তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমাদের অসীম সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখিয়েছে বারবার। স্বপ্নচারিতায় বিভোর হয়ে আমরা কখনও অতিপ্রত্যয়ে ভুগেছি, কখনও অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুর্নীতির কারণেও পিছিয়ে পড়েছি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্বপ্নটিও ছিল বহুলাংশে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরপূর্ণ।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সারাদেশে যেভাবে টানা পাঁচ দিন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং চাপের মুখে চালু করা হলেও গতি এতই কমিয়ে রাখা হয়েছিল যে, বেশির ভাগ রপ্তানিমূলক কাজ চরমভাবে ব্যাহত হয়েছিল। এতে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে আস্থার যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা এখনও বিদ্যমান। অনেক বিদেশি সেবাগ্রহীতা তাদের আউটসোর্সড কাজগুলো ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলোর বেশির ভাগ এখনও আমাদের কাছে ফিরে আসেনি।

বিদেশি ক্লায়েন্টদের চুক্তি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় অর্ডার বাতিল, নেতিবাচক রিভিউ এবং র‍্যাঙ্কিং হারানোর মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় ভুগতে হয়েছে দেশের ফ্রিল্যান্সার, আইটি ও বিপিও কোম্পানিগুলোকে। বিভিন্ন বিপিও এবং আউটসোর্সিং কোম্পানির দুই শতাধিক কর্মী নেপাল, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড ও ভারতে চলে গিয়ে সেখান থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কয়েকটি বিদেশি বিপিও কোম্পানি তাদের হেড অফিস বা রিজিওনাল অফিস বাংলাদেশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশে যখন একাধিক আন্তর্জাতিক ডেটা সেন্টার স্থাপনের কাজ হচ্ছিল, সেই মুহূর্তে ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া সেই প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করেছিল।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ পুরো এফ-কমার্স খাতে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায়। সফটওয়্যার রপ্তানি খাতে ৫০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের আস্থা হারানোর ফলে জব মার্কেটেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বিদায়ী বছরে সাইবার নিরাপত্তাও বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ব্যাংক, সংবাদমাধ্যমসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সাইবার হামলার শিকার হয়েছে, যা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোর দুর্বলতা উন্মোচিত করেছে। এ ছাড়াও সাইবার আক্রমণ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও আস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। 

এসব সমস্যা সমাধানে চলতি বছর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। বরাদ্দকৃত অর্থের স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে প্রকৃত আইটি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।

ইন্টারনেটকে ‘জরুরি সেবা’ হিসেবে অবিলম্বে ঘোষণা দিতে হবে। একই সঙ্গে ইন্টারনেট পরিষেবার ওপর থেকে ভ্যাটসহ সব শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে। এতে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়বে, অনলাইনে লেনদেন বাড়বে, নতুন ব্যবসা ও ব্যবসার সম্প্রসারণ হবে। ফলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত একটি প্রযুক্তিবান্ধব সমাজ তৈরিতে অবদান রাখবে। 

সাইবার নিরাপত্তার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো তৈরি করে সাইবার নিরাপত্তায় দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে হবে। ফায়ারওয়াল ও অন্যান্য নেটওয়ার্ক সিকিউরিটির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ওপর থেকে শুল্ক ন্যূনতম পর্যায়ে নামাতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক প্রজেক্টে নিয়মিত অডিট চালানো জরুরি। শিক্ষার্থীরা কতটা প্রশিক্ষিত হলো, তা তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন প্রয়োজন। দক্ষতার ঘাটতি পূরণে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উন্নত করতে হবে। 

সব বিদেশি পক্ষের সঙ্গে করা সরকারি চুক্তিতে পরিমার্জন এনে দেশীয় ভ্যালু অ্যাডিশন নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে সব ধরনের হার্ডওয়্যার ক্রয়ে স্থানীয় সংযোজন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ ছাড়াও যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশীয় সফটওয়্যার বা দেশে সংযোজিত হার্ডওয়্যার ক্রয় ও ব্যবহার করবে, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

আইটি উদ্যোক্তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো ব্যাংক ঋণ পাওয়া। স্থাবর সম্পত্তি জামানত দিতে সক্ষম না হওয়ায় বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই ঋণ পেতে অপারগ হন। তাই মেধাস্বত্ব মূল্যায়নের ব্যবস্থা করে সেটাকে অ্যাসেট হিসেবে দেখানোর বিধান করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে যদি সরকার অন্তত ৫০ শতাংশ গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা গেলে ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠে তথ্যপ্রযুক্তি খাত নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। মধ্যস্বত্বভোগী বাদ দিয়ে ট্রান্সমিশন খরচ কমিয়ে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণ করে এবং নারী ও প্রান্তিক জনসাধারণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেও ডিজিটাল বিভাজন দূর করা সম্ভব হবে।

তরুণ জনগোষ্ঠীর এই দেশে আইসিটি সেক্টরে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ খাতকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। বিগত বছরের অভিজ্ঞতা এবং চ্যালেঞ্জগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে চলতি বছর হতে পারে আইসিটি সেক্টরের জন্য একটি নতুন সূচনা।

সৈয়দ আলমাস কবীর: উদ্যোক্তা, পলিসি অ্যাডভোকেট ও আইটি পরামর্শক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইস ট খ ত র জন য চ ত কর ব যবস সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, পাহাড়ে ভূমিধসের শঙ্কা

আজ শ্রাবণের ১৬ তারিখ। প্রকৃতির নিয়মে এ মাসে বৃষ্টি বেশি ঝরে। আজও ঢাকার আকাশ মেঘলা। বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও ঝুম বৃষ্টি কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। তবে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রয়েছে ভূমিধসের ঝুঁকি।

বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের ঝুঁকি রয়েছে।

আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অতিভারী বৃষ্টির কারণে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কিছু এলাকায় সাময়িক জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়াসহ বাস, রিকশা ও সাধারণ চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।

বঙ্গোপসাগরে উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। নদী ও সমুদ্রবন্দর এলাকায় অবস্থানরত নৌযানগুলোকে সাবধানতার সঙ্গে চলাচলের নির্দেশ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সারা দেশে আজ দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে, রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।

শুক্রবার ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, এবং রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।

শনিবারও সারা দেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে অধিকাংশ এলাকায় এবং অন্যান্য বিভাগে অনেক জায়গায় দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। সারা দেশে দিনের ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।

রবিবার রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগে অনেক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও হতে পারে অতি ভারী বৃষ্টিপাত।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বর্ধিত পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী পাঁচ দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। 

গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজার ৬৮ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সৈয়দপুরে ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ঢাকা/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, পাহাড়ে ভূমিধসের শঙ্কা