এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে আল-নাসর। তবে মাঠের ফলাফলের চেয়েও এখন আলোচনায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর প্রতিক্রিয়া। ম্যাচ শেষে তার ‘বিষণ্ণ ও নাটকীয়’ আচরণ উপহাস হিসেবে দেখছেন ফুটবলপ্রেমীরা।

বুধবার রাতে জেদ্দার আলিনমা স্টেডিয়ামে জাপানি ক্লাব কাওয়াসাকি ফ্রন্টেলের বিপক্ষে ৩-২ গোলে হারে সৌদি ক্লাব আল-নাসর। এই পরাজয়ে রোনালদোর দলের সামনে চলতি মৌসুমে আর কোনো ট্রফি জয়ের সুযোগ থাকল না। সেমিফাইনালের ম্যাচটিতে রোনালদো একটি সুবর্ণ সুযোগও নষ্ট করে। প্রতিপক্ষ দলের গোলরক্ষককে কাটিয়ে গেলেও শেষ মুহূর্তে বল জালে পাঠাতে ব্যর্থ হন পর্তুগিজ মহাতারকা। সমর্থকদের মতে, রোনালদোর গোল মিস করাটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।

ম্যাচ শেষে হতাশ রোনালদোকে দেখা যায় মাঠের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে কথা বলতে ও আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত নেড়েছেন। তার এই অদ্ভুত আচরণ নিয়েই এখন সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

একজন টুইটারে লিখেছেন, ‘রোনালদোর জন্য ‘ফুটবলকে ছেড়ে দাও, তার আগেই যে ফুটবল তোমাকে ছাড়বে’—এই কথাটা একেবারে যথার্থ।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘এই লোকটা এখন আর মজার না… শুধু অহঙ্কারে ভরা।’

তৃতীয় একজন মন্তব্য করেছেন, ‘মেসির বিশ্বকাপ জয় মানসিকভাবে শেষ করে দিয়েছে রোনালদোকে।’ অন্য একজন কটাক্ষ করে বলেন, ‘ক্যামেরার জন্য এমন মরিয়া চেষ্টাও এক রকম প্রশংসার দাবি রাখে—যদি না সেটা এত করুণ হতো।’

অনেকে আবার রোনালদোর স্বার্থপরতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সে শুধু নিজের রেকর্ডের জন্য খেলে, দলের জন্য নয়।’

তবে এত সমালোচনার পরও অবসরের কোনো ইঙ্গিত দেননি রোনালদো। বরং সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়ে দলের প্রতি নিজের গর্বের কথা জানান তিনি। রোনালদো লেখেন, ‘সবসময় স্বপ্ন পূরণ হয় না। তবে আমি গর্বিত আমাদের পারফরম্যান্স নিয়ে। যারা আমাদের পাশে থেকেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আপনাদের সমর্থন আমাদের অনেক কিছু বলে।’

এদিকে ম্যাচ শেষে আল-নাসরের কোচ স্তেফানো পিওলি দলের পারফরম্যান্সে ক্ষোভ ঝাড়েন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কৌশলে সমস্যা ছিল, দ্বিতীয়ার্ধে ঝুঁকি নিয়েছিলাম। তবে যে পারফরম্যান্স হয়েছে, তা হতাশাজনক। প্রতিপক্ষ আমাদের চমকে দেয়নি, বরং নিজেদের দুর্বলতাই বড় ধাক্কা দিয়েছে।’

এই হারে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে ছিটকে পড়েছে আল-নাসর, আর প্রশ্নটা থেকে গেছে—রোনালদো আসলে কোথায় গিয়ে থামবেন?

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম দ র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে

ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে উপনিবেশিত সব দেশকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়েছিল। অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষা আর সংগ্রামের বিনিময়ে এসেছিল স্বাধীনতা; কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘মুকুটরত্ন’ খ্যাত ভারতের মতো এত বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরের দেশে ও দেশের বাইরে বিরাট ক্যানভাসে স্বাধীনতার সংগ্রাম মনে হয় আর কোনো উপনিবেশের স্বাধীনতার জন্য করতে হয়নি।

আমরা সাধারণত ভারতীয় উপমহাদেশে সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু এমন অনেকে ছিলেন, যাঁরা ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে বিদেশের মাটিতে বসে অসংখ্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলাদেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা কিংবা জনপ্রিয় লেখাজোখাতেও তাঁদের আত্মত্যাগের গল্প খুব কমই উঠে আসে।

অথচ এই বিপ্লবীদের রয়েছে এমন এক গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বগাথা, যা ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা দুনিয়ায় ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামরত সব মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার। কল্পনা করুন, পুলিশের চোখ এড়াতে একজন বিপ্লবী সিঙ্গাপুরের উপকূল থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে পাড়ি দিচ্ছেন জেলে নৌকার সাহায্যে। আরেকজন ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে সাঁতরে পাড়ি দিচ্ছেন মিসরের সুয়েজ খাল। এসব ঘটনা থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের অদম্য প্রচেষ্টার দু–একটি উদাহরণ পাওয়া যায়।

বিদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু সুপরিচিত। তবে তাঁরও অনেক আগে একদল ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। শুরুতে তাঁরা জার্মানি এবং পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন ১৮৯২ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী। তিনি একা নন, মস্কোয় আরও দুজন বাঙালি বিপ্লবী লুহানীর মতো একই ভাগ্য বরণ করেছিলেন। একজন তৎকালীন বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যজন সাতক্ষীরার অবনী মুখোপাধ্যায়।

যেভাবে বইটির সূচনা

সম্প্রতি প্রকাশিত গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি বই থেকে বিপ্লবী লুহানীর বর্ণিল জীবন ও বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়। বইটির লেখক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লুহানীর জীবন ও কর্ম উদ্‌ঘাটন করেছেন তাঁর ৪২ বছরের নিরলস সাধনায়।

মতিউর রহমান ১৯৮১ সালে দিল্লি ভ্রমণে গেলে বিজ্ঞানী ও কমিউনিস্ট নেতা ড. গঙ্গাধর অধিকারীর কাছ থেকে লুহানীর কথা প্রথম জানতে পারেন। গঙ্গাধর অধিকারী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে কাজ করার সময় লুহানীর বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯২৯ সালের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর গ্রেপ্তারের ঘটনাটি বেশ আলোচিত। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ব্রিটিশ সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।

১৯৮১ সাল থেকে মতিউর রহমান লুহানী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বার্লিন, মস্কো, দিল্লি ও কলকাতার বিভিন্ন আর্কাইভের শরণাপন্ন হন। তিনি সবকিছু জোগাড় করতে পারেননি বলে বইয়ের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। তবে আপাত ‘বিস্মৃত’ এই বিপ্লবীর ওপর যে পরিমাণ তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন, সেটিও অভূতপূর্ব।

এই বইয়ে লেখক লুহানীর বহুমুখী কাজের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিকও তুলে এনেছেন। বইটিতে প্যারিস থেকে সিরাজগঞ্জে মায়ের কাছে লেখা লুহানী ও তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের চিঠি এবং তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় লুহানীর পরিবারের সদস্য ও কলকাতার একটি শিপিং এজেন্সির মধ্যকার চিঠি আদান–প্রদানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বইটির প্রতি লেখকের গভীর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। ১৯৮০’–এর দশকের মাঝামাঝি রুশ ইতিহাসবিদ ও ভারতবিশেষজ্ঞ লিওনিদ মিত্রোখিনের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়েছিল মস্কোয়। ১৯৯১ সালে মিত্রোখিন দিল্লি থেকে প্রকাশিত সোভিয়েত ল্যান্ড পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো তিনজন বাঙালি বিপ্লবী—বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখোপাধ্যায় ও গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর করুণ পরিণতির কথা প্রকাশ করেন। তাঁদের সবারই বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিল। নিবন্ধের শেষে মিত্রোখিন লিখেছেন, মতিউর রহমান লুহানীকে নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করছেন, যা এই বিপ্লবীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। কয়েক দশক পর অবশেষে ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেই প্রতীক্ষিত বইটি আলোর মুখ দেখেছে।

বইটি থেকে জানা যায়, লুহানী প্রবেশিকা পরীক্ষা (বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষার সমমান) পাস করার পর ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত মিডিয়া ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফতেহ লোহানী ও ফজলে লোহানী এবং তাঁদের বোন বিশিষ্ট গায়িকা অধ্যাপক হুসনা বানু খানমের মামা। ফজলে লোহানীর মাধ্যমে মতিউর রহমানের যোগাযোগ ঘটে গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর ভাগনে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে; যিনি বহু বছর ধরে পারিবারিক চিঠিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

বইটি যখন প্রকাশের জন্য প্রস্তুত, তার কয়েক মাস আগে ২০২৪ সালের মে মাসে একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। নিউইয়র্কের শিল্প–গবেষক জুলিয়া বডেউইন মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে লুহানীর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েল সোয়েন সম্পর্কে জানতে চান। এই যোগাযোগের সূত্র ধরে আরও বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর জানা যায় যে গ্যাব্রিয়েল ছিলেন একজন ফরাসি মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনার।

লুহানীর খোঁজে 

মতিউর রহমানের সংগ্রহ করা নথিপত্র থেকে জানা যায়, লুহানী লন্ডনে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও শ্রমিক আন্দোলন এবং সোভিয়েত বিপ্লবের সমর্থনে কাজ করেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি সাংবাদিক ও শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে বসবাস করেন এবং সেখানকার সংবাদপত্রগুলোতে ভারতের রাজনৈতিক ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ইংরেজি ছাড়াও তিনি ফরাসি, ফারসি, জার্মান ও হিন্দি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

১৯২১ সালে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লুহানী প্রথম একটি প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী দলের অংশ হিসেবে মস্কো সফর করেন। কিন্তু দলটি কমিন্টার্নের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। তবে লুহানী কিছু সময়ের জন্য সেখানে থেকে কমিন্টার্নের প্রচার বিভাগ অ্যাজিটপ্রপে কাজ করেন। প্যারিসে থাকাকালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা দ্য মেসেজ অব ইন্ডিয়া সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এ ছাড়া তিনি কমিটি প্রো-হিন্দুর (ভারতীয় অর্থে) সঙ্গে কাজ করেছেন। এই কমিটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করত। ফরাসি লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী ওঁরি বারবুস ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। বারবুসের লেখার মাধ্যমে ‘লস্ট জেনারেশন’–এর বহু লেখক প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও এরিখ মারিয়া রেমার্ক অন্যতম।

প্যারিসে থাকাকালে লুহানীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলে সেখানে তাঁর থাকার অনুমতি বাতিল করা হয়। এ বছরের জুলাই মাসে আমি প্যারিসে গেলে মোঁপানাস এলাকায় লুহানীর সেই বাড়ির ঠিকানায় যাই। বাড়ির উল্টো দিকে থাকা একটি ক্যাফের লোকদের সঙ্গে আলাপে লুহানীর কাহিনি শুনে তাঁরা অবাক হন। ক্যাফের একজন জানান, বাড়িটি এখনো আবাসিক ভবন হিসেবেই আছে; কিন্তু কোনো বাঙালি থাকেন বলে তাঁরা জানেন না। অপ্রত্যাশিতভাবে পাশের সড়কেই পেয়ে যাই লুহানীর স্ত্রীর পোর্ট্রেট আঁকা প্রখ্যাত শিল্পী আমেদেও মোদিলিয়ানির বাড়ি। যদিও লুহানীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পরিচয়ের অনেক আগেই মোদিলিয়ানি সেই পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, এটি এখন আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

১৯২৫ সালের অক্টোবরে লুহানী স্থায়ীভাবে মস্কোয় চলে যান। ১৯২৮ সালে তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ এবং ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ সময়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বৈশ্বিক কেন্দ্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে (কমিন্টার্ন) বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।

লুহানীর ওপর লেখা এই বইয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। তিনি সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে কমিন্টার্নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। যুক্ত ছিলেন পিজ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল ও মোপার (বিপ্লবীদের সাহায্য করার আন্তর্জাতিক সংস্থা) সঙ্গে। এ ছাড়া তিনি রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, নারিমানভ ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ ও কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব দ্য টয়েলার্স অব দ্য ইস্ট-এ কাজ করেছেন। তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় বিষয় নিয়েও বক্তৃতা দিতেন।

মস্কোয় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কমিন্টার্ন কংগ্রেসে লুহানী ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে তিনি এম এন রায়ের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। ১৯৬৪ সালের ৩০ আগস্ট, লিংক-এর মস্কো সংবাদদাতা পি উন্নিকৃষ্ণান একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে লুহানী জাতীয় ও ঔপনিবেশিক বিষয়ে কমিন্টার্নের একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। মতিউর রহমান ৪২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টা ও আবেগের সংমিশ্রণে সংগৃহীত নথিপত্র কাজে লাগিয়ে লুহানীর এই অসাধারণ জীবন ও বহুমুখী অবদানকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

লুহানী ছাড়াও এই বইয়ে বার্লিন ও মস্কোভিত্তিক ভারতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও উদ্যোগের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ১৯২১ সালে লুহানী, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং পান্ডুরাজ খানখোজে যৌথভাবে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ নামে একটি থিসিস রচনা করে রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এর প্রত্যুত্তরও তাঁরা পেয়েছিলেন লেনিনের কাছ থেকে। উল্লেখ্য, ‘নাইটিঙ্গেল অব দ্য ইস্ট’ নামে পরিচিত বিখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী ও কবি সরোজিনী নাইডুর ছোট ভাই ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত লুহানীর প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিখ্যাত বিপ্লবী এম এন রায় এবং সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির প্রশংসা করেছেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি ও সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে।

মরণোত্তর সম্মান

বইটিতে ব্যবহৃত সোভিয়েত গোয়েন্দা নথিপত্র থেকে জানা যায়, স্তালিনের শাসনামলে লুহানী সন্দেহ ও অবিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেককে ভিন্নমতের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই করুণ পরিণতি থেকে লুহানীও রেহাই পাননি। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্তালিনের নির্দেশে মস্কোর কাছে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডির প্রশিক্ষণ মাঠ কমিউনারকায় তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত সুপ্রিম কোর্টের সামরিক কলেজিয়াম তাঁর বিচারকে ভুল বলে ঘোষণা করে এবং তাঁকে মরণোত্তর সম্মান প্রদান করে।

এই বইয়ে লুহানীর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ও ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ থিসিসসহ অনেকগুলো চিঠি ও নথি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ড. বিনায়ক সেনের একটি প্রবন্ধ, লিওনিদ মিত্রোখিনের ‘আ ট্রিপল ট্র্যাপ’ নিবন্ধ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কমিন্টার্ন–বিশেষজ্ঞ ড. শোভনলাল দত্তগুপ্তের সঙ্গে মতিউর রহমানের একটি কথোপকথন। তাঁদের এই আলোচনায় সেই সময়ের বিপ্লবী, কমিন্টার্ন ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

লুহানীর দুর্লভ রঙিন ছবি, তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের পোর্ট্রেট ও প্রতিকৃতি, বিভিন্ন শহরে তাঁদের বাসস্থানের ছবি এবং গুরুত্বপূর্ণ চিঠি যুক্ত করার মাধ্যমে বইটি আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বই থেকে একজন বাঙালি বিপ্লবীর করুণ পরিণতি সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনি বিচরণ করা যায় ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট কালপর্বে, যার প্রভাব আজও ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ–রাজনীতির নানা স্তরে। নিঃসন্দেহে এই বই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

খলিলউল্লাহ্ লেখক ও সাংবাদিক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার অতি আগ্রহের কারণ কী, প্রশ্ন টিআইবির
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • মুসলিম পরিবারে শিশুর নিরাপত্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • পুরোপুরি বিলুপ্তির পর উগান্ডায় আবার ফিরল গন্ডার
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু : পুলিশের দাবি, বাড়ির ছাদ থেকে পড়েছেন, হত্যার অভিযোগ পরিবারের
  • ওভালজয়ী সিরাজই আগস্টের সেরা ক্রিকেটার
  • সিজেএফবি পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা