শুক্রবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখযোদ্ধাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। তাদের স্লোগান হলো– ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ…ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।’ এরই মধ্যে এই স্লোগান নিয়ে শুরু হয়েছে নেতিবাচক বিশ্লেষণ। একটি গোষ্ঠী স্লোগানটিকে ‘কট্টর সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানে’র পূর্বাভাস এবং ‘পাকিস্তানিদের উর্দুয়ানি স্লোগানে ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির প্রত্যাবর্তনের বার্তা’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ প্রতিঘাতে অপশক্তির দমন অনিবার্য। জুলুম হলেই জন্ম নেবে ইনকিলাব।
এ স্লোগান উর্দু নয়, বরং ফার্সি ভাষায় রচিত; যার অর্থ– ‘বিপ্লব অমর হোক’। স্লোগানটির জন্ম অখণ্ড ভারতে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে এবং ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামে ভারতবাসীকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল এটি। সেই থেকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদী জনতার ন্যায্য সংগ্রামের পটভূমিতে বারবার ফিরে এসেছে এ স্লোগান।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতের মুক্তিকামী জনতা অভিন্ন মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ হলেও ‘বন্দে মাতরম’ আর ‘আল্লাহু আকবার’-এ বিভাজিত ছিল তাদের মোর্চা। সে সময় গোটা ভারতকে বিপ্লবের অভিন্ন মোর্চায় টেনে এনেছিল মওলানা হাসরাত মোহানির অনবদ্য এই স্লোগান। মোহানি আজন্ম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, অখণ্ড ভারতসত্তার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত ধর্মের বেসাতে বিভক্ত হয় ভারতমাতার বুক। সেই খেদে কোনো দিন পাকিস্তানে যাননি এই আমৃত্যু বিপ্লবী।
১৯২১ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে পূর্ণ/অখণ্ড স্বাধীন ভারত বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে মওলানা মোহানি সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছিলেন। তাঁর সমর্থনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিধ্বনি তোলেন স্বামী কুমারানন্দ। তবে উর্দু ভাষার কিংবদন্তি বিদ্রোহী কবি মোহানির এই স্লোগান যে বিপ্লবী মহানায়কের কণ্ঠ ছুঁয়ে বিপ্লবের অমৃত ধ্বনি হয়েছিল, তিনি হলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দুর্ধর্ষ সেনানী ভগৎ সিং।
ইতিহাসবিদদের তথ্য বলে, ১৯৩১ সালে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতমুক্তি আন্দোলনের এই মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষ এবং তাঁর দুই সঙ্গী সুখদেব ও রাজগুরুর জীবনের শেষ উচ্চারণটি ছিল– ইনকিলাব জিন্দাবাদ। সেই বছরই কিংবদন্তি বাঙালি সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার রচিত আত্মজীবনীতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে এই স্লোগানের বিপ্লবী মন্ত্রে বিমোহিত হতে দেখা গেছে। ১৯৪৬ সালে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তরে উচ্চারিত হয়েছিল– ‘লাঙল যার জমি তার/ আধি নয় তেভাগা চাই/ ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
২০২০ সালের আলোচিত এনআরসি ইস্যুতে সংঘটিত দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সাধারণ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যজোট এই স্লোগানে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে ‘হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই/ আপস মে হ্যায় ভাই ভাই, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে। এরপর ২০২৩ সালে কৃষক আন্দোলনের সময় আবারও এই স্লোগান দিল্লির বুকে কাঁপন তুলেছিল। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরপ্রদেশ থেকে কৃষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে দিল্লি অভিমুখে যাত্রায় মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে ইনকিলাবের ডাক।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বুকে ফিরে এসেছে এই স্লোগান। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর ইতিহাসকে ঢাল বানিয়ে এ দেশের মানুষকে যখন শোষণ-নিপীড়ন করা হচ্ছিল, বাক্-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্ট রূপটি দেখানো হচ্ছিল, তখনই ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী সত্তায় জাগ্রত বাংলাদেশের বুকে আবারও উচ্চারিত হলো ঐতিহাসিক এই স্লোগান। যতবার এই স্লোগান উপমহাদেশের বুকে উচ্চারিত হয়েছে ততবার বিজয়ী হয়েছে বিপ্লব। ভারতীয় কবি আমির আজিজ লিখেছিলেন, ‘তুম জমিন পে জুলম লিখ দো, আসমান পে ইনকিলাব লিখা জায়েগা’ (তুমি যতবার জমিনে জুলুম লিখে দেবে ততবারই আকাশের বুকে লেখা হবে ইনকিলাব)। বাংলাদেশের বুকে এই স্লোগান যারা ধারণ করেছো, তারা ভেবে দেখো ইতিহাসের কোন দায়িত্ব তোমরা কাঁধে তুলে নিয়েছো। এর অমর্যাদা হলে শাপিত সমাপ্তি নিশ্চিত।
এস এম সাব্বির খান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইনক ল ব জ ন দ ব দ এই স ল গ ন
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে সাবেক কাউন্সিলরের মৃত্যু
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক এক কাউন্সিলরের মৃত্যু হয়েছে। পরিবার বলছে, পুলিশ দেখে পালাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। তবে পুলিশ বলছে, তারা অন্য কাজে এলাকায় গিয়েছিল, ওই কাউন্সিলরকে ধরতে যায়নি। গতকাল বুধবার দিবাগত রাতে নগরের দাসপুকুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
মারা যাওয়া ওই কাউন্সিলরের নাম কামাল হোসেন (৫৫)। তিনি নগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং দাসপুকুর এলাকার বাসিন্দা। একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তবে দলে তাঁর কোনো পদ–পদবি ছিল না।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কামাল হোসেনের নামে চারটি মামলা হয়। তিনি এলাকায় থাকলেও গা ঢাকা দিয়ে থাকতেন। পরিবারের ধারণা, মামলা থাকায় পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে কিংবা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
কামালের ছেলে সোহান শাকিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে আমাদের এলাকায় পুলিশ এসেছিল। পুলিশ দেখে আমার বাবা তবজুল হক নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতে যান। তখন সিঁড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান।’
নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা আছে। তিনি আত্মগোপনে থাকতেন। শুনেছি রাতে তিনি মারা গেছেন।’
ওসি বলেন, রাতে দাসপুকুর এলাকায় পুলিশ গিয়েছিল। তবে কামালকে ধরতে যায়নি। পুলিশ গিয়েছিল অন্য কাজে। কিন্তু পুলিশ দেখে পালাচ্ছিলেন কামাল হোসেন। তখন হৃদ্রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। লাশ পরিবারের কাছেই আছে। তারা দাফনের ব্যবস্থা করছে।