শিশুর জন্মের পর শরীর খারাপের লক্ষণ দেখে গাইনি ডাক্তার বললেন, এখন আর আমার সাবজেক্ট নয়। শিশু জন্মের আগ পর্যন্ত আমার সাবজেক্ট থাকলেও জন্মের পর নবজাতক শিশুরোগ ডাক্তারের সাবজেক্ট। নবজাতককে নিয়ে তাই ছুটতে হলো অন্য ডাক্তারের কাছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা গাইনি ডাক্তারের মতো। শিশু জন্মের মানে ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্তই। 
নির্বাচন নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বলি। ১৯৯১ সালের গণভোটের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে ছিলাম। গণভোটের আগে প্রথাগতভাবে উপজেলার সব কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের আয়োজন ছিল। সবার স্মৃতিতে তখনও দগদগে পূর্ববর্তী দুটি গণভোটের অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলি, সবাই যেন কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ভোট গ্রহণ করেন। কোনো কেন্দ্রে যদি ভোট না-ও পড়ে, আমি নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম– সেই কেন্দ্রের নির্বাচনী কর্মকর্তারা কোনো ঝামেলায় পড়বেন না। কেউ যদি প্রতারণার আশ্রয় নেন, তাঁর খবর আছে।

উপজেলার ৩৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৪টি কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে কোনো সন্দেহ হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে দুর্গম স্থানের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী ও পুরুষ দুই কেন্দ্রের ফলাফল একেবারেই অস্বাভাবিক। এই দুই কেন্দ্রের ফলাফলে দেখা যায় শতভাগ ভোট সংগৃহীত হয়েছে এবং তার ৯৮ শতাংশই এক পক্ষে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সারাদিন উপজেলা সদরে ছিলেন; অথচ এত ভোট কী করে হলো? এই প্রশ্নে দুই প্রিসাইডিং কর্মকর্তার জবাব– ‘আমরা মনে করেছিলাম, আপনি এতে খুশি হবেন।’ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে ফলাফল দাখিল করার পর আইনানুগভাবে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কিছু করণীয় নেই বিধায় সেই ফলাফলই রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে যায় এবং চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়।

ভারতে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন টিএন সেশন। তিনিই নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতায় বলীয়ান করেন। তাঁর আগে-পরে কেউই তাঁর মতো কমিশনের কাজ করতে পারেননি। টিএন সেশনের মতো ব্যক্তিত্ব অহরহ জন্মায় না। তাঁর নির্বাচনী কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক মিথ আছে। মিথ না বলে তাণ্ডব বললেও ভুল বলা হবে না। 
কোনো এক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পরদিন টিএন সেশন সংবাদপত্রে দেখলেন, রাজ্যের রাজধানী শহরে ভোট চলাকালে একটা মদের দোকান খোলা ছিল। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই বাতিল করে দিলেন ওই আসনের নির্বাচন; রাজ্য থেকে রিপোর্ট আনার ধারও ধারেননি তিনি। তাঁর যুক্তি– মদ খেয়ে মাতাল হয়ে লোকে ভোট দিয়েছে। যার ফলে এই ভোট সঠিক হয়নি। ওই আসনে পুনরায় ভোট হয়। টিএন সেশন যত কঠোরই হোন না কেন; ওই আসনের ভোটের ফল প্রকাশিত হয়ে গেলে তিনি নির্বাচন বাতিল করতে পারতেন কিনা, সন্দেহ। 

ভারতের লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে একাধিক দিনে ভোট গ্রহণ হয় এবং নির্বাচনের কয়েক দিন পরে সব আসনের ভোট একই দিনে গণনা হয়। ভোট গণনার দিন গণনাকারীর ফলাফল প্রস্তুত করা পর্যন্ত এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের; গাইনি ডাক্তারের মতো। ফলাফল প্রকাশিত হয়ে গেলে নির্বাচন-সংক্রান্ত অভিযোগের দায় মেটানোর ভার আদালতের।
অনেকেরই মনে আছে, ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচন চলাকালে অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন ১৪৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৪টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বাতিল করে দিয়েছিল। উপনির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভির ব্যবস্থা ছিল এবং নির্বাচন কমিশন ক্যামেরায় কেন্দ্রগুলো প্রত্যক্ষ করেছিল। একটি আসনের নির্বাচন বিধায় নজরদারি যত সহজ ছিল, এক দিনে ৩০০ আসনের ৪২ সহস্রাধিক কেন্দ্রে নজরদারি তত সহজ নয়। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপন করা হবে বলে প্রথম দিকে আওয়াজ তোলা হলেও বাস্তব কারণে তা সম্ভব হয়নি। অথচ ৩০০ আসনের ভোট গ্রহণ পাঁচ বা ছয় দিনে হলে প্রতিদিন ৫০-৬০টি আসনের নির্বাচনে এই নজরদারি সম্ভব। এ ছাড়া একাধিক দিনে ভোট গ্রহণ হলে ভোটের দিন ও ফলাফল প্রকাশের দিনের মধ্যে ব্যবধান থাকে। ভোট প্রদান-সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগ থাকলে ভোট গণনার আগেই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র বা আসনের নির্বাচন বাতিল করার পথ সুগম হয়।

মনে রাখা জরুরি, নির্বাচন বাতিলই মোক্ষ নয়; মোক্ষ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের আয়োজন। ভোট গ্রহণের পরপরই কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় যদি কোনো কেন্দ্র ভোটসন্ত্রাসীদের দখলে চলে যায় বা ভোটসন্ত্রাসীদের দাপটে বা কোনো কারণে উৎসাহিত হয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অযাচিত ফলাফল ঘোষণা করেন, তাহলে আদালতের ভিন্নতর নির্দেশ ব্যতীত সেই ফলই চূড়ান্ত। অথচ একাধিক দিনে ভোট হলে প্রকাশ্য দিবালোকে রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রার্থীরা বা তাদের এজেন্ট ও গণনাকারীদের উপস্থিতিতে ভোট গণনা হলে ভোটসন্ত্রাসীদের পক্ষে ফলাফল কারসাজি করা সম্ভব হবে না। যদি যথার্থভাবে প্রমাণিত হয়– কোনো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণকালে তঞ্চকতা হয়েছে, তাহলে ভোট গণনার আগে নির্বাচন কমিশন খুব সহজেই সেই কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করতে পারবে। 

কোনো ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা বেশি, আবার কোনো কেন্দ্রে কম। স্বাভাবিকভাবেই কম ভোটার-সংবলিত কেন্দ্রের ভোট দ্রুত গণনা হয়ে যায় এবং ফল প্রকাশিত হয়। এই ফল প্রকাশের পর আশপাশের কেন্দ্রে ভোটসন্ত্রাসীদের চাপ বেড়ে যায়। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই পরিস্থিতিতে দুর্বল ব্যক্তিত্বের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভয়ভীতির মুখে ভোটসন্ত্রাসীদের কারসাজি করা ফলাফলে সই করলেও করতে পারেন। কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় বাতিল ব্যালট নিয়ে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তও হয়ে থাকে, যা ফলাফলে প্রভাব বিস্তার করে। কেন্দ্রীয়ভাবে গণনা হলে সে আশঙ্কা অনেক কম হতে বাধ্য।  
নির্বাচনের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে বিপুল লোকবলের প্রয়োজন হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ভোটের আগের দিন থেকে ভোট গণনা শেষ হওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৬ ঘণ্টা পুলিশ ও আনসারদের তটস্থ থাকতে হয়। যার ফলে ভোট গণনার সময় অনেক ক্ষেত্রে অবসাদের জন্ম নেয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব হয়, যা কখনও কখনও নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করে। একাধিক দিনে নির্বাচন হলে যে কয় দফায় ভোট হবে, ব্যবহার্য লোকবল তত গুণ হবে। এর ফলে কেন্দ্রে বিশেষত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকবে। ভিন্ন এলাকা থেকে দৃঢ়চিত্তের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ করাও সম্ভব হবে। যদি একাধিক দিনে ভোট গ্রহণ হয়, তবে ব্যালট বাক্স কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় প্রার্থী মনোনীত লোকবল রাখার বিধানও করতে হবে।
আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সর্বজনগ্রাহ্য করতে এবার না হয় এই সংস্কারটুকু হোক! নির্বাচন হোক পাঁচ বা ছয় দিনে; ভোট গণনা হোক প্রকাশ্য দিবালোকে আসনভিত্তিক এক স্থানে। 

আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ টসন ত র স দ র কর মকর ত র এক ধ ক দ ন র র ফল ফল ভ ট গণন র ভ ট গ রহণ ব ত ল কর ফল ফল প জন ম র র সময় উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

গ্রেপ্তারকৃতদের তদন্তে মালয়েশিয়াকে সহায়তা করবে বাংলাদেশ

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৩৫ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ তদন্তে মালয়েশিয়ার সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ। শুক্রবার কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন হাজি হাসানের সঙ্গে এক বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এ আশ্বাস দেন।

শুক্রবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, কুয়ালালামপুরে ৩২তম আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের (এআরএফ) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ফাঁকে তাঁরা এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন এবং তথ্য ও তদন্তের ফলাফল বিনিময়ের মাধ্যমে অভিযোগের অভ্যন্তরীণ তদন্তে মালয়েশিয়ার সহযোগিতা চান। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে সহায়তার আশ্বাস দেন।

এর আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রসচিব ডেভিড ল্যামির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। উভয়ই বাংলাদেশে চলমান সংস্কার, রোহিঙ্গা সংকট, এলডিসি-পরবর্তী সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিজিথা হেরাথ এবং কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের উপমন্ত্রী ও প্রতিনিধিদলের প্রধান পার্ক ইউনজুর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এ সময় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।

বাংলাদেশ ২০০৬ সালে এআরএফের সদস্য হয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ফোরামটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ