আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও তিস্তার পানি ইচ্ছেমতো আটকে রাখে বা প্রত্যাহার করে ভারত। তারা নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে; কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকেরা পানির অভাবে ফসল ফলাতে পারেন না। আবার বর্ষার মৌসুমে পানি ছেড়ে দিলে ভাঙে বসতবাড়ি, নষ্ট হয় ফসল। নদী ও নদীপারের বাসিন্দাদের রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে।‌ ভারতকে বলতে হবে, ‘আমার পানির ন্যায্য হিস্যা আমি চাই।’

গতকাল সোমবার বিকেলে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির ডাকা অবস্থান কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথাগুলো বলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে গতকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার এ অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। তিস্তা নদীবেষ্টিত পাঁচটি জেলার ১১টি স্থানে একসঙ্গে এ কর্মসূচি চলছে।

‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে এ অবস্থান কর্মসূচি চলছে লালমনিরহাট সদর, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জের দুটি স্থানে ও আদিতমারী; রংপুরের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া; কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও উলিপুর; নীলফামারীর ডিমলা এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়। বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি নদীপারের হাজারো বাসিন্দা কর্মসূচিতে অংশ নেন। কর্মসূচিতে যোগ দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও।

অবস্থান কর্মসূচি থেকে তিস্তাপারের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে

ভারতকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বিএনপি নেতারা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ‘বন্ধু’ বললেও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি। দাবি না মানা পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে বলে জানান দলটির নেতারা।

‘তিস্তা বাঁচাও স্লোগান নয়, মানুষের আহাজারি’

গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় রংপুর-লালমনিরহাটের সীমানায় অবস্থিত তিস্তা রেলসেতু ও তিস্তা সড়কসেতুর মাঝখানের চরে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন মির্জা ফখরুল। তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহারের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘অনেকে আওয়ামী লীগকে ভারতের বন্ধু ভাবতেন; কিন্তু গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা দেশকে বেঁচে দিলেও তিস্তার এক ফোঁটা পানিও আনতে পারেনি।’

নদীভাঙনের শিকার হাজারো মানুষের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, কী করুণ অবস্থা তাঁদের। একদিকে ভারত পানি ছেড়ে দেয়, পানির তোড়ে ঘরবাড়ি, সম্পদ ভেসে যায় ও নষ্ট হয়। আবার বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিলে এই এলাকা শুকিয়ে যায়। তিস্তাপারের মানুষের দুঃখ আর যায় না।

শুধু তিস্তা নয়, ভারত আন্তর্জাতিক ৫৪টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘ভারত বাঁধ দিয়ে পানি নেয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আমাদের দেশের মানুষ পানির অভাবে ফসল ফলাতে পারেন না। জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে পারেন না। এ সময়ে তিস্তা বাঁচানোর ডাক আমাদের অন্তরের সবার দাবি। লড়াই করেই আমরা তিস্তার পানি আনব।’

ভারতকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করতে চান, তাহলে আগে তিস্তার পানি দেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ‘ফারাক্কা লংমার্চ’-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই কিন্তু কোনো স্লোগান নয়, এটা তিস্তাপারের মানুষের বাঁচার আহাজারি। এই সরকারকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, আপনারা কথায় তো বলেন নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ কিন্তু এই জায়গায় থাকলে চলবে না। এই জায়গায় আপনাকে মুখ খুলতে হবে। ভারতকে বলতে হবে, আমার পানির ন্যায্য হিস্যা আমি চাই।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, আগেও বলেছি, এখনো বলছি, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করতে চান, তাহলে আগে তিস্তার পানি দেন। সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করেন। আর আমাদের সঙ্গে বড় দাদার মতো যে আচরণ, সেটা বন্ধ করেন।’

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব (দুলু) বলেন, তিস্তা পাড়ের পাঁচ জেলার লাখো হতভাগ্য মানুষ এই অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এ অঞ্চলকে বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। নদীভাঙনের শিকার হয়ে অনেকে গৃহহীন ও দেশান্তরি হয়েছেন। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে এখন সবাই ঐক্যবদ্ধ। অবিলম্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

অন্তত তিস্তার ভাঙন ঠেকান

লালমনিরহাটে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া দিনমজুর আজহার আলী ও সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়কের তিস্তা সড়ক সেতুর নিচে। সত্তরোর্ধ্ব এই দুই ব্যক্তি তিস্তার ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়েছেন জানিয়ে বলেন, নদীর ভাঙনে দুবার বসতভিটা হারিয়েছেন। জমিজিরাত হারিয়ে এখন‌ দিনমজুর। অন্তত তিস্তার ভাঙন বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হোক, এটাই তাঁদের দাবি।

আজহার ও সিরাজুলের মতো তিস্তাপারের হাজারো মানুষ দুই দিনব্যাপী এ অবস্থান‌ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। গতকাল বেলা ৩টা ২০ মিনিটে জাতীয় সংগীত ও থিম সংয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়।

হেঁটে, ভ্যানে, রিকশায়, বাসে ও নৌকায় করে লোকজন কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসেন। বিভিন্ন এলাকার জন্য আলাদা আলাদা প্যান্ডেল করা হয়েছে। প্রতিটি প্যান্ডেলের পাশে রান্না চলছে। রাত আটটার দিকে দেখা যায়, নদীর চরে প্যান্ডেল ও তাঁবু করে অবস্থান করছেন হাজারো মানুষ।

একটি প্যান্ডেলে কথা হলো মানিক মিয়া নামের এক কৃষকের সঙ্গে। ২০ বিঘা জমি গত ২০ বছরে তিস্তার ভাঙনে সব নদীগর্ভে চলে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন অন্যের জমিতে ঘর করে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর মতো তিস্তাপারের হাজারো মানুষ নদীভাঙনের শিকার; কিন্তু সরকার নদীভাঙন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই দায়ী

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তা সেতু পয়েন্টে ‘জনতার সমাবেশে’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বলেন, ‘আমরা যতই স্লোগান দিই, লাখো মানুষ তিস্তার পাড়ে শুয়ে থাকে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া তিস্তার মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আগামী দিনে যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তাদেরই বিভিন্ন দেশ সাহায্য দেবে, তিস্তা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।’

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বুড়িরহাটে তিস্তা তীরে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, গত সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে তিস্তাপারের মানুষ পানির ন্যায্য হিস্যা পাননি।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহীপুরে তিস্তা সেতুর নিচে অবস্থান কর্মসূচিতে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাঁধ দিয়েছে। তারা একবার পানিতে শুকিয়ে মারে, একবার ডুবিয়ে মারে।

এ ছাড়া কুড়িগ্রামের উলিপুর পাকার মাথায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু

মাহমুদ চৌধুরী, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা নদীতীরে অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ, রংপুরের কাউনিয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বক্তব্য দেন।

তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় তিস্তা সেতু থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত গণপদযাত্রা, তিস্তার পানিতে নেমে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন ও সংগীত পরিবেশন করা হবে। বিকেল পাঁচটায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এসব অবস্থান কর্মসূচিতে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেবেন।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল ইসল ম ব এনপ র উপজ ল ফখর ল গতক ল সরক র ভ রতক

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ