যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের মেয়র পদে জোহরান মামদানির বিজয় একটি বিষয় মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেটা হলো, জনতুষ্টিবাদী ও ডান দিকে মোড় নেওয়া রাজনীতির উত্থানের সময়ও প্রগতিশীল রাজনীতির বিজয় সম্ভব।

পরিস্থিতির বাস্তব অনুধাবনের মধ্য দিয়ে যথাযথ রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা গেলে জনতুষ্টিবাদের বিপুল জোয়ার রুখে দেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বামপন্থীরা বিষয়টি অনুধাবন করবেন বলে মনে হয় না।

রাজনীতিতে আদর্শিক বিভাজন থাকবে। চিরকালই ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর একধরনের পোস্ট-ইডিওলজির বা উত্তর-আদর্শ যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব, পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা অনেকটা তা-ই মনে করেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা বলেছিলেন, পুরোনো মতাদর্শের যুগ শেষ; উদার গণতন্ত্রই ভবিষ্যৎ।

ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা তখন এর নাম দিয়েছিলেন ইতিহাসের অবসান হিসেবে। এর মূল ভিত্তি ছিল এই ধারণা যে রাজনৈতিক মতাদর্শের সব বিকল্প ফুরিয়েছে। কিন্তু মতাদর্শ কখনো মরে না, তার জের থেকেই যায়। পরে ভারতের আম আদমি পার্টি ও অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে জোহরান মামদানির উত্থানের মধ্য দিয়ে বোঝা গেল, মানুষের বাস্তব সমস্যার সমাধান করেও রাজনীতিতে সফল হওয়া যায়।

পোস্ট-আইডিওলজি হলো পুরোনো মতাদর্শের বাইরে গিয়ে সমস্যা সমাধানের রাজনীতি। যদিও অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন, এটি একরকম বিভ্রম; রাজনীতি সব সময়ই মতাদর্শিক। সমালোচকেরা বলেন, পোস্ট-আইডিওলজি সাধারণত দক্ষতাবাদী, নব্য উদারনীতিবাদ, কল্যাণমূলক উপযোগবাদকে ‘নিরপেক্ষ’ রূপে প্রতিষ্ঠা করে। এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান বা তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে প্রগতিশীল রাজনীতির বিজয় হতে পারে, মামদানি তা দেখিয়ে দিলেন।

নতুন রাজনীতির দিশা

একুশ শতকে দেশে দেশে নতুন রাজনীতির উত্থান দেখা যাচ্ছে। এই রাজনীতি প্রচলিত দলীয় কাঠামো এবং অভিজাত নেতৃত্বের বিপরীতে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, ক্ষোভ ও দৈনন্দিন প্রয়োজনকে কেন্দ্রে নিয়ে আসছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সামাজিক ন্যায় ও নাগরিক সেবা সামনে রেখে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক ধারা প্রযুক্তিনির্ভর সংগঠন ও তৃণমূলের অংশগ্রহণকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের দূরত্ব কমিয়ে রাজনীতিকে জীবনের বাস্তব সমস্যা সমাধানের জায়গা হিসেবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার এই প্রয়াস বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পেলেও তাদের ভিত্তি এক। সেটা হলো নাগরিকের বাস্তব চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেওয়া।

আরও পড়ুনমামদানি পারলেও নাহিদরা কেন পারছেন না?২১ নভেম্বর ২০২৫

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ভারতের আম আদমি পার্টি ২০১২ সালে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষোভকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেয়। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে দলটি প্রচলিত দলীয় কাঠামো ভেঙে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সেবাভিত্তিক শাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১৩ সালের দিল্লি নির্বাচনে প্রথম সাফল্য পেয়ে তারা ২০১৫ সালে প্রায় একতরফা ম্যান্ডেট অর্জন করে। শিক্ষা সংস্কার, মহল্লা ক্লিনিক ও কম খরচের সেবা মডেলকে বিকল্প নগর রাজনীতির প্রতীকে রূপান্তরিত করে তারা। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবেও এই মডেল গ্রহণযোগ্যতা পায়।

এদিকে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির বিজয়ও নতুন রাজনীতির সন্ধান দেয়। তৃণমূল সংগঠন, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, প্রগতিশীল নীতি ও অভিবাসী শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে তাঁর উত্থান।

তিনি নিউইয়র্কের বিচিত্র ভোটারগোষ্ঠীর সমস্যা রাজনৈতিক এজেন্ডায় রূপ দেন—ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহন সংস্কার, পুলিশ বাজেট পুনর্বিবেচনা ও শ্রমিক অধিকারের মতো বিষয় সামনে নিয়ে আসেন। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেটওয়ার্ককে চ্যালেঞ্জ করে ন্যায্যতা ও রাজনীতিতে সামাজিক নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। তাঁর এই প্রতিশ্রুতি যুব ও অভিবাসী ভোটারদের সক্রিয় করে—এই সমন্বয় তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের প্রধান কারণ।

এই দেশেও কমিউনিস্টরা নির্বাচনে জিতেছেন

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু গবেষণামূলক বই বাজারে আছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান রচিত ও ২০২৫ সালে প্রকাশিত লাল সালাম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বইয়ের কিছু তথ্যের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।

এই বইয়ের একটি বিশেষ দিক হলো—১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। যে বিষয়টি আমাদের জনপরিসরে অতটা আলোচিত হয় না সেটা হলো, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কয়েকজন প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি, স্বতন্ত্র ও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে তাঁরা লড়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন ও বাধাবিপত্তির মুখে এটা ছিল কমিউনিস্টদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির ঠিক কতজন প্রার্থী সে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন লেখায় নানা সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়।

এখন কথা হচ্ছে, সেই নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থীদের বিজয়ের কারণ কী। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার আগে বামপন্থীরা তেভাগা, টঙ্কসহ কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যেভাবে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তার ফল হিসেবেই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তাদের এই সফলতা। তার আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় কমিউনিস্টদের কিংবদন্তিতুল্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও কমিউনিস্টদের সংগ্রাম থামেনি। জেল-জুলুম লেগেই ছিল। তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা ইলা মিত্রের ওপর যে পৈশাচিক নির্যাতন পাকিস্তান পুলিশ চালিয়েছিল, তার নজির এ ভূমির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুনমামদানি দেখালেন কীভাবে নির্বাচিত হতে হয়০৬ নভেম্বর ২০২৫

কিন্তু বাংলাদেশের বামপন্থীরা কেন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের কথা গর্বের সঙ্গে বলে না বা সেই মডেল অনুসরণ করে না, তা এক বিস্ময়। হয়তো তারা আর সংগ্রামের কঠোর-কঠিন পথে যেতে চায়নি। এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আছে। দল ও মতাদর্শের ওপর হামলা হলে তারা চুপচাপ থাকে না, সেই সুরক্ষা আছে। বাম মনোভাবাপন্ন অনেক মানুষ এসব সংস্থায় কাজও করেন।

অন্যদিকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর আত্মজীবনীতে বলছেন, ‘১৯৪৯ সালের শেষে জেলখানায় ঢুকে ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে মুক্তি পেলাম। আমি নই আমরা মুক্তি পেলাম। অর্থাৎ অন্যদের সঙ্গে আমিও মুক্তি পেলাম। মুক্তি পাওয়ার কারণ হলো, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ীদের একটি অংশ অংশ কমিউনিস্ট অথবা কমিউনিস্ট মাইন্ডেন্ড।.

..সমস্যা ছিল কমিউনিস্টদের প্রধান সংযোগ ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। সেই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের প্রধান ভিত্তি ছিল কমিউনিস্ট কর্মীরা। কেন যেন ১৯৫৪-পরবর্তী প্রজন্মের যেসব লোক কমিউনিজম করে তারা এ কথাটা বলার উৎসাহ রাখে না, যদিও তৎকালে কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগকে জয়ী করার জন্য শ্রম-মেধা ব্যয় করেছে, তবুও অন্তত ৩০ জন গোপন কমিউনিস্ট বিজয়ী হয়েছিলেন। এরা কমিউনিস্ট পরিচয় গোপন রাখতেন, কিন্তু শেখ মুজিব তাঁদের পরিচয় জানতেন।’ দেখা যাচ্ছে, সরদার ফজলুল করিমের ভাষ্যে, এই সংখ্যাটা ৩০।

মতিউর রহমানের লাল সালাম ও সরদার ফজুলল করিমের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে নানা উদ্যোগের মধ্যে কমিউনিস্টদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল যুবলীগ গঠন (বর্তমানের যুবলীগ নয়)—তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রগতিশীল যুবসংগঠন ছিল এটি। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়ন গঠন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নানা উদ্যোগ, শান্তি পরিষদ গঠন ইত্যাদি বিষয়ে কমিউনিস্টদের উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল।

সে সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল গণতন্ত্রী দল গঠন। পাকিস্তান সরকারের নিপীড়নের কারণে তখন প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পরিচয়ে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই গণতন্ত্রী দল গঠনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

দমন-পীড়ন এড়াতে সে সময় কমিউনিস্টরা অন্য দলের ভেতর কাজ করা শুরু করেন। সরদার ফজলুল করিমের ভাষায়, ১৯৪০-এর দশকে ঢাকায় যে প্রগতিকামী কার্যক্রম শুরু হয়, তার পরিণতি দেখা যায় ১৯৬০-এর দশকে। ওটাই ছিল তাদের স্বর্ণালি সময়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরপরই কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার ও আটক করা শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের ভেতরে কাজ করা শুরু করে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নেয়। ১৯৬০-এর দশকে মানুষের মাথা থেকে পাকিস্তানের ভূত নামাতে ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল।

আরও পড়ুনমামদানি যেভাবে ট্রাম্পকে ট্রাম্পকার্ড দেখিয়ে দিলেন২৪ নভেম্বর ২০২৫

কিন্তু একটি বিষয়, প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেও মানুষের বাস্তব রাজনৈতিক সংগ্রামে তারা আর সেভাবে থাকল না। ফলে আওয়ামী লীগ ছয় দফা, দুই অর্থনীতির মতো তত্ত্ব দিয়ে জনপ্রিয় হলেও শেষমেশ কমিউনিস্ট পার্টি বিচ্ছিন্ন হলো। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বামপন্থীদের একাংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণও করল না।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন দাবিদাওয়াভিত্তিক আন্দোলন তারা করেছে ঠিক, কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো কর্মসূচি বা লক্ষ্য তাদের ছিল না। বামপন্থীদের একাংশ তথাকথিত বয়ানের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছে ঠিক, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংগ্রামে তাদের ভাষ্য ছিল না, বা থাকলেও ওই শ্রেণিকে আকর্ষণ করার মতো নয়।

বোঝা দরকার, বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষালাভের বিষয়টি মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষের সামাজিক কল্পনায় শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের পথ নয়; বরং এটি সামাজিকভাবে শ্রেণি উত্তরণের প্রধান সোপান। অনেক পরিবার সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও সন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগকে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, মর্যাদা ও স্থিতিশীলতার একমাত্র নির্ভরযোগ্য কৌশল হিসেবে দেখে। ফলে এখানে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের সুযোগ—সবই সামাজিক প্রতিযোগিতা ও প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে।

এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান ক্রমেই রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার অবকাঠামো, পরীক্ষার ফল, নিয়োগ, কোটা, চাকরির প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি ব্যবহার করে জনসমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে শিক্ষা খাত শুধু সামাজিক গতিশীলতা নয়, রাজনৈতিক সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

এই প্রক্রিয়াটি গভীরভাবে বোঝার জন্য অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচের দ্বারস্থ হওয়া যায়। সেন দেখিয়েছেন, মানব উন্নয়ন শুধু সম্পদ বা আয় বৃদ্ধির প্রশ্ন নয়; বরং মানুষের বাস্তব স্বাধীনতা, তার সক্ষমতা, অর্থাৎ নিজের অস্তিত্বকে মূল্যবান করে তোলার সুযোগ চায়। বাংলাদেশের পটভূমিতে শিক্ষা মানুষের সেই সক্ষমতা অর্জনের প্রধান মাধ্যম। শিক্ষাই ব্যক্তিকে জীবনমান উন্নয়ন, সামাজিক মর্যাদা লাভ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোতে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ দেয়।

কিন্তু যখন শিক্ষার সুযোগ অসম হয় বা শিক্ষা-কর্মসংস্থানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়, তখন মানুষের সক্ষমতার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়। ফলে সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রটি আর স্বাভাবিক সামাজিক বা ব্যক্তিগত অগ্রগতির পথ থাকে না, বরং ক্ষমতাকাঠামোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অংশ হয়ে যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়, কেন শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বাংলাদেশের সমাজে একই সঙ্গে আশা ও বঞ্চনার এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল ক্ষেত্র।

মনে রাখা দরকার, প্রগতিশীল রাজনীতি বামপন্থার চালিকা শক্তি। আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামদের বিভিন্ন অংশের যে সমালোচনা, সেই সমালোচনা থেকে বাঁচতে নিজেদের গৌরব ভুলে যাওয়া কাজের কিছু নয়। সেই সঙ্গে মামদানি ও আম আদমি পার্টির মতো রাজনীতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এই রাজনীতি বামপন্থীদের অপরিচিত কিছু নয়। জনতুষ্টিবাদী বয়ানের রাজনীতির যুগে যে সুশাসন ও ন্যায্যতার দাবিতে রাজনীতি করে মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়, তা তো দেখাই গেল। এর মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে আঘাত করতে হবে।

প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব মপন থ দ র ব মপন থ র প রগত শ ল ই র জন ত র জন ত ত র র জন ত র জন ত ক র জন ত র উল ল খ ল কর ম কর ম র র ব জয় ম মদ ন প রথম স গঠন ক ষমত সরদ র আওয় ম সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

তেভাগা থেকে মামদানি: বামপন্থীদের জন্য নতুন বার্তা

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের মেয়র পদে জোহরান মামদানির বিজয় একটি বিষয় মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেটা হলো, জনতুষ্টিবাদী ও ডান দিকে মোড় নেওয়া রাজনীতির উত্থানের সময়ও প্রগতিশীল রাজনীতির বিজয় সম্ভব।

পরিস্থিতির বাস্তব অনুধাবনের মধ্য দিয়ে যথাযথ রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা গেলে জনতুষ্টিবাদের বিপুল জোয়ার রুখে দেওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বামপন্থীরা বিষয়টি অনুধাবন করবেন বলে মনে হয় না।

রাজনীতিতে আদর্শিক বিভাজন থাকবে। চিরকালই ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর একধরনের পোস্ট-ইডিওলজির বা উত্তর-আদর্শ যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব, পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা অনেকটা তা-ই মনে করেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা বলেছিলেন, পুরোনো মতাদর্শের যুগ শেষ; উদার গণতন্ত্রই ভবিষ্যৎ।

ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা তখন এর নাম দিয়েছিলেন ইতিহাসের অবসান হিসেবে। এর মূল ভিত্তি ছিল এই ধারণা যে রাজনৈতিক মতাদর্শের সব বিকল্প ফুরিয়েছে। কিন্তু মতাদর্শ কখনো মরে না, তার জের থেকেই যায়। পরে ভারতের আম আদমি পার্টি ও অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে জোহরান মামদানির উত্থানের মধ্য দিয়ে বোঝা গেল, মানুষের বাস্তব সমস্যার সমাধান করেও রাজনীতিতে সফল হওয়া যায়।

পোস্ট-আইডিওলজি হলো পুরোনো মতাদর্শের বাইরে গিয়ে সমস্যা সমাধানের রাজনীতি। যদিও অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন, এটি একরকম বিভ্রম; রাজনীতি সব সময়ই মতাদর্শিক। সমালোচকেরা বলেন, পোস্ট-আইডিওলজি সাধারণত দক্ষতাবাদী, নব্য উদারনীতিবাদ, কল্যাণমূলক উপযোগবাদকে ‘নিরপেক্ষ’ রূপে প্রতিষ্ঠা করে। এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান বা তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে প্রগতিশীল রাজনীতির বিজয় হতে পারে, মামদানি তা দেখিয়ে দিলেন।

নতুন রাজনীতির দিশা

একুশ শতকে দেশে দেশে নতুন রাজনীতির উত্থান দেখা যাচ্ছে। এই রাজনীতি প্রচলিত দলীয় কাঠামো এবং অভিজাত নেতৃত্বের বিপরীতে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, ক্ষোভ ও দৈনন্দিন প্রয়োজনকে কেন্দ্রে নিয়ে আসছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সামাজিক ন্যায় ও নাগরিক সেবা সামনে রেখে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক ধারা প্রযুক্তিনির্ভর সংগঠন ও তৃণমূলের অংশগ্রহণকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের দূরত্ব কমিয়ে রাজনীতিকে জীবনের বাস্তব সমস্যা সমাধানের জায়গা হিসেবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার এই প্রয়াস বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পেলেও তাদের ভিত্তি এক। সেটা হলো নাগরিকের বাস্তব চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেওয়া।

আরও পড়ুনমামদানি পারলেও নাহিদরা কেন পারছেন না?২১ নভেম্বর ২০২৫

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ভারতের আম আদমি পার্টি ২০১২ সালে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষোভকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেয়। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে দলটি প্রচলিত দলীয় কাঠামো ভেঙে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সেবাভিত্তিক শাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১৩ সালের দিল্লি নির্বাচনে প্রথম সাফল্য পেয়ে তারা ২০১৫ সালে প্রায় একতরফা ম্যান্ডেট অর্জন করে। শিক্ষা সংস্কার, মহল্লা ক্লিনিক ও কম খরচের সেবা মডেলকে বিকল্প নগর রাজনীতির প্রতীকে রূপান্তরিত করে তারা। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবেও এই মডেল গ্রহণযোগ্যতা পায়।

এদিকে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির বিজয়ও নতুন রাজনীতির সন্ধান দেয়। তৃণমূল সংগঠন, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, প্রগতিশীল নীতি ও অভিবাসী শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে তাঁর উত্থান।

তিনি নিউইয়র্কের বিচিত্র ভোটারগোষ্ঠীর সমস্যা রাজনৈতিক এজেন্ডায় রূপ দেন—ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহন সংস্কার, পুলিশ বাজেট পুনর্বিবেচনা ও শ্রমিক অধিকারের মতো বিষয় সামনে নিয়ে আসেন। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেটওয়ার্ককে চ্যালেঞ্জ করে ন্যায্যতা ও রাজনীতিতে সামাজিক নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। তাঁর এই প্রতিশ্রুতি যুব ও অভিবাসী ভোটারদের সক্রিয় করে—এই সমন্বয় তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের প্রধান কারণ।

এই দেশেও কমিউনিস্টরা নির্বাচনে জিতেছেন

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু গবেষণামূলক বই বাজারে আছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান রচিত ও ২০২৫ সালে প্রকাশিত লাল সালাম: বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বইয়ের কিছু তথ্যের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।

এই বইয়ের একটি বিশেষ দিক হলো—১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। যে বিষয়টি আমাদের জনপরিসরে অতটা আলোচিত হয় না সেটা হলো, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কয়েকজন প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি, স্বতন্ত্র ও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে তাঁরা লড়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন ও বাধাবিপত্তির মুখে এটা ছিল কমিউনিস্টদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির ঠিক কতজন প্রার্থী সে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন লেখায় নানা সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়।

এখন কথা হচ্ছে, সেই নির্বাচনে বামপন্থী প্রার্থীদের বিজয়ের কারণ কী। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার আগে বামপন্থীরা তেভাগা, টঙ্কসহ কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যেভাবে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তার ফল হিসেবেই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তাদের এই সফলতা। তার আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় কমিউনিস্টদের কিংবদন্তিতুল্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও কমিউনিস্টদের সংগ্রাম থামেনি। জেল-জুলুম লেগেই ছিল। তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা ইলা মিত্রের ওপর যে পৈশাচিক নির্যাতন পাকিস্তান পুলিশ চালিয়েছিল, তার নজির এ ভূমির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুনমামদানি দেখালেন কীভাবে নির্বাচিত হতে হয়০৬ নভেম্বর ২০২৫

কিন্তু বাংলাদেশের বামপন্থীরা কেন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের কথা গর্বের সঙ্গে বলে না বা সেই মডেল অনুসরণ করে না, তা এক বিস্ময়। হয়তো তারা আর সংগ্রামের কঠোর-কঠিন পথে যেতে চায়নি। এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আছে। দল ও মতাদর্শের ওপর হামলা হলে তারা চুপচাপ থাকে না, সেই সুরক্ষা আছে। বাম মনোভাবাপন্ন অনেক মানুষ এসব সংস্থায় কাজও করেন।

অন্যদিকে সরদার ফজলুল করিম তাঁর আত্মজীবনীতে বলছেন, ‘১৯৪৯ সালের শেষে জেলখানায় ঢুকে ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে মুক্তি পেলাম। আমি নই আমরা মুক্তি পেলাম। অর্থাৎ অন্যদের সঙ্গে আমিও মুক্তি পেলাম। মুক্তি পাওয়ার কারণ হলো, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ীদের একটি অংশ অংশ কমিউনিস্ট অথবা কমিউনিস্ট মাইন্ডেন্ড।...সমস্যা ছিল কমিউনিস্টদের প্রধান সংযোগ ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। সেই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের প্রধান ভিত্তি ছিল কমিউনিস্ট কর্মীরা। কেন যেন ১৯৫৪-পরবর্তী প্রজন্মের যেসব লোক কমিউনিজম করে তারা এ কথাটা বলার উৎসাহ রাখে না, যদিও তৎকালে কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগকে জয়ী করার জন্য শ্রম-মেধা ব্যয় করেছে, তবুও অন্তত ৩০ জন গোপন কমিউনিস্ট বিজয়ী হয়েছিলেন। এরা কমিউনিস্ট পরিচয় গোপন রাখতেন, কিন্তু শেখ মুজিব তাঁদের পরিচয় জানতেন।’ দেখা যাচ্ছে, সরদার ফজলুল করিমের ভাষ্যে, এই সংখ্যাটা ৩০।

মতিউর রহমানের লাল সালাম ও সরদার ফজুলল করিমের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে নানা উদ্যোগের মধ্যে কমিউনিস্টদের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল যুবলীগ গঠন (বর্তমানের যুবলীগ নয়)—তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রগতিশীল যুবসংগঠন ছিল এটি। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন, ছাত্র ইউনিয়ন গঠন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নানা উদ্যোগ, শান্তি পরিষদ গঠন ইত্যাদি বিষয়ে কমিউনিস্টদের উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল।

সে সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল গণতন্ত্রী দল গঠন। পাকিস্তান সরকারের নিপীড়নের কারণে তখন প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পরিচয়ে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই গণতন্ত্রী দল গঠনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

দমন-পীড়ন এড়াতে সে সময় কমিউনিস্টরা অন্য দলের ভেতর কাজ করা শুরু করেন। সরদার ফজলুল করিমের ভাষায়, ১৯৪০-এর দশকে ঢাকায় যে প্রগতিকামী কার্যক্রম শুরু হয়, তার পরিণতি দেখা যায় ১৯৬০-এর দশকে। ওটাই ছিল তাদের স্বর্ণালি সময়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরপরই কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার ও আটক করা শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের ভেতরে কাজ করা শুরু করে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নেয়। ১৯৬০-এর দশকে মানুষের মাথা থেকে পাকিস্তানের ভূত নামাতে ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল।

আরও পড়ুনমামদানি যেভাবে ট্রাম্পকে ট্রাম্পকার্ড দেখিয়ে দিলেন২৪ নভেম্বর ২০২৫

কিন্তু একটি বিষয়, প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেও মানুষের বাস্তব রাজনৈতিক সংগ্রামে তারা আর সেভাবে থাকল না। ফলে আওয়ামী লীগ ছয় দফা, দুই অর্থনীতির মতো তত্ত্ব দিয়ে জনপ্রিয় হলেও শেষমেশ কমিউনিস্ট পার্টি বিচ্ছিন্ন হলো। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বামপন্থীদের একাংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণও করল না।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন দাবিদাওয়াভিত্তিক আন্দোলন তারা করেছে ঠিক, কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো কর্মসূচি বা লক্ষ্য তাদের ছিল না। বামপন্থীদের একাংশ তথাকথিত বয়ানের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছে ঠিক, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংগ্রামে তাদের ভাষ্য ছিল না, বা থাকলেও ওই শ্রেণিকে আকর্ষণ করার মতো নয়।

বোঝা দরকার, বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষালাভের বিষয়টি মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষের সামাজিক কল্পনায় শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের পথ নয়; বরং এটি সামাজিকভাবে শ্রেণি উত্তরণের প্রধান সোপান। অনেক পরিবার সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও সন্তানের শিক্ষায় বিনিয়োগকে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, মর্যাদা ও স্থিতিশীলতার একমাত্র নির্ভরযোগ্য কৌশল হিসেবে দেখে। ফলে এখানে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের সুযোগ—সবই সামাজিক প্রতিযোগিতা ও প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে।

এ পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান ক্রমেই রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার অবকাঠামো, পরীক্ষার ফল, নিয়োগ, কোটা, চাকরির প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি ব্যবহার করে জনসমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে শিক্ষা খাত শুধু সামাজিক গতিশীলতা নয়, রাজনৈতিক সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

এই প্রক্রিয়াটি গভীরভাবে বোঝার জন্য অমর্ত্য সেনের ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচের দ্বারস্থ হওয়া যায়। সেন দেখিয়েছেন, মানব উন্নয়ন শুধু সম্পদ বা আয় বৃদ্ধির প্রশ্ন নয়; বরং মানুষের বাস্তব স্বাধীনতা, তার সক্ষমতা, অর্থাৎ নিজের অস্তিত্বকে মূল্যবান করে তোলার সুযোগ চায়। বাংলাদেশের পটভূমিতে শিক্ষা মানুষের সেই সক্ষমতা অর্জনের প্রধান মাধ্যম। শিক্ষাই ব্যক্তিকে জীবনমান উন্নয়ন, সামাজিক মর্যাদা লাভ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোতে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ দেয়।

কিন্তু যখন শিক্ষার সুযোগ অসম হয় বা শিক্ষা-কর্মসংস্থানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়, তখন মানুষের সক্ষমতার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়। ফলে সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রটি আর স্বাভাবিক সামাজিক বা ব্যক্তিগত অগ্রগতির পথ থাকে না, বরং ক্ষমতাকাঠামোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অংশ হয়ে যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়, কেন শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বাংলাদেশের সমাজে একই সঙ্গে আশা ও বঞ্চনার এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল ক্ষেত্র।

মনে রাখা দরকার, প্রগতিশীল রাজনীতি বামপন্থার চালিকা শক্তি। আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামদের বিভিন্ন অংশের যে সমালোচনা, সেই সমালোচনা থেকে বাঁচতে নিজেদের গৌরব ভুলে যাওয়া কাজের কিছু নয়। সেই সঙ্গে মামদানি ও আম আদমি পার্টির মতো রাজনীতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এই রাজনীতি বামপন্থীদের অপরিচিত কিছু নয়। জনতুষ্টিবাদী বয়ানের রাজনীতির যুগে যে সুশাসন ও ন্যায্যতার দাবিতে রাজনীতি করে মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়, তা তো দেখাই গেল। এর মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে আঘাত করতে হবে।

প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ