বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা হয়েছে অনেক। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের ‘ডেভেলপমেন্ট সারপ্রাইজ’, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ‘হোয়াই বাংলাদেশ ইজ বুমিং’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘টাইগার ইকোনমি’ আখ্যা দেওয়া অথবা মার্কিন সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টোফের নিউইয়র্ক টাইমসের বাংলাদেশের উন্নয়নবিষয়ক কলাম বা দ্য ইকোনমিস্টের বাংলাদেশের উন্নয়নকে ধাঁধা হিসেবে অভিহিত করা এর সাক্ষ্য।

যথার্থ এসব প্রশংসার সঙ্গে আরও যোগ করা যায়। পোশাকশিল্পে নারীরা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে করে তুলেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, স্বদেশে এনেছেন বিপ্লব। প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো অর্থ মহামারি অবস্থার মধ্যেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মজুত বাড়িয়ে চলছিল।

কৃষক রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসলের ফলন বাড়িয়ে চলেছেন। কোভিড-১৯–এর ভয়াবহ মহামারির মধ্যেও কৃষক তাঁর ফলন বাড়িয়েছিলেন। তার মানে হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান কারিগর এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ। অথচ এ দেশের মতো এত নিম্নমজুরি পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। উল্লিখিত ব্যক্তিদেরও ওপর থেকে প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের গল্পে বিমোহিত। তাঁরা ভেতরের গল্প জানেন না। তাঁরা জানেন না যে এই প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের ভিত্তি হলো শ্রমশোষণ।

এ দেশে শ্রমিকেরা যে মানবেতর জীবন যাপন করেন, তাঁদের লেখায় তার চিহ্নমাত্র নেই। আজ শ্রম দিবসে সেই গল্প লিখলে কিছুটা ‘পাপমোচন’ হতে পারে।

এটা এখন সর্বজনবিদিত যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি তৈরি পোশাকশিল্প। রপ্তানিমুখী এই তৈরি পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকের শেষ ভাগে, একটি ক্ষুদ্র ও অপ্রচলিত রপ্তানি খাত হিসেবে। ১৯৭৮ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম চালান রপ্তানি করে, তখন বাংলাদেশের মোট রপ্তানি মূল্য ছিল মাত্র ৬৯ হাজার মার্কিন ডলার। এর মাত্র দুই দশকের মধ্যেই, ২০০২ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে।

গত এক দশকে খাতটি গড়ে প্রতিবছর ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও এক অভূতপূর্ব সাফল্য। বস্তুত বিশ্বের যেকোনো নবীন শিল্পের জন্য এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উচ্চ প্রবৃদ্ধির উদাহরণ। এই দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে শিল্পভিত্তিরও শক্তিশালী সম্প্রসারণ ঘটেছে ১৯৮৩ সালে, যেখানে কারখানার সংখ্যা ছিল ৫০টিরও কম, ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪০০-এর অধিক এবং আরএমজি শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৫ লাখে পৌঁছায়। আর ২০২৩-এ রপ্তানিকারক কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৫৫৫টি, শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখ এবং এই খাত থেকে রপ্তানি পরিমাণ ৪৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা কয়েক দশক ধরেই মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি।

কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করতে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশ। ২০২৩ সালে চাল উৎপাদন ৩৯ দশমিক ১ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, যা ১৯৭৩ সালের ৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন থেকে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি ক্ষুদ্র কৃষক রয়েছেন, যাঁরা ১ দশমিক ২ কোটি খামারে কাজ করেন। অথচ কৃষকের স্বার্থ দেখার কেউ নেই।

শ্রমিক সংগঠনের মতো কৃষকদের তেমন কোনো সংগঠন নেই। ফলে তাঁদের দাবি আদায়ের ক্ষমতা নেই বললেই চলে। ১৯৮৪ সালের কৃষি শ্রমিক (সর্বনিম্ন মজুরি) অধ্যাদেশ কৃষিশ্রমিকদের জন্য দৈনিক সর্বনিম্ন মজুরি ৩ দশমিক ২৭ কেজি চাল অথবা তার আর্থিক সমমূল্য নির্ধারণ করে। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে অধ্যাদেশটি এখনো হালনাগাদ করা হয়নি। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষিশ্রমিকদের দ্বারা গঠিত হলেও তারা প্রায়ই মজুরি বৈষম্যের মুখোমুখি হন।

উদাহরণস্বরূপ, তথ্য অনুযায়ী পুরুষ কৃষিশ্রমিকদের দৈনিক গড় মজুরি প্রায় ৩৮৬ টাকা, যেখানে নারী শ্রমিকেরা গড়ে প্রায় ২৪৬ টাকা আয় করেন, যা বাংলাদেশের অন্য সব ক্ষেত্রের মতোই লিঙ্গবৈষম্যকে প্রকাশ করে।

রেমিট্যান্স অর্থনীতির আরেকটি প্রধান চালিকা শক্তি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আয় ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের অবদান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশের জিডিপির ৫ দশমিক ২১ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ।

অতীতে বিভিন্ন সরকার সঠিক মাধ্যমে (প্রপার চ্যানেলে) অর্থ পাঠানোর জন্য প্রবাসী শ্রমিকদের অনেক প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু আসল কাজটাই আজ পর্যন্ত কোনো সরকার করেনি। বাইরে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিকে পরিণত করার কাজটিই কেউ করেনি। এটা করতে পারলে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটত।

রাষ্ট্রের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেত। এখানে আমি একটি প্রস্তাব করতে চাই। বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থ থেকে রাষ্ট্রের যে আয় হয়, তা থেকে একটি ফান্ড গঠন করে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পরিবারের সন্তানদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা। যাতে তাঁদের সন্তানেরা স্বাচ্ছন্দ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এতে গরিব সন্তানেরা ধনীর সন্তানদের সঙ্গে কিছুটা হলেও টিকে থাকতে পারবে। এতে সমাজে বৈষম্য হ্রাস পাবে।

আশির দশকে যখন পোশাকশিল্পের উত্থান শুরু, তখন আনুষ্ঠানিক ন্যূনতম মজুরির কোনো কাঠামো ছিল না। ১৯৯৪ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়—মাসে ৯৩০ টাকা। এরপর ১২ বছর পর, অর্থাৎ ২০০৬ সালে মজুরি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১,৬৬২ দশমিক ৫০ টাকা। ২০১০ সালে মজুরি বৃদ্ধি পেয়ে হয় মাসে ৩ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে মজুরি বেড়ে হয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৮ সালে শ্রমিকেরা ১৬ হাজার টাকার দাবির পরেও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয় মাত্র ৮ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে বিক্ষোভের পর মজুরি বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১২ হাজার ৫০০ টাকা (প্রায় ১১৩ মার্কিন ডলার), যা এখনো শ্রমিকদের দাবিকৃত ২৩ হাজার টাকা (প্রায় ২০৮ মার্কিন ডলার) থেকে অনেক কম।

পক্ষান্তরে, প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক সব দেশেই ন্যূনতম মজুরি ছিল আমাদের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। কম্বোডিয়ায় ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬১ ডলার, যা ২০১৮ সালে বেড়ে হয় ১৭০ ডলার, ২০২৫ সালে ২০৮ ডলার। ভিয়েতনামে ২০১৬ সালে ন্যূনতম মজুরি ছিল (অঞ্চলভেদে) প্রায় ১১০ ডলার থেকে ১৬১ ডলার, যা ২০২৫ সালে হয় ১৭৫ ডলার। ভারতে ২০১৬ সালে (অঞ্চলভেদে) মজুরি ছিল পোশাক ১০৬ ডলার এবং ২০২৫-এ ১৭৮ ডলার। চীনে ২০২৪ সালে ন্যূনতম মজুরি অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন; গড়ে ৪০০ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানেও ন্যূনতম মজুরি আমাদের দেশের থেকে বেশি, ২০২৫ সালে প্রায় ১৩২ ডলার।

এই তুলনা স্পষ্ট বলে দেয় যে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকেরা ঐতিহাসিকভাবে অন্যান্য প্রধান রপ্তানিকারক দেশের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম মজুরি পেয়ে আসছেন।

গত তিন দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ২৪ গুণ বেড়েছে। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির হার সেই তুলনায় নগণ্য। সংখ্যাগতভাবে কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও প্রকৃতপক্ষে মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় অনুযায়ী এটি এখনো অপর্যাপ্ত। অর্থাৎ শ্রমিকদের ন্যূনতম আয়–ইনকাম কিছুটা বাড়লেও প্রকৃত আয় মোটেই বাড়েনি।

তার মানে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের বহুল প্রশংসিত এই অর্থনৈতিক উত্থান মূলত শ্রমিক শোষণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ২০২৩ সালে শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকেই ৪২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশের সমান এবং এই আয়ের পেছনে রয়েছে কোটি কোটি স্বল্প-মজুরির শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম, যাঁদের অনেকেই নারী। এই পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ এবং প্রতি ব্যক্তির জন্য জাতীয় আয়ে গড়ে প্রায় ১৮৪ ডলার অবদান রেখেছে। ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে যে শ্রমিকের অবদান সিংহভাগ, সেই শ্রমিকই রয়ে গেছেন দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র আবদ্ধ। এই ‘অর্থনৈতিক বিস্ময়’ ন্যায্য সমৃদ্ধির অর্থাৎ সবার জন্য সমৃদ্ধির ওপর নয়, বরং কর্মজীবী শ্রেণির পদ্ধতিগত দমন-পীড়নের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

ন্যায্য মজুরির দাবিতে এ দেশে বারবার আন্দোলন হয়েছে। প্রতিবারই সরকার ও মালিক পক্ষ একই সুরে এটাকে চক্রান্ত আখ্যা দিয়ে দমন, পীড়ন ও হত্যার পথ বেছে নিয়েছে। একই সুরে কথা বলবে কারণ সরকারের মন্ত্রী, এমপিরাই কারখানার মালিক। ব্যবসায়ী শ্রেণির হাতে রাজনীতি থাকলে যে শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য ফিরবে না, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য।

বাংলাদেশের অবস্থা অন্যান্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশে থেকে আলাদা। কারণ, এখানে আজও একটি প্রকৃত পুঁজিপতি শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। ফলে পুঁজিবাদের উদারতা থেকে আমরা বঞ্চিত। লুটপাটের সংস্কৃতি কোনোক্রমেই পুঁজিবাদের সংস্কৃতি নয়।

জীবনের শেষ দিকে, রবীন্দ্রনাথ একসময় উপলব্ধি করলেন, যাঁদের শ্রমে এই জগৎসংসার চলছে, তাঁদের জন্য কিছুই লেখা হয়নি, তাঁর সাহিত্যে সেই শ্রমজীবী মানুষেরই কোনো স্থান হয়নি। এ জন্য তিনি গভীর বেদনা অনুভব করলেন। ১৯৪১ সালে ‘জন্মদিনে’ কবিতায় তিনি লিখলেন:

‘চাষি ক্ষেতে চালাইছে হাল,

তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল’

একই কবিতায় তিনি তাঁর সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করেন এবং এমন একজন কবির আবির্ভাব কামনা করেন, যিনি তাঁর কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের জীবনগাথা রচনা করবেন। তিনি লিখেছেন:

‘আমার কবিতা, জানি আমি,

গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সর্বত্রগামী

.

..

যে আছে মাটির কাছাকাছি

সে কবির-বাণী-লাগি কান পেতে আছি’

এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ । সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রব দ ধ শ রমজ ব উল ল খ র জন য দশম ক সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শক্তিশালী ব্যালান্স শিট প্রবৃদ্ধিসহ ২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সাফল্য

চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংক সমন্বিতভাবে কর-পরবর্তী নিট মুনাফায় (এনপিএটি) পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২৪ সালে অঙ্গপ্রতিষ্ঠানসহ সমন্বিতভাবে ব্যাংকটি ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা কর-পরবর্তী নিট মুনাফা অর্জন করেছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ৮২৮ কোটি। ব্যাংকিং খাতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি।  

একক (স্ট্যান্ডঅ্যালন) ভিত্তিতে ২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকায়, যেখানে আগের বছরের ৭৩০ কোটি টাকার তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৬ শতাংশ। ব্যাংকিং খাতে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি সত্ত্বেও ব্র্যাক ব্যাংক ব্যালান্স শিটে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাভারেজের চেয়েও অনেক বেশি। এ সময় ব্যাংকটি এককভাবে গ্রাহক আমানতে ৩৪ শতাংশ এবং ঋণে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

২৮ এপ্রিল ২০২৫ ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকটির ২০২৪ সালের আর্থিক বিবরণী অনুমোদন করে। ব্যাংকটির আর্থিক বিবরণীতে উঠে আসা উল্লেখযোগ্য সূচকগুলো এখানে তুলে ধরা হলো—

শক্তিশালী গ্রাহক-ভিত্তি এবং খাতভিত্তিক সহায়তা

২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের রিটেল ব্যাংকিং সেগমেন্টে সাড়ে তিন লাখ নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়েছে, যার ফলে ব্যাংকটির রিটেইল ব্যাংকিং সেগমেন্টে এখন মোট গ্রাহকসংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। এই অর্জন পারসোনালাইজড ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান ব্যাংকিং প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারে ব্যাংকটির নিবেদিত প্রচেষ্টার প্রতিফলন। দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর এসএমই খাত। ব্যাংকটি এই সেগমেন্টে এক লাখের বেশি নতুন সিএমএসএমই গ্রাহক যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, যা উদ্ভাবন ও তৃণমূল উদ্যোক্তাদের সহায়তার ব্যাপারে ব্যাংকটির ব্যক্ত করা প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। এ ছাড়া ব্যাংকটি করপোরেট ব্যাংকিং সেগমেন্টে ক্লায়েন্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৯ হাজার। এভাবে ব্র্যাক ব্যাংকের করপোরেট ব্যাংকিং সেগমেন্ট দেশের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

কৌশলগত ডিজিটাল উদ্যোগ

২০২৪ সালেও ব্র্যাক ব্যাংক ডিজিটাল রূপান্তরযাত্রায় ধারাবাহিক বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। নতুন অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে ৭৭ শতাংশই খোলা হয়েছে ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট ওপেনিং প্ল্যাটফর্ম ‘ইকেওয়াইসি’র মাধ্যমে। ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকটির আস্থা অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ লাখ। এই ইন্টারনেট ব্যাংকিং অ্যাপে ২০২৪ সালে ২ কোটি ৭০ লাখের বেশি লেনদেনের মাধ্যমে দেড় লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, যা গ্রাহকদের সহজ, সুবিধাজনক ও নিরাপদ ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা প্রদানের ব্যাপারে ব্যাংকটির প্রতিশ্রুতি প্রতিফলন।

সমাজের মানুষকে ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিতকরণ

ব্র্যাক ব্যাংকের গৃহীত উদ্যোগ আর্থিক সাফল্যের চেয়েও বেশি কিছু। ব্যাংকিং খাতে মোট জামানতবিহীন সিএমএসএমই ঋণের ৪৩ শতাংশই অর্থায়ন করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির ‘উদ্যোক্তা ১০১’ কর্মসূচির আওতায় দেশের ২১০ জন নারী উদ্যোক্তা বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা পেয়েছেন। ৯৭৯ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক গ্রামীণ উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

বৈশ্বিক খাতে অবদান এবং পরিবেশগত উন্নয়ন

রপ্তানিতে ২.০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আমদানিতে ৩.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্যক্রম সম্পন্নের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সবুজ কারখানা ও টেকসই প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক পরিবেশগত খাতে সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।

উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর প্রদানের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অবদান

একটি দায়িত্বশীল করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০২৪ সালে কর প্রদানের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক সরকারের রাজস্ব কোষাগারে ১ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকার অবদান রেখেছে।

নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ

দেশের আরও বেশি মানুষের কাছে সহজ ও সুবিধাজনক ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে ব্র্যাক ব্যাংক নিজেদের ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করে চলেছে। ২৬৩টি শাখা ও উপশাখা, ৩২৯টি এটিএম, ৪৪৬টি এসএমই ইউনিট অফিস এবং ১ হাজার ১১৯টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিস্তৃত ব্যাংকিং নেটওয়ার্কগুলো মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। সর্বাধিক বিস্তৃত ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গ্রাহকদের আরও উন্নত, সহজ, সুবিধাজনক ও উপভোগ্য ব্যাংকিং সেবা দিতে ব্র্যাক ব্যাংক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

২০২৪ অর্থবছরে ব্র্যাক ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স

• সমন্বিত শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ২০২৩ সালের ৪.৩০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪ সালে ৬.৯৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

• শেয়ার প্রতি সমন্বিত নিট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) আগের বছরের তুলনায় ৩৭.৬০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪.১১ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

• শেয়ার প্রতি সমন্বিত নিট ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) ২০২৩ সালের ৩৭.০৫ টাকার তুলনায় ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০.৯১ টাকায়।

• ইয়ার-অন-ইয়ার ভিত্তিতে ব্র্যাক ব্যাংকের লোন পোর্টফোলিও বেড়েছে ২০ শতাংশ, যেখানে ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাভারেজ ছিল ৭ শতাংশ।

• এ সময় গ্রাহক আমানত ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাভারেজ ছিল ৭ শতাংশ।

• সমন্বিত রিটার্ন অন ইকুইটি (আরওই) এবং রিটার্ন অন অ্যাসেট (আরওএ) যথাক্রমে ১৯.৮০ শতাংশ এবং ১.৫১ শতাংশ।

• ঋণ প্রবৃদ্ধি, দক্ষ তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং বেশি নন-ফান্ডেড আয়ের ফলে ইন্টারেস্ট আয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। এর ফলে ২০২৪ সালে মোট সমন্বিত আয় ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

• ব্যাংকের কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মানবসম্পদ, প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগের ফলে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে মোট সমন্বিত পরিচালন ব্যয় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

• বিশেষ করে আন্ডাররাইটিং, মনিটরিং এবং রিকভারির ওপর জোর দেওয়ার ফলে নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) ২০২৩ সালের ৩.৩৮ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ২.৬৩ শতাংশ হয়েছে।

প্রবৃদ্ধিযাত্রা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ব্র্যাক ব্যাংক রেগুলেটরি ক্যাপিটাল বৃদ্ধির প্রতি জোর দিয়েছে। সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ২০২৪ সালে ব্যাংকটির রেগুলেটরি ক্যাপিটাল ৭ হাজার ১৪৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ৫ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।

২০২৪ অর্থবছরের এই অসাধারণ অর্জন সম্পর্কে মন্তব্য করে ব্র্যাক ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘২০২৪ সালে আমাদের এই অর্জিত সাফল্য গ্রাহক, সমাজ ও দেশের প্রতি ব্র্যাক ব্যাংকের অবিচল প্রতিশ্রুতির উদাহরণ। গ্রাহক ও স্টেকহোল্ডারদের আস্থা ও বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে আমরা উদ্ভাবন, ক্ষমতায়ন এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে অবদান অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর।’

সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন আরও বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিক সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সব স্টেকহোল্ডারের কাছে ব্র্যাক ব্যাংক এখন এক আস্থার নাম। করপোরেট সুশাসন, কমপ্লায়েন্স এবং মূল্যবোধনির্ভর ব্যাংকিংয়ে ব্র্যাক ব্যাংক রোল-মডেল হিসেবে স্বীকৃত। এমন অর্জনের জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রাহকদের প্রতি—তাঁদের অবিচল আস্থার জন্য; আমাদের পরিচালনা পর্ষদের প্রতি—তাঁদের ধারাবাহিক দিকনির্দেশনার জন্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি—চ্যালেঞ্জিং সময়েও তাঁদের দূরদর্শী রেগুলেটরি দিকনির্দেশনার জন্য।’

আর্থিক তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত ব্র্যাক ব্যাংকের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে: https://www.bracbank.com/en/investor-relations#financialStatements

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আনুশকা কি আর অভিনয়ে ফিরবেন
  • আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন 
  • ২০২৬ এশিয়ান গেমসেও থাকছে ক্রিকেট
  • শক্তিশালী ব্যালান্স শিট প্রবৃদ্ধিসহ ২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সাফল্য
  • কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের পদাবনতি, দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার
  • দুই বছর ধরে ঝুলছে যুবলীগ নেতা জামাল হত্যা মামলার তদন্ত
  • নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের জবি শাখার ৩৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা
  • সড়কের কাজ ফেলে রেখে উধাও ঠিকাদার, দুর্ভোগে অর্ধলাখ বাসিন্দা
  • তালেবান সরকার কেন ভারতের দিকে ঝুঁকছে