‘২৪ ঘণ্টার ভিতরে আমি আমার স্বামীর খুনিরারে গ্রেপ্তার দেখতে চাইছিলাম, কিন্তু এখন পর্যন্ত হেরা (পুলিশ) খুনিরারে ধরতে পারতাছে না। আমার স্বামী পুলিশ প্রশাসনের লোক হইয়াও যদি সঠিক বিচার না পায়, কী হইব আমরার? কিছু বলার নাই।’

আজ শনিবার দুপুরে এভাবে আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন নেত্রকোনার দুর্গাপুরে দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি কোপে খুন হওয়া পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শফিকুল ইসলামের স্ত্রী রাবিয়া খাতুন।

চণ্ডীগড় ইউনিয়নের নয়াগাঁও এলাকায় শফিকুলের গ্রামের বাড়িতে গেলে রাবিয়া খাতুন চোখের পানি মুছতে মুছতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার স্বামী এমন কোনো খারাপ কাজই করেন নাই, এমন কোনো অপরাধই করে নাই যে একজন দাঁড় করাইয়া কইব, “ভাই, আপনি এই অপরাধটা কের লাইগা করলাইন?” ক্যান এমন হইল? কারা আমার স্বামীরে নির্মমভাবে হত্যা করল? আমি কিছুই বুঝতে পারতাছি না।’

রাবিয়া খাতুন বলেন, ‘দুই দিন গেছে গা, পুলিশ অহনও খুনিরারে ধরতে পারতাছে না। এহন হেরা (পুলিশ) আইসা উল্টা আমারে জিগায় আপনি কাউরে সন্দেহ করেন, আমি সন্দেহ করতাম কী? সিসিটিভি ফুটেজে সরাসরি দেখা যাইতেছে তিন–চারডা মানুষ তারে কোবাইতাছে। লোকটা দৌড় দিয়াও রক্ষা পাইছে না, মারছে। একটা পথচারী ঘটনার সময় দৌড় দিছে। দৌড় মারা লোকটারেও তো ধইরা জিগান যায়, তারা এটাও পারছে না। আমার স্বামী পুলিশ প্রশাসনের লোক হইয়াও যদি সঠিক বিচার না পায়, কী করব, আমার কিছু বলার নাই। তিন ছেলেসন্তান লইয়া আমার অহন কী হইব। আল্লাহ, আমারেও তুমি লইয়া যাও।’

শফিকুল ইসলামের বৃদ্ধ বাবা রফিকুল ইসলাম সন্তানহারানোর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেডা খুবই ভালো আছিল। কোনো দিন কারও সাথে ঝগড়া-বিবাদ করত না। নিরীহ ছেলেডারে এইভাবে কোপাইয়া মারব, এইডা কোনো দিনও ভাবতে পারছি না। বাপ হইয়া ছেলের এমন মৃত্যু দেখতে হেইব, তা কল্পনাও করছি না কোনো দিন। আমার ছেলেরে তো কোনো দিন ফিরইরা পাইতাম না। কিন্তু আমি চাই, আমার ছেলের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আইন্না ফাঁসি দেওয়া হোক।’

আরও পড়ুননেত্রকোনায় ছুটিতে বাড়িতে আসা এসআইকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা০৯ জানুয়ারি ২০২৫

স্থানীয় লোকজন ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শফিকুল ইসলাম জামালপুর পুলিশ লাইনসের বেতারে কর্মরত ছিলেন। গত বুধবার তিনি ছুটি নিয়ে দুর্গাপুরের বাগিচাপাড়া বাসায় যান। এই ছুটিই যে তাঁর জীবনের শেষ ছুটি, তা কখনো কেউ ভাবেননি। শফিকুল গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে বাজারে যান। ফেরার পথে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটের দিকে দুর্গাপুর পৌর শহরের উকিলপাড়া এলাকায় পান মহলসংলগ্ন একটি গলিতে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ডান পায়ের গোড়ালির অংশ প্রায় আলাদা হয়ে যায়। পরে সর্বশেষ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত সাড়ে নয়টায় তিনি মারা যান। এ ঘটনায় গত শুক্রবার অজ্ঞাতনামা ছয়জনকে আসামি করে তাঁর বাবা হত্যা মামলা করেন। তবে পুলিশ এখন পর্যন্ত ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনসহ জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি।

এদিকে আজ শনিবারও নেত্রকোনা পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম মাহমুদ ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। এর আগের দিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ময়মনসিংহ রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আবুল কালাম আযাদ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মো.

রকিবুল আক্তার, পুলিশ সুপার সাহেব আলী পাঠানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের একাধিক দল মাঠে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটনসহ জড়িত ব্যক্তিদের আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব। এসআই হত্যায় চারজন অংশ নিয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। গোপনীয়তার স্বার্থে আমরা এখনই তাঁদের নাম বলছি না।’

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’

দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।

শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।

সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।

সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’

সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বর্ষার শুরুতেই সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টির বার্তা
  • টানা সাত দিন সারাদেশে বৃষ্টি ঝরবে
  • ‘ভয়ে’ সরকারি তালিকায় নাম না তোলা ইমরান চলে গেলেন নীরবে
  • ‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
  • কয়েকদিনের তীব্র তাপপ্রবাহের পর ময়মনসিংহে স্বস্তির বৃষ্টি
  • ময়মনসিংহে ছুরিকাঘাতে ছাত্রদল নেতা নিহত
  • নান্দাইলে বাস-ইজিবাইক স্ট্যান্ড দখল নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ৬
  • তাপপ্রবাহ আরও দুয়েক দিন, এর পর বৃষ্টি
  • গামছা পরে ঘুমিয়ে থাকার কারণ জানালেন সমু চৌধুরী
  • দিনাজপুর সীমান্তে গভীর রাতে আলো নিভিয়ে ১৫ জনকে ঠেলে পাঠাল বিএসএফ