউত্তম ব্যবহার হৃদয়ের জান্নাত১৮ এপ্রিল ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সন ত ষ ট ন আল ল হ আল ল হ ত দ র জন য আম দ র প রস ত
এছাড়াও পড়ুন:
হংকংয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১২৮
হংকংয়ের উত্তরাঞ্চলীয় তাই পো এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে লাগা ভয়াবহ আগুনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১২৮ এ পৌঁছেছে। শুক্রবার কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে বিবিসি এ তথ্য জানিয়েছে।
ওয়াং ফুক কোর্ট নামে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে বুধবার অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০২১ সালের সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী, এই আবাসিক কমপ্লেক্সে প্রায় চার হাজার ৬০০ মানুষের জন্য এক হাজার ৯৮৪টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।
শুক্রবার সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১২৮ জন নিহত হয়েছে এবং ৭৯ জন আহত হয়েছে। ৮৯ জনের মৃতদেহ এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
অগ্নিনির্বাপন বিভাগ জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে কিছু অ্যাপার্টমেন্ট এখনো আগুন জ্বলছে।আগুনে পুড়ে যাওয়া সাতটি টাওয়ারের মধ্যে দুটিতে বেশিরভাগ মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং বেশিরভাগ জীবিতদের অন্যান্য ব্লক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, আবাসিক কমপ্লেক্সের আটটি ভবনের একটিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা আরো ছয়টি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের সংস্কার কাজের সঙ্গে যুক্ত তিনজনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগেও তদন্ত শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।
ভবনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগুন লাগার সময় ভবনের অ্যালার্ম বাজেনি।
ঢাকা/শাহেদ