Samakal:
2025-11-03@07:15:15 GMT

মজলুমের ইনকিলাব

Published: 1st, March 2025 GMT

মজলুমের ইনকিলাব

শুক্রবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখযোদ্ধাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। তাদের স্লোগান হলো– ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ…ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।’ এরই মধ্যে এই স্লোগান নিয়ে শুরু হয়েছে নেতিবাচক বিশ্লেষণ। একটি গোষ্ঠী স্লোগানটিকে ‘কট্টর সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানে’র পূর্বাভাস এবং ‘পাকিস্তানিদের উর্দুয়ানি স্লোগানে ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির প্রত্যাবর্তনের বার্তা’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ প্রতিঘাতে অপশক্তির দমন অনিবার্য। জুলুম হলেই জন্ম নেবে ইনকিলাব। 

এ স্লোগান উর্দু নয়, বরং ফার্সি ভাষায় রচিত; যার অর্থ– ‘বিপ্লব অমর হোক’। স্লোগানটির জন্ম অখণ্ড ভারতে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে এবং ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামে ভারতবাসীকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল এটি। সেই থেকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদী জনতার ন্যায্য সংগ্রামের পটভূমিতে বারবার ফিরে এসেছে এ স্লোগান।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতের মুক্তিকামী জনতা অভিন্ন মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ হলেও ‘বন্দে মাতরম’ আর ‘আল্লাহু আকবার’-এ বিভাজিত ছিল তাদের মোর্চা। সে সময় গোটা ভারতকে বিপ্লবের অভিন্ন মোর্চায় টেনে এনেছিল মওলানা হাসরাত মোহানির অনবদ্য এই স্লোগান। মোহানি আজন্ম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, অখণ্ড ভারতসত্তার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত ধর্মের বেসাতে বিভক্ত হয় ভারতমাতার বুক। সেই খেদে কোনো দিন পাকিস্তানে যাননি এই আমৃত্যু বিপ্লবী।

১৯২১ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে পূর্ণ/অখণ্ড স্বাধীন ভারত বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে  মওলানা মোহানি সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছিলেন। তাঁর সমর্থনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিধ্বনি তোলেন স্বামী কুমারানন্দ। তবে উর্দু ভাষার কিংবদন্তি বিদ্রোহী কবি মোহানির এই স্লোগান যে বিপ্লবী মহানায়কের কণ্ঠ ছুঁয়ে বিপ্লবের অমৃত ধ্বনি হয়েছিল, তিনি হলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দুর্ধর্ষ সেনানী ভগৎ সিং।

ইতিহাসবিদদের তথ্য বলে, ১৯৩১ সালে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতমুক্তি আন্দোলনের এই মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষ এবং তাঁর দুই সঙ্গী সুখদেব ও রাজগুরুর জীবনের শেষ উচ্চারণটি ছিল– ইনকিলাব জিন্দাবাদ। সেই বছরই কিংবদন্তি বাঙালি সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার রচিত আত্মজীবনীতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে এই স্লোগানের বিপ্লবী মন্ত্রে বিমোহিত হতে দেখা গেছে। ১৯৪৬ সালে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তরে উচ্চারিত হয়েছিল– ‘লাঙল যার জমি তার/ আধি নয় তেভাগা চাই/ ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

২০২০ সালের আলোচিত এনআরসি ইস্যুতে সংঘটিত দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সাধারণ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যজোট এই স্লোগানে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে ‘হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই/ আপস মে হ্যায় ভাই ভাই, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে। এরপর ২০২৩ সালে কৃষক আন্দোলনের সময় আবারও এই স্লোগান দিল্লির বুকে কাঁপন তুলেছিল। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরপ্রদেশ থেকে কৃষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে দিল্লি অভিমুখে যাত্রায় মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে ইনকিলাবের ডাক।

সম্প্রতি বাংলাদেশের বুকে ফিরে এসেছে এই স্লোগান। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর ইতিহাসকে ঢাল বানিয়ে এ দেশের মানুষকে যখন শোষণ-নিপীড়ন করা হচ্ছিল, বাক্‌-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্ট রূপটি দেখানো হচ্ছিল, তখনই ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী সত্তায় জাগ্রত বাংলাদেশের বুকে আবারও উচ্চারিত হলো ঐতিহাসিক এই স্লোগান। যতবার এই স্লোগান উপমহাদেশের বুকে উচ্চারিত হয়েছে ততবার বিজয়ী হয়েছে বিপ্লব। ভারতীয় কবি আমির আজিজ লিখেছিলেন, ‘তুম জমিন পে জুলম লিখ দো, আসমান পে ইনকিলাব লিখা জায়েগা’ (তুমি যতবার জমিনে জুলুম লিখে দেবে ততবারই আকাশের বুকে লেখা হবে ইনকিলাব)। বাংলাদেশের বুকে এই স্লোগান যারা ধারণ করেছো, তারা ভেবে দেখো ইতিহাসের কোন দায়িত্ব তোমরা কাঁধে তুলে নিয়েছো। এর অমর্যাদা হলে শাপিত সমাপ্তি নিশ্চিত। 
 
এস এম সাব্বির খান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইনক ল ব জ ন দ ব দ এই স ল গ ন

এছাড়াও পড়ুন:

জয় যেন হাতছাড়া না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৫৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন শেষ হয়েছে। আজ শুক্রবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের উদ্যোগে তিন দিনের এই আয়োজন। শেষ দিনের আয়োজনে বক্তরা বলেন, অপশক্তির বিরুদ্ধে বারবার জয় পেলেও তা হাতছাড়া হয়ে যায়। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

এবার উদীচীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন হয়েছে দুই অংশে ভাগ হয়ে। আজ বিকেলে আয়োজিত হয় কেন্দ্রীয় সংসদের আলোচনা পর্ব এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহমুদ সেলিম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম।

শুরুতে জাতীয় পতাকা ও সাংগঠনিক পতাকা উত্তোলনের পর সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্মরণ করা হয় সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, কলিম শরাফী, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, কামাল লোহানী, পান্না কায়সার, যতীন সরকার ও বদিউর রহমানকে।

আজকের আয়োজনে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ৫৬ বছর ধরে মুক্তির ব্রত নিয়ে উদীচী কাজ করছে। হতাশা, নিরাশা আর সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তিই উদীচীর চাওয়া। এ সময় সাবেক সংগঠক মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, আদর্শচ্যুতি হলে ঐক্য হয় না। উদীচীতে পারস্পরিক সংকট সব সময়ই ছিল। কিন্তু উদীচী কখনো রাজনৈতিক সংগঠন হয়নি।

উদীচীর সাবেক সহসভাপতি অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারীর বক্তব্যে উঠে আসে ১৯৬৮ সালে একজন শিল্পীর নারিন্দার বাসায় উদীচী শুরু হওয়ার স্মৃতিকথা। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদীচীর কার্যক্রম আরও বেগবান করা প্রয়োজন। সত্যেন সেনের গানের কথা উল্লেখ করে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

আয়োজনে উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানাসহ অন্য বক্তারা বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে উদীচী। যখনই দেশে কোনো সংকট দেখা দেয়, তখনই উদীচী আলোকবর্তিকা হয়ে মানুষকে পথ দেখানোর চেষ্টা করে। মানুষ বারবার আন্দোলন করে আত্মাহুতি দিয়ে অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা পেলেও বারবারই সে জয় হাতছাড়া হয়ে যায়। এই জয় যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

আলোচনা পর্ব সমাপ্ত করেন উদীচীর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশটি সাম্প্রদায়িক করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু গোটা উপমহাদেশের ঐতিহ্য হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। সেই ঐতিহ্য এখন নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে—বিশেষ “মব” তৈরি করে।’ আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক আয়োজন।

‘ঘোর আঁধারে পথ দেখাবে আগুনের নিশান’ স্লোগানে উদীচীর একাংশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর তিন দিনব্যাপী আয়োজন শুরু হয় ২৯ অক্টোবর। ‘সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবিরোধী লড়াইয়ে উদীচী’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠের পর সেদিন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজধানীর ডিআরইউতে। একই দিনে আরেক অংশের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তাদের প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্রগতির পথে জীবনের গান’। দেশে ও বিদেশে উদীচীর সাড়ে তিন শতাধিক জেলা ও শাখা সংসদে এবার একযোগে উদ্‌যাপন করেছে ৫৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জয় যেন হাতছাড়া না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে