ধুঁকতে থাকা কাপ্তাই হ্রদের প্রাণ ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এরই মধ্যে রাঙামাটির ‘কর্ণফুলী ও সংযুক্ত নদীসমূহের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামে ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে সাড়ে চার বছর। চলতি জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে চলবে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত। 

প্রকল্পের মাধ্যমে কাচালং, রাইখিয়ং, শিলকসহ ১৩ নদী-খাল খননের মাধ্যমে হ্রদে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে সারাবছর কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেওয়া হবে। পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে নৌযান চলাচলের পথ সুগম করা হবে। এ ছাড়া নাব্য বাড়ানো, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, মৎস্য-কৃষি উৎপাদন বাড়ানোসহ ছয় ধরনের কাজের সমন্বিত পরিকল্পনা রয়েছে পাউবোর। 
প্রকল্পের খাতভিত্তিক কাজের ওপর প্রথম যাচাই সভা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয় গত ১৬ আগস্ট। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮৫৩ কোটি টাকার ডিপিপি কাটছাঁট করে নামিয়ে আনা হয় ৬৯৬ কোটি টাকায়। পরে নতুন করে ৬৯৬ কোটি টাকার ডিপিপি গত ১০ নভেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও পাবর্ত্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রকল্পের সামগ্রিক বিষয় আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পাউবো চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, কাপ্তাই হ্রদ, কর্ণফুলীসহ ১৩ নদী-খালের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনায় ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মোডিলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে একগুচ্ছ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাপ্তাই হ্রদের প্রাণ ফেরাতে ৬৯৬ কোটি টাকা প্রয়োজন। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে শুষ্ক মৌসুমে চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় কোটি মানুষ লবণাক্ত পানি নিয়ে যে সংকটে আছেন, তাও দূর হবে। বছরজুড়েই সচল থাকবে রাঙামাটি সদরের সঙ্গে পাঁচ উপজেলার নৌ যোগাযোগ, যা এখন নাব্য সংকটের কারণে বছরে আট মাস বন্ধ থাকে।  
পরিবেশবিদ ও গবেষক ড.

ইদ্রিস আলী বলেন, কাপ্তাই হ্রদ মানবসৃষ্ট কারণে সংকটাপন্ন। এর ফলে অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। নাব্য না থাকায় নৌ যোগাযোগও ব্যাহত হচ্ছে। বহুমুখী সংকট থেকে মিঠা পানির এই হ্রদ বাঁচানো জরুরি।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানি চট্টগ্রাম শহরের মানুষকে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করে ওয়াসা। তবে শুষ্ক মৌসুমে এ দুই নদীতে পানি কমে যাওয়ার ফলে লবণাক্ততা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ে। তখন আমাদের কাপ্তাই হ্রদের মিঠা পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। হ্রদের পানি পেলে আমরা লবণাক্তমুক্ত পানি শহরবাসীকে সরবরাহ করতে পারি। 

১৩ নদী-খালের প্রাণ ফেরাতে বাধা ৯১ কিলোমিটার
খরস্রোতা কাচালং নদী ভারতের মিজোরাম থেকে সাজেক অববাহিকা হয়ে নেমে এসেছে। এক সময় নদীপথে নৌকা নিয়ে সাজেকের মাচালং খাল মুখ পর্যন্ত মানুষের আসা-যাওয়া ছিল। বাঘাইছড়ি থেকে লংগদুর মাইনীমুখ পর্যন্ত নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে হেঁটে নদী পার হয় মানুষ। এ নদীর ৪৭ কিলোমিটার খনন করে ৬৯ লাখ ঘনমিটার মাটি অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো। এতে খরচ হবে ১৯৯ কোটি টাকা। একইভাবে কাপ্তাই হ্রদের রাইখিয়ং নদীর ১১ কিলোমিটার খননে ৭৬ কোটি টাকা, শিজক নদীর ৯ কিলোমিটার খননে ৭০ কোটি টাকা লাগবে। এ ছাড়া হ্রদে সংযুক্ত আরও ১০টি খালে ২৬ কিলোমিটার খননে ৩২ কোটি টাকা খরচ করা হবে।  

বরকলে সীমান্তবর্তী ভূখণ্ড রক্ষায় প্রতিরক্ষা বাঁধ
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বরকলের ঠেগামুখ বাজার ও বিওপি-সংলগ্ন এলাকায় নদী ভেঙে বাংলাদেশে ভূখণ্ড ভারতের সীমানায় চলে যাচ্ছে। তাই ঠেগামুখ বাজার এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো। এ ছাড়া কাচালং নদী, শিজক, রাইখিয়ং নদী তীরবর্তী ১২ কিলোমিটার ভাঙনপ্রবণ তীর ও লেকের পাড়ের ৩৬টি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, রাস্তাঘাট ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষায় কাজ করবে প্রতিষ্ঠানটি। খরচ ২৮৮ কোটি টাকা। 

বছরে ৮ মাস বন্ধ যোগাযোগ
কাপ্তাই হ্রদঘেরা নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি উপজেলার সঙ্গে রাঙামাটি সদরের মানুষকে নৌপথে আসা-যাওয়া করতে হয়। তবে পানি শুকিয়ে গেলে বছরে আট মাস বন্ধ থাকে অন্য উপজেলার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ। 
হ্রদের পানি কোটি মানুষের ভরসা 
শুষ্ক মৌসমে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানি কমে গেলে বঙ্গোপসাগর থেকে লবণাক্ত পানি বাড়তে থাকে এ দুই নদীতে। তখন চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের এলাকায় পানিতে লবণাক্ততা বাড়ে। ওই সময় কাপ্তাই হ্রদ থেকে মিঠা পানি কর্ণফুলী নদীতে ছাড়া হলে লবণাক্ততার মাত্রা কমে আসে। তাই শুষ্ক মৌসুমে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর লবণাক্ততা ঠেকাতে কাপ্তাই হ্রদের পানি সংরক্ষণে গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায়। 

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ