ফেসবুক অফিসিয়াল বা দাপ্তরিক কোনো বিষয় নয়। এখানে বন্ধু তালিকা থাকা সবাই সবার ‘বন্ধু’। বাপ ছেলের বন্ধু, মা মেয়ের বন্ধু, শিক্ষক শিক্ষার্থীর বন্ধু, বস অধস্তনদের বন্ধু। যেহেতু সবাই সবার বন্ধু, তাই ফেসবুকের সব পোস্ট, কমেন্ট, রিয়েকশন, আলোচনা সবই বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। এখানে বন্ধুর ভালো খবরে ইতিবাচক রিয়েক্ট বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা যায়। খারাপ খবরে স্যাড বা দুঃখজনক প্রতিক্রিয়া– এমনকি সামাজিক কোনো অসংগতির খবরে অ্যাংরি বা রাগ প্রকাশ রিয়েকশন দিতে পারে।
তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে মাঝেমধ্যে আমরা বন্ধুত্বের কথাটা মাথায় রাখি না। ফেসবুক যে একটা অদাপ্তরিক পরিসর, তা ভুলে যাই। বন্ধু হয়ে বন্ধুকে আক্রমণ করে বসি, এমনকি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করে বসি; যা কোনোভাবেই ফেসবুকের স্পিরিটের সঙ্গে যায় না। যার ফলে ব্যক্তি সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফেসবুকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় প্রচারণাও হয়ে থাকে, মাঝেমধ্যে গুজবও ছড়ানো হয়ে থাকে, যা সহিংসতায়ও রূপ নেয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণ খুবই সহজ। ফেসবুককে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ব্যবহার করতে হবে। অফিসিয়াল ভাবা যাবে না। আক্রমণাত্মক হওয়া যাবে না। গুজব ছড়ানো যাবে না। সর্বোপরি সহিংস হওয়া যাবে না।
ধরেন, কেউ একজন (ফেসবুকে আপনার বন্ধু) তাঁর ওয়ালে একটা পোস্ট দিল, তখন আপনি কী কী করতে পারবেন– ভালো লাগলে লাইক দেবেন। বেশি ভালো লাগলে লাভ দেবেন। ফানি পোস্ট হলে হাহা রিয়েক্ট দেবেন। খারাপ সংবাদ হলে স্যাড রিয়েক্ট দেবেন। অসংগতি মনে হলে অ্যাংরি রিয়েক্ট দেবেন। যৌক্তিক কমেন্ট করতে পারেন।
কিন্তু কোনোভাবেই এমন রিয়েকশন বা কমেন্ট করা যাবে না, যাতে বিতর্ক সৃষ্টি হয় বা ফেসবুক বন্ধু মনে আঘাত পায়। কারণ তিনি আপনার বন্ধু। ধরেন কোনোভাবেই আপনি তাঁর পোস্টের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না বা শালীন ভাষায় প্রতিবাদ করেও শান্তি পাচ্ছেন না, তাহলে মেসেঞ্জারে চলে যান, ব্যক্তিগতভাবে আপনার রাগ প্রকাশ করুন।
চাইলে আপনি তাঁকে ‘আনফ্রেন্ড’ করতে পারেন। এতে অবশ্য আপনি চাইলে তাঁর প্রোফাইলে (যদি পাবলিক থাকে) ঢুকে তাঁর পোস্ট দেখতে পারবেন, এমনকি তাঁকে পুনরায় বন্ধুর অনুরোধ পাঠাতে পারবেন। তাঁকে ব্লক করে দিতে পারেন, তাহলে আর তিনি বা আপনি কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
সর্বশেষ আপনি চাইলে তাঁর পোস্টটি সম্পর্কে ফেসবুককে রিপোর্ট করতে পারবেন। তখন অথরিটি যাচাই করে ওই পোস্টটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
একই কথা প্রযোজ্য আপনার ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। তখন অন্যদের রিয়েকশন ও কমেন্টের জবাবে আপনি কী করতে পারেন– কেউ যদি পজিটিভ রিয়েকশন ও কমেন্ট করেন, তাহলে আপনি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন। চাইলে কনভারসেশন চালিয়ে যেতে পারেন যতক্ষণ পর্যন্ত দু’জনেই এনজয় করেন। কিন্তু কেউ যদি নেগেটিভ রিয়েকশন বা কমেন্ট করেন, যা আপনার মনঃপূত নয়, মনে কষ্ট পাচ্ছেন, আপনি অপমানিত ফিল করেন বা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন, তখন আপনি সম্ভব হলে এড়িয়ে যান। শালীন ভাষায় কমেন্টের রিপ্লাই দিয়ে আপনার অনুভূতি তাঁকে জানান, তিনি যদি পজিটিভলি নেন, তাহলে আপনিও মেনে নিন। কিন্তু তিনি যদি তাঁর কথায় অবিচল থাকেন বা আরও অ্যাগ্রেসিভ হন, তাহলে আপনি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে মেসেঞ্জারে নক করে আলোচনা করতে পারেন, সমাধান না হলে তাঁর কমেন্টটি ডিলিট করে দিতে পারেন, যেহেতু এটি আপনার ফেসবুক ওয়াল।
আরেকটা বিষয় ফেসবুক সুযোগ রেখেছে, সেটা হচ্ছে প্রাইভেসি সেটিংস। আপনি চাইলে কনটেন্ট অনুসারে বিতর্ক এড়ানোর জন্য আপনি আপনার পোস্টটি পাবলিক না করে শুধু ফ্রেন্ডদের জন্য, এমনকি শুধু নির্দিষ্ট কোনো একজন/কয়েকজন ফ্রেন্ডের জন্যও সেট করে দিতে পারেন। তাতে অন্তত বিতর্ক হলেও নিজেদের মধ্যেই হবে, পাবলিকলি নয়।
এতেও যদি আপনি সন্তুষ্ট না হন, তাহলে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ ভালোভাবে জেনে নিয়ে যা করার নিজ দায়িত্বে করেন। যদিও আমার লেখার শিরোনামেই বলেছি, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে এই লেখা, তবুও পাবলিকলি ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে দু’একটা কথা না বললেই নয়।
ফেসবুক এখন রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ও আরও নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ব্যবহারের নর্মসও বিভিন্ন রকম হবে। উদাহরণস্বরূপ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের পাবলিক প্রোফাইল ফেসবুক আছে, সেখানে তারা অনেক রাজনৈতিক পোস্ট দেন। সেসব পোস্টে লাইক, লাভ রিয়েক্ট যেমন পড়ে, হাহা, অ্যাংরি রিয়েক্টও অনেকেই দেন। ভালো ভালো কমেন্ট যেমন থাকে, গালিগালাজও অনেক ক্ষেত্রে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে নর্মস কেমন হওয়া উচিত?
দু’জন অভিনেতা বা সেলিব্রিটির ফ্যানদের মধ্যে মাঝেমধ্যে ফেসবুকে কাদা ছোড়াছুড়ি হতেও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রেই বা নর্মস কী হবে?
অনলাইন ব্যবসার বড় একটি ফ্ল্যাটফর্ম ফেসবুক। সেখানেও ভালো প্রোডাক্টের বিষয়ে পজিটিভ মন্তব্য যেমন আছে, মাঝেমধ্যে প্রোডাক্ট নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে অনেককে খেস্তিখেউড় করতেও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে নর্মস কী হবে? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া পোস্ট নিয়ে তো খুনাখুনি পর্যন্ত গড়ায়। যে কেউ তাঁর নিজের ধর্ম নিয়ে পোস্ট দিতেই পারেন, কিন্তু সেটা যাতে কোনোভাবেই অন্য ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত না করে, তা সর্বোতভাবেই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
সবশেষে আবারও বলতে হয়, ফেসবুক বা সামাজিকমাধ্যম অফিসিয়াল বিষয নয়। এখানে ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সবাই সবার বন্ধু। তাই এমন কথা বলা যাবে না, যা বন্ধুকে কষ্ট দেয়, বন্ধুত্ব নষ্ট করে। একটা কথা আছে, তোমার শত্রুকে এক হাজার সুযোগ দাও বন্ধু হওয়ার, কিন্তু বন্ধুকে একটা সুযোগও দিও না শত্রু হওয়ার।
ড.
মোহাম্মদ শামসুর রহমান: অধ্যাপক, মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ সব ক ফ সব ক ব র জন ত ক বন ধ ত ব ব যবহ র র য় কশন প বল ক র বন ধ প রব ন আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।