বিশ্বে ধনীদের সম্পদ বাড়ছে তো বাড়ছেই। এতে তৈরি হচ্ছে অতিধনীদের গোষ্ঠীতন্ত্র। এ রকম বিলিয়নিয়ার বা শতকোটিপতিদের খবর বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করছে। এই শতকোটিপতিদের মধ্যে আরেকটি শ্রেণি হলো সুপার বিলিয়নিয়ার, যাঁরা পাঁচ হাজার কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক, তাঁরা এই শ্রেণিভুক্ত।

বাস্তবতা হলো, বিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখন এই সুপার বিলিয়নিয়ারদের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর এক সংবাদে বলা হয়েছে। তাঁদের হাতে যেমন সম্পদ বেশি জড়ো হচ্ছে, তেমনি বিশ্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতিপ্রকৃতিও এখন তাঁরাই নির্ধারণ করছেন। উদ্ভাবনী কাজের নেতৃত্বও দিচ্ছেন তাঁরা। এক কথায়, বিশ্ববাজারের রাশ তাঁদের হাতে।

আগে দেখে নেওয়া যাক, এই সুপার বিলিয়নিয়ারদের হাতে কী পরিমাণ অর্থ আছে। এঁদের সংখ্যা মাত্র ২৪। বিশ্বের শতকোটিপতিদের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তার ১৬ শতাংশই তাঁদের হাতে, যা ২০১৪ সালে ছিল ৪ শতাংশ।

এই ২৪ জনের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এটা প্রায় ফ্রান্সের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের সমপরিমাণ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই তালিকায় কারা কারা আছেন এবং বিশ্বে তাঁরা কত ক্ষমতাধর।

শীর্ষে ইলন মাস্ক: বর্তমানে বিশ্বের অতিধনীদের তালিকায় শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত আছেন ইলন মাস্ক, যিনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডান হাত। ট্রাম্প প্রশাসন যেসব পরিবর্তনে হাত দিয়েছে, তার অনেকগুলোরই সূত্রধর ইলন মাস্ক। ফলে তাঁর গুরুত্ব সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না।

বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত এখন বৈদ্যুতিক গাড়ি। সেই বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইলন মাস্কের কোম্পানি টেসলা। একই সঙ্গে তিনি স্টার লিঙ্ক ও এক্সের (সাবেক টুইটার) মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। এক্স হাতে আসার পর অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মকানুন শিথিল করেছেন ইলন মাস্ক। বিশেষ করে পোস্টের সত্যাসত্য নির্ধারণে। তার প্রভাব এখন অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমেও পড়েছে, যেমন ফেসবুকও সম্প্রতি নিয়মকানুন শিথিল করেছে।

এখন প্রযুক্তির দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ওপেন এআই চ্যাটজিপিটি বিশ্ববাজারকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ওপেনআইতে ইলন মাস্ক ছিলেন। কিন্তু চ্যাটজিপিটি বাজারে আসার আগে তিনি কোম্পানিটি ছেড়ে যান। এখন তিনি নিজেই একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোম্পানি চালু করেছেন।

তবে চ্যাটজিপিটিতে বিনিয়োগ আছে প্রযুক্তি খাতের আরেক মহিরুহ কোম্পানি মাইক্রোসফটের। বাস্তবতা হলো, এখন বিশ্বের সব প্রযুক্তি কোম্পানি এআই খাতে বিনিয়োগ করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। কারণ হিসেবে তারা মনে করছে, ভবিষ্যৎ এখন এআইয়ের হাতে। ফলে কেউ আর এআইয়ের প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকতে চায় না।

এখন দেখে নেওয়া যাক, এই সুপার বিলিয়নিয়ারদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রধানত কোন কোন খাতে বিস্তৃত। প্রযুক্তি থেকে শুরু করে বিলাসবহুল পণ্য, মহাকাশ গবেষণা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আর্থিক খাত—এমন অনেক খাতেই তাঁদের ব্যবসা আছে।

জেফ বেজোস: বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ও সুপার বিলিয়নিয়ার গোষ্ঠীর অন্যতম আরেকজন হলেন প্রযুক্তিভিত্তিক বৈশ্বিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস। মূলত অনলাইনে বই বিক্রির মাধ্যমে তিনি অ্যামাজনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন দুনিয়াজুড়ে এমন কোনো পণ্য নেই, যা এই অ্যামাজনে পাওয়া যায় না। বিশ্বের প্রায় সবখানেই তারা সেবা দিয়ে থাকে। বর্তমানে অনলাইনে পণ্য বিক্রি সারা বিশ্বেই তুমুল জনপ্রিয়। সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পাওয়ার পাশাপাশি এসব অনলাইন থেকে মানুষ ভোগান্তি ছাড়াই ঘরে বসে কেনাকাটা করতে পারে। ফলে আধুনিক পৃথিবীতে ই-কমার্স ব্যবসার গুরুত্ব বাড়ছে।

এবার দেখে নেওয়া যাক, এই সুপার বিলিয়নারদের মধ্যে কারা কারা আছেন এবং তাঁদের সম্পদের পরিমাণই বা কত। এই তালিকায় সবার ওপরে আছেন ইলন মাস্ক; তাঁর সম্পদমূল্য ৪১৯.

৪ বিলিয়ন বা ৪১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার। দ্বিতীয় স্থানে আছেন অ্যামাজনের প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস; তাঁর সম্পদমূল্য ২৬৩.৮ বিলিয়ন বা ২৬ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার। তৃতীয় বার্নার্ড আর্নল্ট; তার সম্পদমূল্য ২৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৮৯০ কোটি ডলার। ২৩৭ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সম্পদ নিয়ে চতুর্থ স্থানে আছেন লরেন্স এলিসন।

মার্ক জাকারবার্গ: সম্পদমূল্যে পঞ্চম স্থানে আছেন ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ; তাঁর সম্পদমূল্য ২২০ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ২২ হাজার ৮০ কোটি ডলার।

সুপার বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে আছেন সের্জেই ব্রিন; তাঁর সম্পদমূল্য ১৬০ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার ৫০ কোটি ডলার। সপ্তম স্থানে থাকা স্টিভ বালমারের সম্পদমূল্য ১৫৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার ৭৪০ কোটি ডলার।

ওয়ারেন বাফেট: ১৫৪ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার ৪২০ কোটি ডলার নিয়ে অষ্টম স্থানে আছেন ‘বিনিয়োগ গুরু’ খ্যাত ওয়ারেন বাফেট। নবম স্থানে রয়েছেন জেমস ওয়ালটন; তাঁর সম্পদমূল্য ১১৭.৫ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। দশম স্থানে থাকা স্যামুয়েল ওয়ালটনের সম্পদমূল্য ১১৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার।

তালিকায় ১১তম স্থানে আছেন আমানিকো ওর্তেগা; তাঁর সম্পদমূল্য ১১৩ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। ১১০ বিলিয়ন বা ১১ হাজার কোটি ডলার নিয়ে ১২তম স্থানে এলিস ওয়ালটন। ১৩তম স্থানে থাকা জেনসেন হুয়ানের সম্পদমূল্য ১০৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৮৪০ ডলার।

বিল গেটস: ১০৬ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ নিয়ে ১৪তম স্থানে আছেন বিল গেটস। ১৫তম স্থানে থাকা মাইকেল ব্লুমবার্গের সম্পদের মূল্য ১০৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৩৪০ কোটি ডলার। ১০০ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৯০ কোটি ডলারের সম্পদের মালিক লরেন্স পেইজ আছেন ১৬তম স্থানে।

মুকেশ আম্বানি: তালিকায় ১৭তম স্থানে আছেন ভারতের মুকেশ আম্বানি; তাঁর সম্পদমূল্য ৯০ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৬০ কোটি টাকা ডলার। ১৮তম স্থানে থাকা চার্লস কোচের সম্পদমূল্য ৬৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৭৪০ কোটি ডলার। ১৯তম স্থানে আছেন জুলিয়া কোচ; তাঁর সম্পদের মূল্য ৬৫ দশমিক ১ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৫১০ কোটি ডলার।

সুপার বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে ২০তম স্থানে আছেন ফ্রাঁসোয়া মেয়ার্স; যাঁর সম্পদমূল্য ৬১ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ১৯০ কোটি ডলার।

গৌতম আদানি: ২১তম স্থানে থাকা ভারতের গৌতম আদানির সম্পদের মূল্য ৬০ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৬০ কোটি ডলার। ৫৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৯৮০ কোটি ডলার নিয়ে ২২তম স্থানে আছেন মাইকেল ডেল। ২৩তম স্থানে থাকা ঝং শ্যানশ্যানের সম্পদমূল্য ৫৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৭৭০ কোটি ডলার। ৫৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার নিয়ে ২৪তম স্থানে আছেন প্রোজোগো পাংগেতসু।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দশম ক ৪ ব ল য ন ব এই স প র ব ল ইলন ম স ক ১১ হ জ র ১০ হ জ র অ য ম জন পর ম ণ ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপি ও জামায়াতের কাছে কেন আরপিওর ২১ ধারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল

নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে গত ছয় দিনে দল দুটির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যেই নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন আরপিওর ২১ ধারার সংশোধনীর পরিবর্তন। জামায়াত মনে করে, সরকার বিএনপির চাপে নতি স্বীকার করে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত খসড়া সংশোধনী বাতিল করেছে। আর বিএনপি মনে করে, জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ায় ২১ ধারার পরিবর্তন করে; যা গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদিত হয়। আরপিওর ২১ ধারা সংশোধনীর ওই পরিবর্তন বহাল থাকলে কোনো দল জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে বাধ্য ছিল। ৩০ অক্টোবর সেটি আবার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। তাতে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে জামায়াত বেশ ক্ষুব্ধ হয়।

যদিও সরকারের দিক থেকে এই নতুন সিদ্ধান্তের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি শুধু বিএনপির দাবির কারণে নয়, ছোট বিভিন্ন দলেরও দাবি ছিল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করেছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই। আমরা সরকারের কথায় বিশ্বাস করি। সুতরাং এখন থেকে আমাদের সব কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক। এখন সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কীভাবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে, সেটি তাদের বিষয়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারকে যতটুকু সহযোগিতা দেওয়া দরকার, সেটা বিএনপি করবে।’

বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে...একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

এ দিকে আজ সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা হবে। তবে অন্য দিন রাতে সভা হলেও আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় সভা বসবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজকের সভায় আলোচ্যসূচিতে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিষয় থাকবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন–সংক্রান্ত বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে।

হঠাৎ কেন সামনে এল আরপিওর সংশোধনী

আরপিওর ২১ ধারার সংশোধন বিএনপি ও জামায়াতের কাছে হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়। এর পরেই সরকার আরপিওর ২১ ধারার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তে বিএনপি উপকৃত হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো, এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিএনপি। অন্য দিকে এতে লাভবান হয় জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে ‘ভরসা’ হিসেবে দেখেন।

...যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছে না। সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নায়েবে আমির, জামায়াত

এখন জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হলে ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে খুব আগ্রহী হবে না। এর কারণ দুটি। প্রথমত, বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্য দিকে জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে ভোটে জেতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীকে সরাতে বিএনপির নেতৃত্ব কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও আছে।

এ ছাড়া এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যে আটটি দল আছে, তারা আরপিওর ওই ধারা পরিবর্তনের পক্ষে। অর্থাৎ দলগুলো জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে—এর পক্ষে। এর জন্য দলগুলো যৌথ কর্মসূচিও করছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে দলগুলো পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ বা ‘রিকশা’ প্রতীক কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই ওই প্রতীকের পক্ষে এক হয়ে কাজ করবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। অন্যদিকে বিএনপির জোটের ক্ষেত্রে ভাবনা হচ্ছে, ধানের শীর্ষ প্রতীক না দিলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।

গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার দাবি করেন, একটি দলের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে সরকার আরপিওর সর্বশেষ সংশোধনী বাতিল করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল করা হলে সেটি ন্যক্কারজনক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে।

আরপিওর ২১ ধারার এই সংশোধনীর ফলে জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হতো। এতে জামায়াত খুশি হলেও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অস্বস্তিতে পড়েছিল। এ কারণে এর পরিবর্তন চেয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন উপদেষ্টাকে পৃথক চিঠি দেয়।

ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের পর থেকেই উত্তাপ

২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে—সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার বাস্তবায়নে বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট হবে। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এই সময়ের মধ্যে সংবিধান সংশোধন না করলে আপনা–আপনি সেটা সংবিধানে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গণভোট কবে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিন নাকি তার আগে—সেটা ঠিক করবে সরকার।

চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

বিএনপি প্রথমত ক্ষুব্ধ হয় বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে ভিন্নমত বাদ দেওয়ায়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন, ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া, সেটা না হলে আপনা-আপনি সংবিধানে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে দলটির আপত্তি আছে। দলটি গণভোট আগে নয়, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে চায়। জামায়াতের অবস্থান এর পুরো বিপরীত।

এসব নিয়ে পরস্পরকে লক্ষ্য করে দল দুটির রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।

গতকাল দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা দেখছি যে বাংলাদেশের শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যতই সময় যাচ্ছে, ততই বাংলাদেশে একটা অ্যানার্কিক সিচুয়েশন, একটা পুরোপুরি নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে।’

জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে এটা আসছে যে জামায়াত নির্বাচন পেছাতে চায়। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এমন বক্তব্য অবশ্য বিএনপি আরও আগে থেকেই দিয়ে আসছে।

এর আগের দিন শনিবার বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন, সেটা আপনারা করেছেন।’

পাল্টা বক্তব্য এসেছে জামায়াতের দিক থেকেও। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সেমিনারে বলেছেন, ‘বিএনপি ভেতরে-ভেতরে আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার একটা খায়েশ আছে মনে হচ্ছে। যে কারণে ফ্যাসিজমের যে রাস্তা, আমরা সংস্কারে বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, এগুলো ওনারা বন্ধ করতে দিচ্ছেন না।’

অবশ্য সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি যতই উসকানি দিক, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দূর করে স্পষ্ট করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। সুতরাং আসুন আমরা সব ভুলে আলোচনায় বসি।’

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থা চলতে থাকলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, একটা চরম অনৈক্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যুক্ত ছিল, তারা কীভাবে হারানো ঐক্য ফিরে পেতে পারে, সেটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা দরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ