পাকা কাঁঠাল, মিষ্টি ভুট্টা, ঝিরির কাঁকড়া—কী নেই পাহাড়ের বাজারে
Published: 10th, February 2025 GMT
ভোর ছয়টা। রাঙামাটির শান্ত হ্রদ তখনো কুয়াশার ঘোরে মগ্ন। মাঘ শেষের সূর্য পাহাড়ের আড়াল থেকে সবেমাত্র নরম আলো ছড়াতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে সরব হয়ে উঠেছে পার্বত্য শহরের সাপ্তাহিক হাট। শুকনো মৌসুমে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি রং ছড়িয়ে দিয়েছে ফলের বৈচিত্র্য। ফলের ঘ্রাণে মারি স্টেডিয়াম থেকে রাঙামাটি কলেজ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে জমে গেছে মানুষের মেলা।
পথের পাশের দোকানি আনন্দ। তাঁর দোকানে দুই জাতের বিন্নি চাল, জুমের সাদা তিলের পাশে সৌরভ ছড়াচ্ছে মস্ত একটা পাকা কাঁঠাল। দেখেই অবাক হলাম। লোভও হলো। এ সময় গাছে গাছে কাঁঠালের শিশু থাকে। কিন্তু সারা শরীরে হলুদের আভা নিয়ে এমন পাকা কাঁঠাল পেলেন কোথায়? আনন্দ বললেন, ‘ইবা বারো মাইস্যা, আগেভাগে ফাইগ্যে। মধুরতুন বেশি মিডা। হাই চ। ভিতুরে গোলাবি লং।’ (এটা বারোমাসি কাঁঠাল। মৌসুমের আগেই পেকেছে। মধুর চেয়েও মিষ্টি। খেয়ে দেখ। ভেতরে গোলাপি রং।)
পাহাড়ের বর্ষবরণের উৎসব বিজুর আগে সাধারণত কাঁঠাল পাকে না। অনেক আগে চলে আসায় এই বারোমাসি কাঁঠালের তাই খুব কদর। আনন্দের দোকানে দেখলাম পাহাড়ি আতা। সবুজ রঙের ফলগুলো পেকে মেহেদি রাঙা হয়ে গেছে। দামও সমতলের চেয়ে অনেক সস্তা। কেজিতে ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
শুধু আতা আর কাঁঠাল নয়। পাহাড়ের অধিবাসীরা দূরদূরান্তের খেত, বাগান, জুম আর প্রাঙ্গণ থেকে তুলে এনে বিচিত্র পণ্যের পসরা সাজিয়েছে হাটে। শীতের দিন নানা জাতের ও রঙের শাকসবজি থাকে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফলের বৈচিত্র্য অবাক করার মতো। নানা জাতের কলা, দুই-তিন জাতের বেল, আতা, মিষ্টি ভুট্টা, পেঁপে, কাঁঠালের মুচি, কলার থোড়, তেঁতুল, আমলকী, কাগজি লেবু, মিষ্টি আলু, শিমুল আলু, চালতা আরও কত কী।
এ সময়ের সবচেয়ে পরিচিত ফল বরই। পাহাড়ের বরইয়ের স্বাদ একদম আলাদা। উজোনী চাঙমা তার বাড়ির গাছ থেকে ডালাভর্তি বরই এনেছেন। কেজি ৯০ টাকা করে বিক্রি করছেন। রসে টসটসে এমন বরই সমতলে পাওয়া কঠিন। মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে মুঠোভর্তি বরই আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘আগে খেয়ে দেখ। যা ইচ্ছা খাবি। খেতে তোদের মানা করব না। গাছ থেকে পেড়ে এনেছি।’
উজোনী চাঙমার মতো বরই বিক্রি করছেন অনেকেই। সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেল আনারস। কত রকমের আনারস, তার ইয়ত্তা নেই। ছোট-বড় আকারের, স্বাদে অতুলনীয়। পাহাড়ের এক বন্ধু জানালেন, ‘আনারস নেওয়ার সময় পুরো পাতার গুচ্ছ একদম কেটে ফেলবে না। কিছু অংশ রেখে দেবে। তাতে স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকবে।’
রাঙামাটির এই ভোরের হাটটি প্রতি শনিবার ও বুধবার বসে। এখানকার বেশির ভাগ বিক্রেতা নারী। ফসল বিকিকিনির হাটে নারীদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ মনে আশা জাগায়। পার্বত্যবিশেষজ্ঞ কথাসাহিত্যিক আজাদ বুলবুল বললেন, পাহাড়ি অর্থনীতির প্রধান শক্তি নারী। তাঁরা চাষ করেন, ফসল বাজারে আনেন, তাঁরাই আবার সন্তান লালন করেন।
গত শনিবার রাঙামাটির ভোরের হাটে চেনা সাধারণ শাকসবজির পাশাপাশি দেখলাম ডোবার কুচ্চি, ঝিরির কাঁকড়া, নাপ্পি, ছড়ার ব্যাঙ, সাপের মতো লম্বা কুইচ্চা, পাহাড়ি ছোট ছোট লাউ, সাবারাং, কলার থোড়, বাঁশকোড়লসহ বৈচিত্র্যময় সব সবজি। এখানের অধিবাসীদের জন্য এগুলো নতুন কিছু নয়।
চিগনপুদি চাকমা পাহাড়ের কলা, মিষ্টি আলুর পাশাপাশি বিক্রি করছেন ছোট ছোট চিংড়ি শুঁটকি। এই শুঁটকিগুলো তিনি নিজেই ঘরে তৈরি করেছেন। ননাবী তঞ্চঙ্গ্যা বিক্রি করছিলেন মিষ্টি ভুট্টা। তিনি জানালেন, বিজুর পর ফলের মৌসুম আসবে। আম, জাম, কাঁঠাল, বাঙ্গি, তরমুজ, লিচু, জামরুল, আরও কত কী! তখন এই হাটের চেহারা পাল্টে যায়। অনেক ফল বিক্রি হয় না। পচে নষ্ট হয়। তখন পাহাড়িদের খুব কষ্ট। পাহাড় ডিঙিয়ে, হ্রদ পেরিয়ে হাটে আসতে তাদের যে শ্রম আর টাকা খরচ হয় তা উঠে আসে না। ন্যায্য দামও পান না অনেকে। গ্রীষ্মের মৌসুম ছাড়াও সারা বছর ধরে নানা ফুলে-ফলে আমোদিত থাকে পাহাড়। তবে দিন দিন কমছে ফলন। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব পড়েছে পাহাড়েও।
পাহাড়ের প্রকৃতি ও এখানকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর গবেষণা করছেন গবেষক শাওন ফরিদ। তিনি বললেন, ‘এখানকার উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের বাহার কমছে। বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা। মানুষের জীবনধারা যুগে যুগেই পাল্টায়। কিন্তু তার প্রকৃতি থেকে যেন সবুজ হারিয়ে না যায়। সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। নইলে ফল বলি আর ফসল বলি, সবকিছুই আমাদের নাগালেই বাইরে চলে যাবে একদিন।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
তিন সাংবাদিকের চাকুরিচ্যুতির ঘটনায় ডিআরইউ’র উদ্বেগ
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সদস্য সাংবাদিক রফিকুল বাসার, মুহাম্মদ ফজলে রাব্বি ও মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন সংবাদকর্মীর চাকরিচ্যুতির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে ডিআরইউ।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষে সভাপতি আবু সালেহ আকন ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল সংবাদকর্মীদের চাকুরিচ্যুতির ঘটনায় এ উদ্বেগ জানান।
উল্লেখ্য, চ্যানেল আই’র সাংবাদিক রফিকুল বাসার, এটিএন বাংলার মুহাম্মদ ফজলে রাব্বি ও দীপ্ত টিভির সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে মঙ্গলবার কোনো রকম পূর্ব নোটিশ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করে কর্তৃপক্ষ।
ডিআরইউ নেতৃবৃন্দ তিন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুতির কারণ ব্যাখ্যা করার দাবি জানিয়েছেন।
এএএম//