বেশি শাসনে যা হতে পারে

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন কোনো ভুল করলে মা-বাবা, বড় ভাই-বোনের কাছে বকা বা মার খেয়েছি। আবার মন খারাপ করে চোখের পানি মুছে নিজেরাই স্বাভাবিক হয়ে যেতাম। কিন্তু এখনকার শিশু-কিশোরদের অতিমাত্রায় বকা বা শাসন করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।

এখনকার অনেক অভিভাবকও অবশ্য সন্তানের খাওয়া, লেখাপাড়া, সৃজনশীল কাজ নিয়ে অতিমাত্রায় শাসন করেন। অনেকের ধারণা, মুঠোফোন, ভিডিও গেম, কার্টুনের যুগে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সবার সামনে বকা দেওয়া যেতেই পারে। বকা দিলে সন্তান মা-বাবার কথা মতো চলবে, ঠিকমতো পড়বে, সঠিকভাবে পুষ্টিকর খাবার খাবে। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। এই প্রজন্মের শিশুকে নিজের সঙ্গে মেলালে আপনি ভুল করবেন। একদিন বকা বা মার খেয়ে শিশু চুপ থাকতে পারে। কিন্তু দিনের পর দিন এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে থাকলে সন্তান একসময় অতিমাত্রায় বিরক্ত হবে।

গবেষণার তথ্য বলছে, যেসব শিশু অতিমাত্রায় কড়া শাসনের মধ্যে বড় হয়, তারা পরবর্তী জীবনে বেশি আতঙ্কের মধ্যে থাকে। এ ধরনের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তিক্ততা থেকে এসব শিশু-কিশোর অধিকাংশ সময় পরিবার ছাড়াও অন্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে ফেলে।

সন্তান অতিমাত্রায় দুষ্টুমি করলে বা খুব বেশি অবাধ্য হলে, তাকে শাসন করতে হবে। তবে সেটা সব মানুষের সামনে চিৎকার-চেঁচামেচি করে নয়। শিশুকে অপদস্ত করলে ফল ভালো হবে না। শিশুদের আদর করে, বারবার বুঝিয়ে বলতে হবে। যেসব শিশু অভিভাবকের কাছ থেকে নিয়মিত বকা খায়, সেসব শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে, তারা একটুতেই ভয় পায়।

আরও পড়ুনশিশুকে ভয় দেখাবেন না২০ অক্টোবর ২০২১কড়া শাসনে শিশুর ব্যক্তিত্ব যেভাবে বদলে যায়সন্তানকে কড়া শাসন না করে বোঝাতে হবে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সব শ শ

এছাড়াও পড়ুন:

সমাজের মধ্যে আরেকটা সমাজ গড়ে তুলেছিল ‘বেগম’ 

দেশভাগের পর থেকে  এ জনপদের নারীদের সামাজিক ও মনস্তাত্বিক উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল ‘বেগম পত্রিকা’। শহুরে সংস্কৃতিতেই শুধু নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের কাছে বেগমের আবেদন ছিল অনেক বেশি। গ্রামে  খোলা ডাকে পৌঁছাতো ‘বেগম’ বেগম পত্রিকা। ওই সময় যারা অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানতেন তারা যেমন বেগম পত্রিকার পাঠক ছিলেন, তেমনি উচ্চশিক্ষিতরাও বেগম পড়তেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাকযোগে পত্রিকাটা যেত। মজার একটা ডাক ব্যবস্থা ছিল, ‘বুক পোস্ট’। এই মাধ্যমে স্বাভাবিক ডাক মাশুলের চেয়ে অনেক কম পয়সায় একটি ডকুমেন্ট এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো যেত। আমার মনে আছে পঁচিশ পয়সায় একটি পত্রিকা চলে যেত ঢাকা থেকে। একটু ফোল্ড করে ওপরে একটি কাগজে ঠিকানা আর পঁচিশ পয়সার একটা স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেওয়া হতো। তখনকার দিনে নিয়ম ছিল, আপনি কম টাকায় খোলা ডাকে ডকুমেন্ট পাঠাতে পারবেন। যেখানে একটি চিঠি পাঠাতে খরচ হতো আট আনা। 

যদিও বেগম মূলত নারীদের পত্রিকা। কিন্তু তখনতো খুব কম মেয়েই ছিল যে স্কুল কলেজে যেত। অনেক গ্রাম ছিল, যেখানে কোনো প্রাইমারি স্কুলই ছিল না। প্রাইমারি স্কুল খুঁজতে আবার আরেক গ্রামে যেতে হতো। আশির শুরুর দিক পর্যন্ত এই চিত্র ছিল। কিছু মানুষ ব্রিটিশ আমলে চাকরিসূত্রে পরিবারসহ শহরে থাকতেন। যখন দেশ ভাগ হয়ে গেলো তখন তাদের অনেকেই গ্রামে ফিরে আসলেন। এবং তাদের মনে ওই যে ‘শহর’ ছিলো, ওই যে শহুরে সংস্কৃতিতে জ্ঞান চর্চা, লাইব্রেরিতে যাওয়া— ওই সংস্কৃতি তারা গ্রামে পেলেন না। তখন এই অভাবটা পূরণ করতো বেগম, সওগাত, মোহাম্মদী পত্রিকাগুলো।  আমার নিজের দেখা যেটা, বেগম পত্রিকাটা পড়া হতো একেবারে সম্মিলিতভাবে। গ্রামে হয়তো একটা বাড়িতে বেগম রাখা হতো। সবাই ওই বাড়িতে যেতেন পত্রিকাটা পড়তে, কেউ কেউ যেতেন শুনতে। বেগম যে শুধু নারীর পত্রিকা তা কিন্তু নয়।মজার ব্যাপার হলো বেগম পুরুষেরাও পড়তেন।

আরো পড়ুন:

‘ব্লু লাইট’ যেভাবে ঘুমের ক্ষতি করে

কাজ নাকি কাজের ‘রেজাল্ট’কে প্রাধান্য দেবেন?

নিজের দেখা, আমার মায়ের দাদি, এবং আমার মায়ের মা অর্থাৎ আমার নানি ওনারা এই পত্রিকা পড়তেন। মায়ের দাদা ছিলেন তেজগাঁও থানার ওসি। তিনি যখন গ্রামে ফিরে গেলেন। তখন এই যে শহরকেন্দ্রিক তার যে পদচারণা ছিল, সেইটার ধারাবাহিকতা রক্ষা হলো বেগম পত্রিকার মাধ্যমে। কারণ তারা গ্রামে পর্যাপ্ত বই পায়নি, লাইব্রেরিতো ছিলোই না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তৎকালীন যে সমাজ কাঠামো, সেটা নারী শিক্ষাবান্ধব ছিল না। নারীদের পড়াশোনা করা সমাজ খুব একটা ভালো চোখে দেখতো না। আজকের নারী সমাজের যে অগ্রগতি দেখি তার ভিত্তিমূলে গেলে বেগমের একটা বিশাল ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাবে। বেগমের নারী পাঠক যারা ছিলেন, তারা সচেতন মা হয়ে উঠেছিলেন। উনাদের সন্তানদের পরবর্তীতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যায় পড়তে হয়নি। তারা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে গেছে। আমার মা এবং নানিকে দেখেছি বাড়ির শিশুরা ও পুরুষেরা ঘুমিয়ে গেলে অল্প আলোতে বেগম পত্রিকা পড়তেন। দিনের বেলায় হয়তো কাজের জন্য পড়তেন না। রাতে নিজে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পত্রিকাটা পড়তেন তারা। এখনকার মতো ঝলমলে ছিল না বেগম। নিউজপ্রিন্টের কাগজে ছাপা হতো। দেখতে এখনকার ম্যাগাজিনের মতো ছিল না। বর্তমান একটি দৈনিক পত্রিকা ভাঁজ করলে যেমন দেখায়, অনেকটা ওই আকারে প্রকাশ হতো বেগম। সমাজপতিরা বলতেন, বেগম ‘মিস লিড’ করছে নারীদেরকে। নারীদের মাথা নষ্ট করে ফেলছে। আমার জানা মতে, বেগম পত্রিকা যারা পড়তেন তারা সামাজিকভাবে এগিয়ে থাকা মানুষ।

পশ্চাৎপদ একটি গোষ্ঠী যাদেরকে সমাজ সহযোগিতা করছে না, বরং সমাজ তাদেরকে আরও পেছনের দিকে ঠেলছে; যাতে তারা সামনে আসতে না পারে—সেই জায়গায় একটা আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে বেগম পত্রিকা। কারণ সব রকম তথ্য, তত্ত্ব এক জায়গায় করে একটি মলাটের মধ্যে- এই ধরনের মন মানসিকতা যাদের ছিল তাদের কাছে উপস্থাপিত হতো। এবং সেই খানে তৎকালীন ফ্যাশন, সিনেমা, নাটক, সাহিত্য তুলে ধরা হতো। এই লেখাগুলো তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতো। 

‘বেগম’ পড়া আর না পড়া মানুষের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য ছিল। চলাফেরা, বাচনভঙ্গিতে অনেক এগিয়ে থাকতেন বেগমের পাঠক। সেক্ষেত্রে বলা যায়, ৫০ থেকে ৮০- এর দশক বা তার পরেও নারীর সার্বিক মননশীলতা উন্নয়নে বেগমের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অপরিসীম। অন্দরে থাকা নারীদের বিশ্বমুখী মনন গঠনে বেগম একটা দারুণ ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের মধ্যে আরেকটা সমাজ গড়ে তুলেছে বেগম।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সমাজের মধ্যে আরেকটা সমাজ গড়ে তুলেছিল ‘বেগম’