সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে এগোচ্ছে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। তৈরি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান। কিশোরগঞ্জের ভৈরব, মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গল ঘুরে পাদুকা, আগর ও মণিপুরি তাঁতশিল্প নিয়ে সমকালের স্টাফ রিপোর্টার জসিম উদ্দিন বাদল তৈরি করেছেন তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে ভৈরবের পাদুকাশিল্পের অগ্রযাত্রা, সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত।

চাকরির বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এরশাদ আলী আকাশের মনে হলো, এই ধরাবাঁধা কাজ তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। তিনি দাপিয়ে বেড়াতে চান মুক্ত বিহঙ্গের মতো। নতুন কিছু করতে চান নিজের মতো করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর উদ্যোক্তা হওয়ার যে স্বপ্ন এসেছিল মাথায়, সেটি নিয়ে ভাবতে থাকেন; কিন্তু ব্যবসা শুরু করা সহজ নয়। মূলধন সংগ্রহ করাও চ্যালেঞ্জিং। অনিশ্চিত গন্তব্যে বিনিয়োগের ঝুঁকি নেওয়ার সাহসও দরকার। ইচ্ছাশক্তি আর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে স্বপ্ন পূরণ হয়। অবশেষে ২০১৮ সালে স্থাপন করেন কারখানা। 

আকাশ তাঁর কারখানায় উৎপাদিত পাদুকা বা জুতা এখন সরবরাহ করেন শীর্ষ ব্র্যান্ড অ্যাপেক্স, বাটা, বে, ওয়াকার ও ওরিয়নকে। ৫৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে হয়ে উঠেছেন সফল উদ্যোক্তা। মাত্র ছয় বছরে তাঁর পাঁচ লাখ টাকার পুঁজি রূপ নেয় ৬ কোটিতে। বর্তমানে বছরে টার্নওভার ১০ কোটি টাকা। নাম লিখিয়েছেন রপ্তানিকারকের খাতায়। নিজের জীবনের মোড় ঘোরানোর এই গল্প সম্প্রতি সমকালের কাছে তুলে ধরেন কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের লেইস ফুটওয়্যার বিডির কর্ণধার এরশাদ আলী আকাশ। 
ভৈরবের উত্তরপাড়া বাহার মার্কেট এলাকায় তাঁর কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, আকারে ছোট হলেও এটি একটি কমপ্লায়েন্ট কারখানা। ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে শ্রমিকদের বিরামহীন কর্মযজ্ঞ। কেউ চামড়া কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন কিংবা পেস্ট লাগাচ্ছেন। কেউ এসব সংযোজন করে ফুটিয়ে তুলছেন পরিপূর্ণ বাহারি জুতা। 

চাকরি ছেড়ে যেভাবে সফল উদ্যোক্তা
আকাশ ২০০৫-০৬ সেশনে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে। ২০১১ সালে বিএসসি (অনার্স) পাস করে ওই বছরই শুরু করেন চাকরি জীবন। প্রকৌশলী হিসেবে চার বছর চাকরি করেন ফেলকন ফুটওয়্যার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। ১৬ হাজার টাকায় শুরু করলেও চাকরি ছাড়ার সময় বেতন পেতেন ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু চাকরিতে বর্ণিল জীবন আটকে রাখতে চাননি। অতীত স্মরণ করে এরশাদ আলী আকাশ বলেন, হঠাৎ একদিন মনে হলো– ‘আমি চাকরি করছি, বেতন পাচ্ছি। আবার আমার মতো অনেকেই বেকার। প্রতিযোগিতার বাজারে চাকরি পাচ্ছেন না তারা। পড়াশোনা শেষে সবাই চাকরির পেছনে ছুটলে চাকরি দেবে কে, যদি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠে? এসব চিন্তা থেকেই কারখানা স্থাপনের ইচ্ছা জাগে।’
এ ভাবনা বাস্তবে রূপ নেয় ২০১৮ সালে। আকাশ বলেন, ‘চাকরি থেকে জমানো অর্থ ও কর্জ করে পাঁচ লাখ টাকার তহবিল গড়ি। ছোট একটি কারখানা বানাই। চামড়া, যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে সেখানে নিজেই কাজ শুরু করি। পরে একে একে যুক্ত করি পাঁচজন শ্রমিক। আমার উৎপাদিত পণ্যগুলো মানসম্মত, শতভাগ রপ্তানিযোগ্য ও ব্র্যান্ডের জুতার মতো টেকসই। যোগাযোগ করি প্রাণ গ্রুপের ব্র্যান্ড ওয়াকারের সঙ্গে। তারা পণ্যের মান দেখে ক্রয়াদেশ দেয়। তাদের ডিজাইন ও চাহিদা মতো উৎপাদন শুরু করি। ধীরে ধীরে অ্যাপেক্স, বাটা, ওরিয়ন ও বে’র মতো ব্র্যান্ডের কাজ পাই। ছয় বছর ধরে এভাবেই চলছে উৎপাদন।’ তিনি বলেন, এ পথযাত্রায় ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই)। শ্রমিকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছে তারা। এসব সহায়তায় কারখানা বড় হয়েছে। এখন মনে হয় আরও বড় কিছু করা যাবে। বিশ্বখ্যাত কোনো ব্র্যান্ড গড়ে তোলাও সম্ভব। 

তরুণ এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘কারখানা চালু করার চার বছরের মাথায় রপ্তানির উদ্যোগ নিই। ২০২১ সাল থেকে জাপানে কিছু পণ্য রপ্তানি করছি। বছরে এখন রপ্তানি হচ্ছে সাত-আট হাজার ডলারের পণ্য। এ খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। এলসি খুলতে সমস্যায় পড়তে হয়। স্বল্প সুদে ঋণ পেলে কারখানা বড় করা যাবে।’ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের চিন্তার জগৎ বদলাচ্ছে। চাকরির পেছনে ছোটার দিনও পাল্টাচ্ছে। শিক্ষাজীবন শেষে চাকরির পেছনে না ঘুরে আকাশের মতো সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার এমন দৃষ্টান্ত অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে তরুণদের। এভাবে একজন উদ্যোক্তা শুধু নিজেরই ভাগ্য ফেরান না, ভাগ্য বদলান শত শত মানুষেরও। 
এমন আরও অনেক উদ্যোক্তার দেখা মিলেছে ভৈরবে; যাদের ৮০ শতাংশই এক সময় ছিলেন শ্রমিক। তারা জুতা তৈরির কাজ করতেন ঢাকার শ্যামপুর, পোস্তগোলা ও হাজারীবাগে। এই যেমন, ২৬ বছর আগে ঢাকা থেকে ভৈরবে গিয়ে ৩০ হাজার টাকায় জুতার ব্যবসা শুরু করেন মুর্শিদ মিয়া। শ্রমিক থেকে মালিক হওয়া এ উদ্যোক্তা জানান, এখন তিনি বছরে ৫০ লাখ টাকার জুতা বিক্রি করেন। তাঁর ব্র্যান্ডের

নাম ঝিুনক ফুটওয়্যার। 
গুগল ম্যাপের তথ্যমতে, ঢাকা থেকে ভৈরবের দূরত্ব প্রায় ৮৬ কিলোমিটার। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা সদরে গাড়ি থেকে নেমে যেদিকেই চোখ যায়, দেখা যায় জুতার দোকান। আধাপাকা ঘরে ছোট ছোট কারখানা। প্রতিটি কারখানায় রয়েছে কর্মব্যবস্ততা। কোনো দিকে তাকানোর যেন ফুরসত নেই তাদের। মোটাদাগে তিন ধাপে তৈরি হয় একটি জুতা। যেমন, কেউ বানান ওপরের অংশ; যাকে বলা হয় আপার লেভেল। সোল লেভেল মানে হচ্ছে জুতার নিচের অংশ। এ দুই অংশকে পেস্ট লাগিয়ে বা সেলাই করে সংযোজন করাকে বলে ফিটিংস। এসব কাজ কেউ করছেন হাতে, কেউ মেশিনে। সব প্রক্রিয়া শেষে জুতা প্যাকেজিং হয়ে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলার ক্রয়াদেশদাতার কাছে। 

সবচেয়ে বড় জুতার ব্যবসা কেন্দ্র 
নব্বই দশকে গড়ে ওঠা ভৈরবের পাদুকাশিল্প দেশের সবচেয়ে বড় জুতার ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তিন দশক ধরে চলতে থাকা এ শিল্প গতিশীল করেছে সেখানকার অর্থনীতিকে। বিশাল এলাকাজুড়ে থাকা পাদুকাশিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বহু পশ্চাৎসংযোগ শিল্প, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বড় বড় শপিংমল।
ভৈরব পাদুকাশিল্প সমিতির তথ্যমতে– ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে সড়ক, নৌ ও রেলপথে যোগাযোগের সুব্যবস্থা ও স্বস্তা শ্রমের কারণে শিল্পটির দ্রুত প্রসার ঘটছে। প্রথম পাদুকা কারখানা স্থাপন করা হয় উপজেলা পরিষদ এলাকায়। কারখানা বাড়তে বাড়তে ছড়িয়েছে আশপাশের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ছোট-বড় মিলে উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় চার হাজার। কারখানা রয়েছে ১০ হাজারের মতো। দৈনিক উৎপাদন হয় দুই-আড়াই লাখ জোড়া জুতা। এ ক্লাস্টারে বছরে টার্নওভার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আগে শুধু স্যান্ডেল তৈরি হলেও এখন লোফার, ক্যাডসসহ উন্নত মানের জুতা তৈরি হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হয় সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে।

ভৈরবে ৮০ শতাংশ পাদুকা তৈরি হয় রেক্সিন ও আর্টিফিশিয়াল চামড়া দিয়ে। বাকি ২০ শতাংশ হয় মূল চামড়া দিয়ে। পণ্য উৎপাদনে চামড়া, পেস্ট, সলিউশন, রেক্সিন, ফোম, রংসহ বিভিন্ন কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়। কাঁচামালের ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। এর সিংহভাগই আসে চীন থেকে। বর্জ্য হিসেবে থাকা কাঁচামাল থেকে উৎপাদন হয় মানিব্যাগ, বেল্ট, চাবির রিংসহ বিভিন্ন পণ্য।  বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৫৮ কোটি ডলারের। এতে ভৈরবের অবদান জানা সম্ভব না হলেও উদ্যোক্তারা বলছেন, তাদের অংশ নেহাত কম নয়।

বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় পরিবেশ দূষণ
ব্যবসায়ীরা জানান, জুতা তৈরিতে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার হয়। ভৈরবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুব্যবস্থা নেই। বর্ষাকালে বর্জ্যগুলো পানিতে ভেসে বেড়ায়। তাতে পরিবেশ দূষিত হয়। নানা রোগব্যাধি দেখা দেয়। ১৯৯৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাদুকাপল্লির মার্কেটে সাতবার অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও সরকার কাউকে আর্থিক সহায়তা দেয়নি।
ভাগ্যের উন্নতি ঘটেনি অনেক শ্রমিকের
উদ্যোক্তারা ছোট থেকে বড় হলেও উন্নতি ঘটেনি শ্রমিকের। রাসেল নামের এক শ্রমিক বলেন, জুতার ওপরের অংশের কাজ করেন তিনি। এক ডজন জুতার কাজ করে পান ২২০ টাকা। কাজ করতে হয় ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টা। মাসে ১৫ থেকে ২০ দিনের বেশি কাজ করা যায় না।  পাদুকা শ্রমিক জাকির হোসেন বলেন, জুতায় ব্যবহার করা রাসায়নিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বেঁচে থাকার জন্য জেনেশুনেও এ কাজ করতে হয়। এখানে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই। অনেকেই অকালে মারা যান।

উদ্যোক্তারা জানান, বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ছোট। মূলধনও কম। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, দক্ষ কর্মীর সংকট ও লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে না। 
ভৈরব পাদুকা মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আল আমিন মিয়া বলেন, উন্নত মানের হাসপাতাল ও কম সুদে ঋণ দরকার। সমিতির সহসভাপতি মুর্শিদ মিয়া বলেন, ভৈরবে একটি কমন ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার (সিএফসি) দরকার; যেখান থেকে শ্রমিকরা প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তারা মেশিন ভাড়া নিতে পারবেন।
এসএমই ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে ভৈরবের পাদুকা ক্লাস্টারের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা, পণ্যের মানোন্নয়ন ও কমপ্লায়েন্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ৪০ জন উদ্যোক্তাকে প্রায় তিন কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন মো.

মুশফিকুর রহমান সমকালকে বলেন, উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, কারিগরি জ্ঞান, ঋণসুবিধা ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। একটি সিএফসি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে এসএমই উদ্যোক্তাদের ৬ শতাংশ সুদে ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ব যবস ব যবস থ ক জ কর চ কর র উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু

সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।

তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।

ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।

এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।

এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’

যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকা

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।

তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।

ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদা

ঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।

১০ নারী প্রার্থী

ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।

মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধ

মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ