বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার করতে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির পর এবার সরকারকে সাতদিনের ‘আল্টিমেটাম’ দিলো বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত বদল না হলে কারখানা বন্ধসহ রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েছে কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠনটি। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর শাহবাগের ঢাকা ক্লাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রস্তাবিত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বাপা। এ সময় গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাহার করারও দাবি জানিয়েছে সংগঠণনটি।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, রাষ্ট্রীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। সংস্কার অর্থ- গবির মানুষের স্বল্পমূল্যের খাদ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে দাম বাড়ানো নয়। কৃষক, রিকশাওয়ালার পকেটের টাকা কেড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বর্ধিত বেতনের অর্থের যোগান দেওয়া নয়।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ না করে ক্যালকুলেটর টিপে গরিব মানুষের ৫ টাকা, ১০ টাকার খাবার পণ্যে ভ্যাট ৩০০ শতাংশ বাড়িয়ে সরকারের রাজস্ব আদায় করার বুদ্ধি যারা দেয়, তারা এ সরকারের ভালো চায় না। তারা এ সরকারকে বিপদে ফেলতে চায়। কারণ এভাবে ভ্যাট বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ে না। বেভারেজ শিল্প এর খুব ভালো উদাহরণ বলে জানান তারা।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির দাবির পর ভ্যাট প্রত্যাহার হচ্ছে, জানিয়ে বাংলাদেশ অটো বিস্কুটস অ্যান্ড ব্রেড ম্যানফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া সরকারকে সতর্ক করে বলেন- দাবি না মানলে কী করতে হবে, তা জানা আছে।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আগস্ট বিপ্লব হয়েছে আগের ফ্যাসিবাদী সরকারের ধারা থেকে বের হয়ে বৈষম্য নিরসনের জন্য। এ সরকার দেখি আগের ফ্যাসিবাদী সরকারকেও ছাড়িয়ে গেছে। স্বল্পমূল্যের প্রক্রিয়াজাত খাবারে ভ্যাট বাড়ানোর সমালোচনা করে শফিকুর রহমান বলেন, দরিদ্র কৃষক, রিকশাওয়ালা, নিম্নবিত্ত মানুষের পকেটের টাকা কেড়ে নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্ধিত বেতন-ভাতার অর্থ যোগান দেবেন? এটা হতে পারে না। 

ভ্যাট বাড়ানোর জন্য আইএমএফের ওপর দোষ চাপাচ্ছে সরকার- এমন অভিযোগ তুলে তিনি আরও বলেন, আইএমএফ কি স্বল্পমূল্যের পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে সরকারের রাজস্ব বাড়াতে বলেছে? সরকারের নীতিনির্ধাকরদের প্রতি প্রশ্ন রাখেন বাংলাদেশ অটো বিস্কুটস অ্যান্ড ব্রেড ম্যানফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। 

স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের চিফ অপারেটিং অফিসার পারভেজ সাইফুল ইসলাম বলেন, গত বছর থেকে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে। এ অবস্থায় নিত্য খাবারের পণ্যে অতিরিক্ত ভ্যাট বসিয়ে কী করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে? খাদ্যের দাম বাড়ালে নিম্নআয়ের মানুষের খাওয়া কমিয়ে দেবেন। আবার নিম্নমানের পণ্য খাবেন। এর দীর্ঘমেয়াদি খারাপ প্রভাব আছে। না ব্যবসায়, না সরকারের রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি হবে।

এসএমসি এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েফ নাসির বলেন, এক সময়ের ৮০ টাকার ডলার এখন ১২০ টাকা। গত বছরের তুলনায় চিনি, গমের আমদানি মূল্য অনেক বেশি। বাড়তি খরচই তুলতে পারছি না। এ অবস্থায় ভ্যাট বাড়ালে পণ্য বিক্রি কমে যাবে। এ অবস্থায় সরকার কী করে এ খাত থেকে বেশি রাজস্ব আয়ের চিন্তা করছে- এমন প্রশ্ন তাঁর।

বাপার সভাপতি এম এ হাশেম বলেন, আমরা এমন একটি খাত নিয়ে ব্যবসা করি যার সঙ্গে সরাসরি শ্রমজীবী নিম্নআয়ের মানুষ থেকে প্রান্তিক কৃষক জড়িত। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, এতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের মানুষের সংস্কৃতি যদি দেখি, অনেক নিম্নআয়ের মানুষ সকালে এক কাপ চা, একটি বিস্কুট কিংবা কেক খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এখন যদি বিস্কুট ও কেকের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর সঙ্গে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পায়, তাহলে ৫ টাকার একটি বিস্কুট আর তৈরি করা সম্ভব হবে না। ফলে নিম্নআয়ের মানুষটি সহজে ক্ষুধা নিবারণের পথটি হারাবেন।

তিনি বলেন, সরকারকে বোঝানো হয়েছে, ট্যাক্স বাড়লেই রাজস্ব বাড়বে, এ কথা ঠিক নয়। এতে করে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায় ক্ষতি হতে দেখলে হয় পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেবেন, না হয় ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন। তাতে কেনাবেচা কমবে। সরকার কাঙ্খিত রাজস্ব পাবে না। তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ, আমাদের শিল্পকে বাঁচান। এই সরকার অসংখ্য মানুষের আশা ভরসার সরকার।

হুঁশিয়ার দিয়ে এম এ হাশেম বলেন, ভ্যাট-ট্যাক্স যদি প্রত্যাহার না করেন, আমরা রাস্তায় নামবো। আমরা উৎপাদন বন্ধ করে দেব। যদি ভ্যাট-ট্যাক্স বেড়েই যায়, এমনিতেই আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, তারচেয়ে বরং আমরাই বন্ধ করে দেব।

প্রাণ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বলেন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের ৯০ শতাংশ পণ্যের ক্রেতা নিম্নআয়ের সাধারণ মানুষ। এসব পণ্য ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়। উৎপাদন পর্যায়ে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির পর প্যাকেটজাত ৫ টাকার বিস্কুট বিক্রি করে কোম্পানির কোনো মুনাফা হয় না। এ অবস্থায় ভ্যাট বাড়ালে কোম্পানি এ পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বাড়াতে পারবে না। ফলে এ খরচ কোম্পানির ওপর পড়বে। এ অবস্থায় ব্যবসায় লোকসান হলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া এ খাতের ব্যবসায়ীদের বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না।

বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা থেকে সরকারকে সরে আসার অনুরোধ করেন প্রাণ গ্রুপের প্রধান। তিনি বলেন, আগামী সাতদিন আপনাদের সঙ্গে দেখা করবো, কথা বলবো, ভিক্ষা চাইবো। তাতে কাজ না হলে, আমাদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যাবে, তখন রাস্তায় নামতে বাধ্য হবো। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য আগে বিদেশ থেকে আমদানি হতো। এখন আমরা ১৬০টি দেশে রপ্তানি করি। গত ২০ বছরে এ খাতের রপ্তানি ১০ গুণ বেড়ে ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এসব তথ্য স্মরণ করিয়ে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ভ্যাট বাড়লে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। রপ্তানি ব্যাহত হবে।

প্রসঙ্গত, ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। এর মধ্যে মেশিনে প্রস্তুতকৃত বিস্কুট, কেক, আচার, চাটনী, টমেটো পেস্ট, টমেটো কেচাপ, টমেটো সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যের ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া ফলের রস ও ফ্রুট ড্রিংকসের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর্টিফিসিয়াল বা ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস (নন-কার্বোনেটেড) পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক শূণ্য হারে ছিল এবং বর্তমানে তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী পর্যায়ে আগে ৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ ছিল যা বাড়িয়ে ৭.

৫ শতাংশ করা হয়েছে।   

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আলট ম ট ম এ অবস থ য় ব যবস য় সরক র র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

বাসাবাড়িতে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশু নিয়োগ বন্ধে আইন করার সুপারিশ

বাসাবাড়ির কাজে তথা গৃহকর্মে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়োগ বন্ধে কঠোর আইন করার পাশাপাশি কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন।

বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫-তে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ করা যাবে না।

শ্রম সংস্কার কমিশন এ প্রসঙ্গে বলেছে, গৃহকর্মে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়োগ বন্ধে কঠোর আইন করতে হবে। একই সঙ্গে এই আইনের কার্যকর বাস্তবায়নেও গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্রম সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৃহশ্রমিকদের বাংলাদেশ শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে হবে। এর আগপর্যন্ত নিশ্চিত করতে হবে ‘গৃহকর্মীর কল্যাণ ও সুরক্ষা নীতিমালা–২০১৫’–এর যথাযথ বাস্তবায়ন।

নিয়োগের ক্ষেত্রে আবাসিক, অনাবাসিক, খণ্ডকালীন বা স্থায়ী—সব ধরনের গৃহশ্রমিকদের জন্য কর্মঘণ্টা, বেতন, ছুটি, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সুবিধা উল্লেখ করে একটি স্বচ্ছ ও নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্মসংস্থান চুক্তি প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। পাশাপাশি নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে শ্রমিকের কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি কার বরাবর, কোন স্থানে এবং কীভাবে দায়ের করবেন, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

গৃহশ্রমিকদের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি ও নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মাধ্যমে গৃহকর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া গৃহকর্মীদের সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদানেরও সুপারিশ করেছে কমিশন।

পারলারের কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নেওয়ার পরামর্শ

এদিকে বিউটি পারলার খাতের শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে এ খাতের কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা ও তাঁদের সন্তানদের জন্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র বা ডে কেয়ার সুবিধা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতের কথা বলেছে কমিশন।

অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ খাতে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠনের সুপারিশও করেছে কমিশন। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মীদের কাজের মান ও ঝুঁকি বিবেচনা করে সুনির্দিষ্ট মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা এবং তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে পদোন্নতি কাঠামো তৈরি করতে হবে।

দেশের সব বিউটি পারলার শ্রমিকদের পেশাগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষার জন্য শ্রম আইন অনুযায়ী তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া, অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে।

বিউটি পারলারের কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান করাসহ সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা নির্দেশিকা প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বিউটি পারলারের কর্মীদের বড় একটি অংশ রাতে বাসায় ফেরে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে ও রাত্রিকালীন বাড়ি ফেরার সময় তাঁদের হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদা, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ