পুনর্জাত হওয়ার যন্ত্রণায় অস্থির মাতৃভূমি
Published: 20th, February 2025 GMT
কবিতা বিচারের নানা তরিকা আছে। পাঠকের রুচি, পঠন-পাঠন, নন্দনতাত্ত্বিক ধারণা ইত্যাদি অনুযায়ী একেক ধরনের কবিতা একেকজনের প্রিয়তা অর্জন করে। আমি কবিতাকে বিবেচনা করি দেশের সাপেক্ষে। এর সঙ্গে দেখতে চাই শিল্পের মিতালি। কারণ, কবিতা শুধু অনুভাবনার উচ্চারণ না, আর্টও বটে।
দেশের সাপেক্ষে বলতে এটা বোঝাতে চাই না যে, মিছিলে আর জাতীয়তাবাদী আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠতে হবে কবিতার সমস্ত দেহ-মন। কবিতার কাছে দেশের গান হয়ে ওঠার প্রত্যাশাও করি না। আমি দেখতে চাই কবিতাটা বাংলাদেশের নাকি ইরান-তুরান-কলকাতা-বিলাত-নিউইয়র্ক-প্যারিসের। নাকি ‘নো ম্যানস ল্যান্ডের’।
বাংলাদেশের ভালো-মন্দ, মাটি-বাতাস-আবহাওয়া, প্রাণ-প্রকৃতি-উচ্চারণভঙ্গির রসায়নে নির্মিত কবিতাই বাংলাদেশের কবিতা। এই কবিতাকে নিয়ে আমি দেশের পক্ষে অনেক দূর পর্যন্ত মোকাবিলা করতে পারব। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, বাংলাদেশে বাংলাদেশের কবিতা কম রচিত হয়। আলতাফ শাহনেওয়াজ ‘বাংলাদেশের কবি’। তাঁর ‘তবু আমরা জেগে থাকবো’ বাংলাদেশের কবিতার বই।
এ বইয়ে কোনো মিছিল নেই। নেই জাতীয়তাবাদী জজবা। নেই প্রচলিত কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি বিশেষ আনুগত্য। কিন্তু তাই বলে আলতাফ অরাজনৈতিক নন। গুম, খুন, জখম, রক্ত, অবরুদ্ধতা, নির্যাতন, চাপা রাগ-ক্ষোভ-অসহায়তা, জুগুপ্সা, লাশ– এইসবে ঠাসা ‘তবু আমরা জেগে থাকবো’ বইয়ের অধিকাংশ কবিতা। এত রক্ত, এত জুগুপ্সা, এত এত বিবমিষা, অন্ধকার আর লাশের বোঝা দেখে নিরুপদ্রব মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারও মনে হতে পারে, এ হয়তো কবির কল্পনা। কিন্তু এটাই আলতাফের বাংলাদেশ; যেন পুনর্জাত হওয়ার যন্ত্রণায় অস্থির মাতৃভূমি।
এই লাইনে আলতাফ শাহনেওয়াজ নতুন নন। রাত্রির অদ্ভুত নিমগাছ (২০১১), আলাদিনের গ্রামে (২০১৬), কলহবিদ্যুৎ (২০১৯) সামান্য দেখার অন্ধকারে (২০২০), গ্রামের লোকেরা যা বলে (২০২৩) সবই ভিন্ন ভিন্নভাবে বাংলাদেশকেই দেখার কাব্যিক কোশেশ। তবে এ কথা অবশ্যই বলতে হবে যে, কবিতায় তিনি ক্রমাগত রাষ্ট্রের গভীর পর্যবেক্ষক অর্থে রাজনৈতিক হয়ে উঠেছেন। রাষ্ট্র ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা কিছুর সর্বশেষ আলতাফি-পর্যবেক্ষণের কাব্যিক প্রকাশ ‘তবু আমরা জেগে থাকবো’। ‘মৃত্যুর আগে অনর্গল’, ‘তন্দ্রা ভাঙার আশায় মাগো’, ‘না লেখা রক্তের মধ্যে’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘রক্তজবা’, ‘আমি আর তুমি’, ‘খুনি’, ‘বিস্তারিত কমেন্টে’, ‘ডোম’, ‘জুলাই কখনো শেষ হয় না’– কোন কবিতা থেকে উদাহরণ দেব! ‘চাঁদের অমাবস্যা’ কবিতা থেকে কিছু লাইন তুলে দিলাম, ‘বাড়ির উঠোনজুড়ে গল্পের মতন/সকরুণ/এই চাঁদ/আম্মার সব উৎকণ্ঠা ছুঁয়ে/আলো দেয়,/সেই যে মানুষ–/বাজারে গিয়েছে আমার ভাই,/পাশে তার ছায়া,/ওই ছায়াকে তুমি রোজই তুলে নিয়ে যাও/ভয় দেখাও/পেটাও/এবং কয়েদ করার পর ভাবো/কেউ নেই আর আম্মার চোখের ভেতরে;/আমার ছায়াকেও তুমি গাড়িতে ওঠাও/প্রতিদিন/তুলে নিয়ে/চোখ বাঁধো/দাঁড় করাও দুনিয়ার চৌচির চাঁদের নিচে/কিন্তু ছায়াটা কিছুই দেখতে পায় না,/সবার চোখের মধ্যে রক্তজমাট কালো কাপড়,/তুমিই বেঁধেছ;.
আলতাফ বিচিত্রধর্মী কবিতা লেখার পাশাপাশি বরাবরই দেশ ও দশের কবিতা লেখেন। কথা মিছা না। কিন্তু ঢাকায় যারা কবিতার শিল্পিতার প্রশ্নে খুঁতখুঁতে, নাক উঁচু, ‘অভিজাত’ আর অতিরিক্ত অ্যাবস্ট্রাকশনপ্রবণ, অন্তর্গতভাবে মডার্নিস্ট– আলতাফ সেই দলে পড়বেন। তিনি ফাইনটিউনিং করতে করতে কবিতাকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যান যে, আপনার মনে হতেই পারে আলতাফ প্রশিক্ষিত কবিদের জন্য কবিতা লেখেন। এর ফলে অনেক সময় তাঁর কবিতা থেকে ইনোসেন্সের আরামদায়ক আস্বাদনটা উদ্বায়ী হওয়ার জন্য উড়ি উড়ি আওয়াজ তোলে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর কবিতাকে পাঠকের পক্ষে টেনে রাখে এর ভেতরকার গুমোট-প্যাশন, চেনা চারপাশের আবছায়াময় অভিক্ষেপ, প্রবল আত্মবিশ্বাস, জাগরণী মনোভঙ্গি, চাপা ক্রোধ, ঠ্যাস্-মস্করা, মৃত্যুতুল্য নৈঃশব্দ্য আবার স্রোতের মতো গতি, নাটকীয় উত্থান-পতন আর একটা নিঃসহায় কবিচিত্তের করুণ প্রলেপ। এই ব্যাপারগুলোই আলতাফকে তাঁর সমকালের কবিদের ভিড়ের মধ্যে বিশেষভাবে চিনে উঠতে সাহায্য করে।
সব মিলিয়ে আলতাফের অধিকাংশ কবিতা একজন মডার্নিস্টের মনোদর্পণে আত্মস্মৃতি ও দেশের মুখচ্ছবি। এই প্রবণতা ‘তবু আমরা জেগে থাকবো’ কাব্যগ্রন্থেও আছে। কিন্তু আলতাফ এই কাব্যে অতিরিক্ত শিল্পিতা ও অ্যাবস্ট্রাকশনের আলখাল্লা খুলে অনেকদূর পর্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে আসতে চেয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষপাত এই ধরনের কবিতার প্রতি।
তবু আমরা জেগে থাকবো ।। আলতাফ শাহনেওয়াজ ।। কবিতা ।। প্রকাশক : ঐতিহ্য ।। প্রচ্ছদ : সেলিম হোসেন সাজু ।। পৃষ্ঠা : ৬৪ ।। মূল্য : ১৮০ টাকা।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে সাবেক কাউন্সিলরের মৃত্যু
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক এক কাউন্সিলরের মৃত্যু হয়েছে। পরিবার বলছে, পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। তবে পুলিশ বলছে, তারা অন্য কাজে এলাকায় গিয়েছিল, ওই কাউন্সিলরকে ধরতে যায়নি। গতকাল বুধবার দিবাগত রাতে নগরের দাসপুকুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
মারা যাওয়া ওই কাউন্সিলরের নাম কামাল হোসেন (৫৫)। তিনি নগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং দাসপুকুর এলাকার বাসিন্দা। একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তবে দলে তাঁর কোনো পদ–পদবি ছিল না।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কামাল হোসেনের নামে চারটি মামলা হয়। তিনি এলাকায় থাকলেও গা ঢাকা দিয়ে থাকতেন। পরিবারের ধারণা, মামলা থাকায় পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে কিংবা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
কামালের ছেলে সোহান শাকিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে আমাদের এলাকায় পুলিশ এসেছিল। পুলিশ দেখে আমার বাবা তবজুল হক নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে যান। তখন সিঁড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান।’
নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা আছে। তিনি আত্মগোপনে থাকতেন। শুনেছি রাতে তিনি মারা গেছেন।’
ওসি বলেন, রাতে দাসপুকুর এলাকায় পুলিশ গিয়েছিল। তবে কামালকে ধরতে যায়নি। পুলিশ গিয়েছিল অন্য কাজে। কিন্তু পুলিশ দেখে পালাচ্ছিলেন কামাল হোসেন। তখন হৃদ্রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। লাশ পরিবারের কাছেই আছে। তারা দাফনের ব্যবস্থা করছে।