সংস্কার চাপিয়ে দেবে না সরকার: প্রধান উপদেষ্টা
Published: 16th, February 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কারের প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশ আনা হয়েছে। এই সরকার শুধু বোঝাবে, এসব সংস্কার কেন প্রয়োজন ও কীভাবে তা করা যায়। বাকি কাজটা করবে রাজনৈতিক দলগুলো।
গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ কথাগুলো বলেন।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয়, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তাঁদের অবস্থান থেকে ভালো কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এখান থেকে কতটুকু গ্রহণ করব, কীভাবে অগ্রসর হব, এর জন্য আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করা। কোনটা কাজে লাগাতে পারব, কোনটা গ্রহণ করব। আপনারা জনগণের প্রতিনিধি, তাই আপনাদের সঙ্গে এ নিয়ে বাস্তবভিত্তিক আলোচনা হতে হবে। এমন মজবুতভাবে আইনকানুন করব, যাতে সবাই মেনে চলে ও এর মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাজ তৈরি করা যায়।’
সংস্কার প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়া হবে না মন্তব্য করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি। (এসব সুপারিশ) চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু বোঝাব, কেন সংস্কার প্রয়োজন এবং কীভাবে সংস্কার করা যায়। বাকিটা আপনাদের কাজ।
একটু রদবদল করলে দেখবেন সুন্দর হয়ে যাবে। আমরা কেবল সাচিবিক কাজ করে দেব।’
দীর্ঘ মেয়াদে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের আইনি কাঠামো তৈরির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সংস্কার যদি আমরা সঠিকভাবে করতে পারি, তাহলে বাঙালি জাতি হিসেবে যত দিন টিকে থাকবে, তত দিন আপনাদের অবদান থেকে যাবে।’
‘সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই’সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মহল আমাদের বলে, তোমাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে পারি, কিন্তু সংস্কারটা তোমাদের করতে হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থন, সহযোগিতা এবং তাদের শুভেচ্ছা আমাদের জন্য মস্ত বড় সম্পদ। আমরা তাদের বহু রকমের স্বপ্নের কথা বলেছি। তারাও বলেছে, তোমরা করতে পারলে আমাদের সমস্যা নেই। কোনো কোনো শক্তিশালী দেশ বিশেষভাবে সহায়তা করতে চায়। তাই বলছি, সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যর্থ হতে চাই না।’
রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল, সেই কাঠামো থেকে যেন আমরা অন্য রূপে বেরিয়ে আসতে পারি। হাডুডু খেলার ক্ষেত্রে আইন মেনে চললেও দেশটাকে একটা তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল। আইন বলে কিছু ছিল না, নিয়ম বলে কিছু ছিল না। জুলাই বিপ্লবে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁরা নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমরা যেন সেই আইনকানুন ফেলে দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হই।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আমরা যদি আমাদের ঐক্যকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে তা বংশপরম্পরায় চলতে থাকবে।’ মসৃণভাবে সংলাপ চালিয়ে নেওয়ার জন্য এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এক লন্ডভন্ড অবস্থার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই ছয় মাসের অভিজ্ঞতা হলো, দল–মতনির্বিশেষে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সবাই অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করেছে। আমাদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক আছে, তবে আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে এবং এটি বজায় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।’
অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরুরাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সংলাপের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। আপনারা দ্বিতীয় পর্বের স্রষ্টা। আপনারা সংস্কার সুপারিশগুলো জাতির সামনে নিয়ে আসবেন। আপনাদের সহযোগিতা করার জন্য কমিশনের সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করুন, যেন আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজে নেমে পড়তে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে, কেউ যেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।’
সরকারের প্রথম পর্বে (ছয় মাস) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রথম পর্বের একটা অভিজ্ঞতা হলো, সরকার দেশের জনগণের ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন দুটোই পেয়েছে। পৃথিবীজুড়ে আমাদের প্রতি বড় রকমের সমর্থন গড়ে উঠেছে। যে কারণে অপর পক্ষ (ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকার) সুবিধা করতে পারছে না, বহু গল্প করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো গল্প টেকাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গিয়ে গল্প চালাতে পারল না।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে অপপ্রচার থেমেছেজুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের দেশের মানুষের ওপর চালানো নির্মম নির্যাতন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল, এই প্রতিবেদন তা বন্ধ করে দিয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এখন কারও বানানো বয়ান কেউ শুনবে না, ওইটা চূড়ান্ত। আর কত সমর্থন চাই আমরা, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে তারা বলে দিয়েছে কাকে কোথায় মারা হয়েছে। এর থেকে বের হওয়ার তো কারও উপায় নেই।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ছয় মাস সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছি। আমাদের শক্ত থাকতে হবে, মজবুত থাকতে হবে। একত্রে থাকতে হবে।’
চূড়ান্ত লক্ষ্য জুলাই সনদ তৈরি করাসমাপনী বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটা সনদ তৈরি করা। সেটাই হবে জুলাই সনদ। সনদ তৈরির পর বাস্তবায়নের পথ বের হয়ে যাবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সংস্কারটা গভীরভাবে হতে হবে। আপনারা বলবেন আমাদের প্রস্তাবে আপনারা একমত; অথবা কোন প্রস্তাবের সংশোধনী চান বা কোন কোন প্রস্তাবে একমত হলেন না। যাতে করে একটা জুলাই সনদ তৈরি করা যায়। সবাই মিলে একমত হয়ে গেলে বাস্তবায়নের পথ বের হয়ে যাবে।’
জুলাই সনদ তৈরি করা ছাড়া মুক্তি নেই উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংলাপের মাধ্যমে বের হয়ে আসবে প্রস্তাবের পেছনে এতগুলো দল একমত। পরে সনদ যখন হয়ে যাবে, তখন সেটা প্রকাশ করা হবে। যাতে মানুষ জানতে পারে কোন রাজনৈতিক দল কতগুলো প্রস্তাবে একমত হয়েছে।
জুলাই সনদের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনজাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তা জুলাই সনদের ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, ‘জুলাই সনদের ওপর নির্ভর করবে আমাদের নির্বাচনটা কবে হবে।’
গতকাল বেলা তিনটায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির সামনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান প্রেস সচিব। শফিকুল আলম বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সে ক্ষেত্রে আমরা হয়তো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারব। আর পরে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তারা বাকিগুলো বাস্তবায়ন করবে।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ ব ত য় পর ব জ ল ই সনদ আম দ র প সনদ ত র আপন দ র সরক র র র জন য হওয় র র ওপর আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।
এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।
যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই।
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।
এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়