‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ নিয়ে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির বিপদ
Published: 10th, July 2025 GMT
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা অভূতপূর্ব সাহসিকতায় ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা করেছিলেন। এটি শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় নয়, বরং উদার গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতিরও বিজয় ঘোষণা করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে নতুন করে রূপ দিয়েছে। রাশিয়াকে তার শক্তি পুনর্গঠন করতে; জর্জিয়া ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে এবং সাহসী চীনের উত্থান প্রত্যক্ষ করতে দুই দশক সময় লেগেছে। আজ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রমাণ করেছে– ইতিহাসের শেষ বলে কিছু নেই; উদার গণতন্ত্র পিছিয়ে পড়ছে এবং পরিচয়ের সংকটাপন্ন। তা ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার জন্য লড়াই করছে।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে দাবিগুলো আবারও উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, এটি এক ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’র জন্ম দিতে পারে, যেখানে ইরানের প্রতিরোধের অক্ষ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সিরিয়া, লেবানন ও গাজায় তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এটি গত শতাব্দী ধরে প্রতি দশকে পুনরাবৃত্তি হওয়া দাবিগুলোর প্রতিধ্বনি।
ওসমানি সাম্রাজ্যের পতন এবং পশ্চিমা স্বার্থ দ্বারা মধ্যপ্রাচ্য বিভক্ত হওয়ার পর থেকে এই বিরত থাকা এ রকম, প্রতিটি যুদ্ধের পর একটি নতুন যুগের সূচনা এবং মধ্যপ্রাচ্য সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু প্রতিটি সামরিক অভিযান শুধু পরবর্তী সংঘাতের বীজই বপন করেছে।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের কথা বিবেচনা করা যায়। ইসরায়েল তিনটি আরব সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে এবং সিনাই উপদ্বীপ, গোলান হাইটস ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের বাকি অংশ জয় করে। তবুও এই বিজয় থেকে তাদের সবচেয়ে বড় দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের উদ্ভব হয়– প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) উত্থান ও শক্তিশালী গোড়াপত্তন। তখন পর্যন্ত পিএলও মূলত আরব শাসকগোষ্ঠী দ্বারা গঠিত ও আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু সেই শাসকগোষ্ঠীর পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনিরা সংগঠনের মধ্যে তাদের স্বাধীনতার দাবি তোলে। তারা এই দাবিতে ফিলিস্তিনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে থাকে।
একইভাবে ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণের পর তারা উল্লেখযোগ্য একটি সামরিক কৃতিত্ব অর্জন করে। আর দ্রুত বৈরুতে পৌঁছে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল দখল করে। কিন্তু সেই বিজয় থেকে হিজবুল্লাহর আবির্ভাব ঘটে, যা চার দশক ধরে ইসরায়েলের জন্য সরাসরি ও বিরতিহীন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরব শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে যারা প্রায়ই তাদের নিজস্ব সীমান্তের মধ্যে শক্তি চিনতে বা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর সুপ্ত সম্ভাবনা বোঝে। আরব বসন্তের শুরুতে তিউনিসিয়ার নেতা জাইন এল আবিদিন বেন আলির পতনের পর এবং মিসরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সূচনার মধ্যে ইসরায়েল সেই গণতান্ত্রিক তরঙ্গকে দুর্বল করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, বিশেষ করে মিসরের ওপর নজর ফেলে।
পশ্চিমা নেতারা ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’র মন্ত্রকে এমনভাবে গ্রহণ করেছেন, যেন এটি বেদবাক্য। বাস্তবে এ শব্দটি কাল্পনিক। মধ্যপ্রাচ্য সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র স্থান, যা প্রতি দশকে নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে– কোনো চূড়ান্ত বিজয় হয়নি, তবে উভয় পক্ষই তাদের উন্নত সামরিক ও গোয়েন্দা ক্ষমতা উন্মোচিত করেছে; একই সঙ্গে দুর্বলতাও। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শাসন টিকে থাকার মধ্যেই উত্তেজনা ও ভবিষ্যতের সংঘর্ষ সম্ভবত অব্যাহত থাকবে।
এই সংঘাত আরব দেশগুলোকে দুটি গভীর হুমকির মুখোমুখি করেছে। ইরান সম্ভবত ইরাক, লেবানন ও সিরিয়াজুড়ে তার ‘সফট পাওয়ার’ পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে। দেশটি ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম একমাত্র শক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করবে। এদিকে ইসরায়েল তার সরকারের মধ্যে মশিহবাদী বা ভবিষ্যতের শক্তি দ্বারা উৎসাহিত। তারা এমন নীতি অনুসরণ করবে, যা আরব রাষ্ট্রগুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে হলেও গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক ভিটেমাটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থানের জন্য ইসরায়েল ও ইরান যখন লড়াই করছে, তখন অনেকটাই নির্ভর করছে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর ওপর। গাজা গণহত্যার দুই বছর পর ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও অনাহার বন্ধ করতে ব্যর্থ বিশ্বে আরব দেশগুলোকে কয়েক দশক ধরে তাদের রাজনীতিকে রূপদানকারী দুটি প্রচলিত পদ্ধতি সম্পর্কে আরও গভীর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে হবে। পশ্চিমাপন্থি ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামবাদ– উভয়ের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে আরব জনগণ ভঙ্গুর ও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সম্ভবত আরব দেশগুলোর জন্য সত্যিকারের নতুন মধ্যপ্রাচ্য গড়ে তুলতে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করার সময় এসেছে। এটি হবে এমন দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রথমে আরব স্বার্থের পক্ষে থাকবে এবং যা আরবদের দ্বারাই গঠিত হয়; পশ্চিম বা প্রাচ্যের বাইরের শক্তি দ্বারা নয়।
আবেদ আবু শাহাদেহ: ইসরায়েলের জাফায় বসবাসকারী রাজনৈতিক কর্মী; মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র জন য দ র বল ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ীকে হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ
রাজধানীর পুরান ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনের সড়কে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) নামের এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়। মিছিলটি ভিসি চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যের উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘পাথর মেরে সোহাগ খুন, বিএনপি জবাব দে’, ‘সন্ত্রাস রুখে দেবে ছাত্রসমাজ’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘যেভাবে ছাত্রবন্ধুরা আজ প্রতিবাদে নেমেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও আমরা একইভাবে প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু বিএনপি এখন নিজেদের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ১৬ বছর যাঁরা মজলুম ছিলেন, তাঁরা এখন জালিমে পরিণত হয়েছেন।’
বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘এই চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের আমরা বিচার চাই। শুধু সোহাগ নয়, গত ১০ মাসে বিএনপির সন্ত্রাসে এক শর বেশি মানুষ খুন হয়েছে। প্রতিটি হত্যার বিচার করতে হবে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি আরও বলেন, দেশে নির্বাচন হতে হলে আগে রাজনীতির সংস্কার হতে হবে। সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে আমরা দেশকে নতুন করে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই পথে একমাত্র বাধা একটি সন্ত্রাসী দল। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জাতীয়তাবাদী চাঁদাবাজ দল একজন ব্যবসায়ীকে পাথর দিয়ে হত্যা করছে।’
গত বুধবার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের সড়কে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল চারজনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে।
আরও পড়ুনসিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ, ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার২ ঘণ্টা আগে