বাইক্কা বিলে কমেছে অতিথি পাখির কলকাকলি
Published: 11th, January 2025 GMT
‘ছোট বেলা থেকেই বাইক্কা বিলে যাওয়া আসা যাওয়া করি। একসময় কত ধরনের পাখি দেখা যেত। কত পাখির ছবি এই বাইক্কা বিল থেকে তুলেছি। কিন্তু এখন দিন দিন পাখির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ১০ বছর আগের সঙ্গে বর্তমানের হিসাব করলে পাখির সংখ্যা ২০ ভাগে নেমেছে। অথচ এই বাইক্কা বিলে হাজার হাজার পাখি একসময় পুরো বিল দখল করে রাখত। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত বিল।’ কথাগুলো বলছিলেন বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা সংগঠন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ড লাইফের (সিউ) সদস্য ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার কাজল হাজরা।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় কথাগুলো বলছিলেন কাজল হাজরা।
বাইক্কা বিল পর্যটকদের প্রিয় স্থানগুলোর একটি। এই এলাকার মূল আকর্ষণ নানা প্রজাতির নজরকাড়া পাখি। সারা বছরই পাখি দেখা গেলেও কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কারণে অতিথি পাখির সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। আর এ বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যাঁরা আসছেন, তাঁরাও পাখি না পেয়ে ফিরছেন অনেক হতাশা নিয়েই।
কাজল হাজরা বলেন, ‘আমরা প্রায়ই শুনি শহরে পাখি বিক্রি হচ্ছে। অনেক পাখি আমরা শহর থেকে উদ্ধার করি। বাইক্কা বিলে পাখিশিকারির চক্র রয়েছে। তারা পাখি শিকার করে। পাখিরা ভয়ে এখন আসে না। তা ছাড়া বাইক্কা বিলে যাওয়ার জন্য বড় পাকা রাস্তা হয়েছে। পর্যটকেরা অনবরত গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। পাখিরা এসব ভয় পায়।’
বুধবার বিকেলে বাইক্কা বিলে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বিলে হাতে গোনা কিছু দেশীয় পরিচিত পাখি বসে আছে। কিছু পাখি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার পর পর বাইক্কা বিলের পাশের গাছগুলোতে পাখির দেখা মেলে। তবে এর সবই দেশি পাখি।
উপজেলা মৎস্য বিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাইক্কা বিলে প্রতিবছর নভেম্বর থেকে অতিথি পাখিরা আসতে শুরু করে। পাখিরা মার্চ পর্যন্ত থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে বিলের আকাশে ওড়াউড়ি করে, শাপলা-পদ্মপাতায় বিশ্রাম নেয় এবং জলে ডোবে-ভাসে। এই বিলে বালিহাঁস, খয়রা কাস্তে চরা, তিলা লালসা, গেওয়ালা বাটান, পিয়াং হাঁস, পাতি তিলা হাঁস, নীল মাথা হাঁস, উত্তরে লেঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, উত্তুরে খন্তিহাঁস, মরচে রং ভুতিহাঁস, মেটে মাথা টিটি, কালা লেজ জৌরালি, বিল বাটান, পাতিসবুজলা, বন বাটান, পাতিচ্যাগা, ছোট ডুবংরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, গয়ার, বাংলা শকুন, এশীয় শামুকখোল, পান মুরগি, পাতিকুট, নিউপিপি, দলপিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, উদয়ী বাবু বাটান, ছোট নথ জিরিয়া, রাজহাঁস, ওটা, ধুপনি বক, ইগল, ভুবন চিল, হলদে বক, দেশি কানিবক, গো-বক, ছোট বক, মাঝেলা বগা, লালচে বক, বেগুনি কালেম, বড় বগা, দেশি মেটে হাঁস, সরালি, বালিহাঁস, পানমুরগির, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, চড়-ই, বুলবুলি, দাগি ঘাসপাখি, টুনটুনি, ফিঙেসহ নানা প্রজাতির পাখি দেখা যেত। এখন বক, বালিহাঁস, ডুবরি, পানকৌড়ি, কালেম ছাড়া বেশি পাখি চোখে পড়ে না। স্থানীয় ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাখি দেখতে আসা পর্যটকেরাও এখানে এসে হতাশ হন।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক সুমাইয়া শিমু বলেন, ‘বাইক্কা বিল নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। বাইক্কা বিলে অনেক পাখি রয়েছে এ ধরনের ভিডিও দেখেছি। বাস্তবে এসে দেখলাম কিছুই নেই। এখানে এসে হতাশ হলাম। হাতে গোনা কয়েকটি পাখি পেয়েছি। সেগুলোও অনেক দূরে থাকে।’
বাইক্কা বিল দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মিন্নত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর পাখির সংখ্যা অনেক কম। এ বছর বিলের কচুরিপানা বিল থেকে সরে যাওয়ায় পুরো বিল প্রায় ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। পাখিরা এসব কচুরিপানা ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের ওপরেই বেশি থাকে। বিলের কিছু অংশে শাপলা-পদ্ম টিকে থাকলেও জলজ উদ্ভিদ প্রায় নেই। পাশাপাশি বাইক্কাবিলের প্রচুর পর্যটক আসায় পাখিরা একটু দূরে থাকে। অনেক পর্যটকই পাখিদের বিরক্ত করে। হাওরের পানিতে শিকারিরা জাল নিয়ে ঘুরে বেড়ান। হাওরে বাঁধ দিয়ে মেশিন লাগিয়ে পানি সেচা হয়। কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা হয় পাখিদের ধরার জন্য। তা ছাড়া বাইক্কা বিলে নৌকা নিয়ে প্রায়ই চলাচল করতে দেখা যায়, যা পাখির জন্য খুবই ভয়ানক বিষয়।
পাখি শিকার হয় কি না, জিজ্ঞেস করলে মিন্নত আলী বলেন, স্থানীয় কিছু মানুষ শিকারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। বর্তমানে আমাদের পাঁচজন লোক বিলের পাহারায় থাকেন। কয়েক দিন আগেও শিকারির উৎপাত ছিল। এখন সেটা নেই।
শ্রীমঙ্গল সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, ‘বিলের পাখি এখন আর কেউ শিকার করে না। এখানে বিলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি রয়েছে। তারাই পাহারার ব্যবস্থা করে। আমরা সব সময় খবরাখবর রাখি। এখন পাখির সংখ্যা দিন দিন কেন কমছে, সেই বিষয়ে আমরা একটি সার্ভে করব। পাখিবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস