নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে এখনই সতর্ক সরকার
Published: 8th, March 2025 GMT
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসন সাজাতে সতর্কে পা ফেলছে সরকার। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিকসহ বিভিন্ন তথ্য নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই চলছে। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) পদায়নের চূড়ান্ত তালিকা (ফিটলিস্ট) তৈরি করা হচ্ছে সময় নিয়ে। এ কারণে ডিসি পদায়নের চূড়ান্ত তালিকা তৈরির সাক্ষাৎকার দুই মাসেও শেষ হয়নি।
সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার একটি বিতর্কহীন তালিকা তৈরি করা হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ডিসি ও পুলিশ সুপার (এসপি) পদে প্রাধান্য পাবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। ভোটের তপশিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) ডিসি পদে রদবদল চাইলে এ তালিকা ধরেই করতে হবে। ডিসি-এসপির পাশাপাশি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) তালিকা তৈরিরও কাজ চলছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর ডিসি নিয়োগের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকায় কর্মকর্তা ছিলেন ১০৬ জন। এর মধ্যে ৬১ জনকে ডিসি করার পর বাকি ৪৫ কর্মকর্তা অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকলেও তাদের নানা কারণে গ্রহণযোগ্য মনে করছে না মন্ত্রণালয়। সংসদ নির্বাচনের আগে এসব কর্মকর্তাকে ডিসি পদে পদায়ন সম্ভব নয় বলে গত ১১ জানুয়ারি নতুন তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। তবে এখনও শেষ হয়নি অধিকাংশ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার। অথচ ফিটলিস্ট প্রণয়ন কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল এক দিন অন্তর সাক্ষাৎকার নিয়ে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ করার। আজ শনিবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ২৭তম ব্যাচের ৩০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার হওয়ার কথা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান সমকালকে বলেন, এবার বিতর্কহীন তালিকা তৈরির কাজ চলছে। নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের ডিসি করা হবে। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের বদলের জন্য সর্বশেষ তালিকা তৈরিতে সময় কম পাওয়া গিয়েছিল। তাই ভালোভাবে তদন্ত প্রতিবেদন নেওয়া যায়নি। আগে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল, এর পর তদন্ত প্রতিবেদন এসেছে। এ জন্য সর্বশেষ তালিকার কিছু কর্মকর্তাকে ডিসি পদে না বসিয়ে নতুন তালিকা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
দৌড়ে ৫০৯ কর্মকর্তা
নতুন ডিসি তালিকার জন্য প্রশাসন ও পূর্বতন ইকোনমিক ক্যাডারের বিবেচিত কর্মকর্তা রয়েছেন ৫০৯ জন। এর মধ্যে আছেন ২৫তম ব্যাচের ১৩৪ জন, ২৭তম ব্যাচের ২০৫ জন এবং ২৮তম ব্যাচের ১৫৮ জন। ২৫তম ব্যাচের ৪২ জন ও ২৭তম ব্যাচের ৩০ কর্মকর্তা আগেই ডিসি পদে পদায়ন পেয়েছেন।
প্রাধান্য পাবেন যারা
এখন ডিসি পদে কর্মরত আছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২৫ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৩ কর্মকর্তা। ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের শিগগির যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি হতে পারে। পরে তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বদলি করা হবে। ফলে সংসদ নির্বাচনের সময় ডিসি পদে থাকবেন ২৫, ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বেশি প্রাধান্য পাবেন। ২৫তম ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৪ সালে। তারা চাকরিতে যোগ দেন ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট। ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দেন ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর। ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দেন ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত।
চারটি ব্যাচ থেকে এসপি বাছাই
এখন জেলা পুলিশ সুপারের (এসপি) দায়িত্ব পালন করছেন ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক ও বিএনপি সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে মাঠে রাখতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা মাথায় রেখেই সম্প্রতি ২৪তম ব্যাচের কিছু কর্মকর্তাকে জেলা পর্যায়ে এসপি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে ২৮তম ব্যাচের কিছু কর্মকর্তাকেও জেলায় এসপি পদে পদায়ন করা হতে পারে। এসপি পদে বসানো হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে। ২৪তম ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৪ সালে। তারা চাকরিতে যোগ দেন ২০০৫ সালের ২ জুলাই। সে সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি সরকার।
জাতীয় নির্বাচনে ডিসি-এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন– এমন কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, নির্বাচন কমিশন যতই নিরপেক্ষ ও কঠোর হোক না কেন, যেসব কর্মকর্তা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট পদে দায়িত্ব পালন করবেন, তারা দক্ষ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা কঠিন হবে। নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের ফল গণনা পর্যন্ত এই কর্মকর্তারা যুক্ত থাকেন। জাতীয় নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা পোলিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ দেন। শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠের প্রশাসনটা সাজান তারা। জেলা পুলিশ সুপাররা আইনশৃঙ্খলার সার্বিক বিষয় দেখভাল করেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ডিসি হিসেবে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন– এমন ২২ কর্মকর্তাকে ফেব্রুয়ারিতে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। আবার ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা তৎকালীন ৩৩ ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। একইভাবে যারা এসপির দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি করা হয়েছে। ফলে এবার নিরপেক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তা খোঁজা হচ্ছে।
এদিকে এবার প্রথমবারের মতো ডিসি সম্মেলনের অধিবেশনে যুক্ত হয় ইসি। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আইনের মধ্যে থেকে ডিসিদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওপরের কোনো চাপ এলে সেটা ইসি সামলাবে। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন করাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য। ডিসি সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ডিসিরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিসি নিয়োগ নিয়ে নজিরবিহীন হট্টগোল হয়। দক্ষ ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের তোপের মুখে ৯ ডিসির পদায়ন বাতিল করা হয়। রদবদল করা হয় চার জেলার ডিসিকে। ফলে ধীরগতিতে সাক্ষাৎকার নিচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ইসি থেকেও হতে পারেন রিটার্নিং কর্মকর্তা
সংসদ নির্বাচনে মহানগর বাদে জেলায় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন ৬৪ ডিসি। আর প্রতিটি আসনে ইসি কর্মকর্তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এবার প্রথমবারের মতো ইসি থেকেও রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে পারবে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, আগে নির্বাচন কমিশনকে তাদের নিজেদের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত। এর পর প্রশাসনের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা যেতে পারে। নির্বাচনের সময় সরকারি কর্মকর্তারা ইসির অধীনে থাকলেও নিরপেক্ষ হওয়া দুরূহ। তবে ইসি কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ থাকা অনেক সহজ। কারণ, নির্বাচনের আগেপরে সরকারি কর্মকর্তাদের এমপি-মন্ত্রীর সঙ্গেই কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, একজন রিটার্নিং কর্মকর্তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো– সৎ ও নিরপেক্ষ হওয়া। পক্ষ-বিপক্ষ, হারজিত– এসব চিন্তা না করে দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করা।
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন সমকালকে বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার কথা বলেছে। আমরাও দীর্ঘদিন বলে আসছি, বর্তমান কমিশনকেও বলেছি। তিনি বলেন, বিভাগীয়, জেলা ও উপেজলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের দিয়ে ৩০০ আসনে নির্বাচন করার সক্ষমতা আমাদের আছে। সিটি করপোরেশন ও সংসদের উপনির্বাচন ইসি কর্মকর্তারা সম্পন্ন করছেন। জাতীয় নির্বাচনে ডিসিরা শুধু পদে থাকেন– সব কাজ ইসি কর্মকর্তারাই করেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ও আচরণবিধি অনুযায়ী কাজ করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। ইসির তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচন পরিচালনার সব কাজ তত্ত্বাবধান করবেন এবং ইসি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহায়তা করেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব য চ র কর মকর ত র কর মকর ত দ র ২৭তম ব য চ র কর মকর ত ক ক সরক র সরক র র অফ স র র জন য চ কর ত ক জ কর র সময় ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংস্কার এখনই প্রয়োজন
বছর দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সদ্য প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বুঝতে চাইছিলাম, সাড়ে তিন দশক আগের আমার ছাত্রত্বের সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি কতটুকু এগিয়েছে। বুঝলাম, দালান-কোঠায়, টেবিলে টেবিলে ফ্ল্যাটস্ক্রিন এলসিডি কম্পিউটার, এয়ারকন্ডিশন, প্রশস্ত কক্ষ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন, স্বাস্থ্য, বিমা, পরিবহন, সুযোগ-সুবিধা—সবকিছুতে প্রতিষ্ঠানটি দারুণভাবে এগিয়েছে।
প্রশ্ন করেছিলাম, ‘রেজিস্ট্রার ভবনে ছাত্রসেবার মান কতটা উন্নত হয়েছে?’ উত্তরদাতা মন্তব্য করেছিলেন, ‘রেজিস্ট্রার ভবনের নাম পাল্টে “লাঞ্চের পর আসুন ভবন” করা দরকার।’ নানা রকম ছাত্র-হেনস্তা আর দীর্ঘসূত্রতার বয়ান শুনে বুঝলাম, তিন দশকেও ছাত্রসেবার গুণগত উন্নয়ন তেমন একটা হয়নি। বাধ্য হয়ে খুবই সংক্ষেপে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করছি।
মাস্টার্স শেষ করেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চেষ্টা করেছিলাম। বৃত্তিসহ নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে তিনটি নিশ্চিত ভর্তি বাতিল হয়েছে রেজিস্ট্রার ভবনের ‘কল্যাণে’। সে যুগে ই-মেইল ছিল না। বিদেশে ডাকযোগে আবেদন ও যোগাযোগ ছিল দারুণ খরচের। তিনবারের প্রতিবারই সপ্তাহখানেকের সীমাহীন ভোগান্তি। ‘কাল আসুন’, ‘লাঞ্চের পর’, ‘এটা লাগবে, ওটা নেই কেন’ শুনতে থাকলাম।
নীলক্ষেত, নিজের ডিপার্টমেন্ট, ব্যাংক, রেজিস্ট্রার ভবনের এই তলা ওই তলা, এই অফিসার, ওই ডেস্ক। সময়, অর্থ, বোধ-বুদ্ধি ক্ষয়; ভিনদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাখ্যা-কৈফিয়ত আর সময় চাওয়া—সবই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। বন্ধু, স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘অমুককে ধরো’, ‘তমুককে বলো’, ‘তোমার অমুক শিক্ষক তো শিক্ষকনেতা! উনি বলে দিলে সব ফটাফট হয়ে যাবে’, ‘অমুক ছাত্রনেতা তোমার বন্ধু’। একজন এমনও বলেছিলেন, ‘এসবের মধ্য দিয়েই তো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে মাস্টার্স-পিএইচডি করছে! সিস্টেম বুঝলে এক দিনেই সব হবে, না বুঝলে ভুগবে!’ আমার তখন প্রচণ্ড জেদ ও আত্মসম্মানবোধ। না হলে না হবে, ধরাধরি
কখনো করিনি, করবও না। ছাত্রত্ব শেষে একটি এনজিওর গবেষণা শাখায় যোগ দিয়েছি। ফিল্ডওয়ার্কের প্রয়োজনে উত্তরবঙ্গে ছিলাম।
আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ও বিভাগেরই ছাত্রী, আমার পক্ষ হয়ে আরও কয়েক দিন নিষ্ফল গলদঘর্ম হলেন। মূল আলাপ এখানেই। অসংখ্য প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা নিজের কাজটি নিজেই করবেন। জানপ্রাণ দিয়ে একা একাই শেষ চেষ্টাটি করে যাবেন। এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই চোখে পড়ে বিভিন্নজনের ট্রান্সক্রিপ্ট নেওয়ার দুর্বহ অভিজ্ঞতার কথা।
তথ্যপ্রযুক্তির এমনই অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশন কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সেটা চায় না? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কি কখনোই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেনি? পরিবর্তন আনা হলে এখনো কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখেই চলেছেন ট্রান্সক্রিপ্ট জোগাড়জনিত বিড়ম্বনার কথা?
তিন দশক আগের আরেকটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করাও দরকার। তখনো গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়নি। মার্কসকে গ্রেডিংয়ের সমমান করে দেখাতে হতো। কোর্স নম্বর লেখা থাকত, শিরোনাম নয়। বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সমমান দেখিয়ে আবেদনের পর নির্দেশনা পেলাম কোর্সের নাম এবং রেজিস্ট্রার অফিস থেকে প্রত্যয়িত মার্কসের জিপিএ সমমান লাগবে। রেজিস্ট্রার অফিসে গেলাম। ঘুরেফিরে সবার দুটিই ভাষ্য। এক, এভাবেই সবাই নিচ্ছে। দুই, নিজেই যেন ব্যাখ্যা দিয়ে দিই। বললাম, সেটিই করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করছে না। উত্তর পেলাম, তাহলে তাদের কিছু করার নেই।
অতীতের ভীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনই করিনি। অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে আবেদনসহ নির্ধারিত ফি ও ডাক খরচ পাঠানোর পর আমার ঠিকানাতেই পাঠানো হয়েছে ট্রান্সক্রিপ্টগুলো। বিষয়টি চাকরি-সংক্রান্ত হওয়ায় পিএইচডির ট্রান্সক্রিপ্টই যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। যেভাবে চাওয়া হবে, সেভাবেই দলিলপত্র দিতে হবে।ওই ঘটনার কয়েক বছর পর একদিন নীলক্ষেতে কয়েকটি বই ফটোকপি করাচ্ছিলাম। আমার দুর্গতির গল্প শুনে একজন হেসে কুটিকুটি। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের ‘হেনস্তাসেবার’ সুযোগে দুটি বিশাল ‘সেবাগোষ্ঠীর’ জন্ম হয়েছে। এক, নীলক্ষেতের সেবা চক্র। টাকা দিলেই তারা সব করে দেয়—অনুবাদ, সমমান নির্ণয়; চাই কি ফলাফলে এদিক-সেদিক, হুবহু সিল-ছাপ্পড় ইত্যাদি। দুই, রেজিস্ট্রার ভবনের দালাল চক্র। তারা সত্যি সত্যিই সব ঠিকঠাক যে রকম লাগবে, সে রকমটিই করে দেয়, তবে টাকাপয়সা লাগে। বুদ্ধিমানেরা কেউ রেজিস্ট্রার অফিসের ঝক্কিতে যান না।
বক্তা জানালেন, তিনি অনেককেই চেনেন-জানেন, যাঁরা নীলক্ষেতের সেবা নিয়েই মাস্টার্স-পিএইচডি করে এসেছেন। সন্দেহ হতে লাগল, এই দুই ধরনের দুর্নীতি চক্রের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ছাত্রসেবার সংস্কার আটকে নেই তো! না হলে অতশত সিন্ডিকেট-সিনেট, সমিতি মিটিং, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে কীভাবে? খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত হলাম অনেকের ঝুঁকি নেওয়ার কথা শুনে।
ট্রান্সক্রিপ্ট জালের কারণে কানাডা থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল হয়, যাঁদের অনেকেই বাংলাদেশি। অ্যাসোসিয়েশন অব রেজিস্ট্রারস অব দ্য ইউনিভার্সিটিজ অ্যান্ড কলেজেস অব কানাডা (এআরইউসিসি) ছাত্রদের ব্যক্তিগত সম্মান ও গোপনীয়তার স্বার্থে নামধাম গোপন রাখলেও বাংলাদেশের ট্রান্সক্রিপ্টকে সন্দেহের তালিকায় রাখে।
আরও পড়ুনহার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বনাম আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত২৯ এপ্রিল ২০২৫প্রশাসনিক ভবনের অন্যায্যতা দেখেছি আমার ভূতপূর্ব কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিদেশে দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি করতে হয় ২২ মাসে, ২৪ মাসে নয়। মাস্টার্স শেষে ফেরার পর প্রাপ্য ইনক্রিমেন্টের জন্য আবেদন করলে এই অজুহাতে আমাকে বঞ্চিত করা হয় যে ২৪ মাসে নয়, ২২ মাসে সম্পন্ন করায় এটি পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি হয়নি।
সম্মানের বদলে অপমান! রেজিস্ট্রার ছিলেন অফিসার থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি। চিঠিটি পেয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে ভুল ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তাঁর কূপমণ্ডূকতা ও অনড় অবস্থান দেখে এতটাই বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম, আর একটি কথা বলতেও রুচিতে বেধেছে। বুঝলাম, এই জগদ্দল সরবার নয়। আমার পর একই প্রতিষ্ঠান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক শিক্ষক একই দৈর্ঘ্যের, একই ফ্যাকাল্টির, একই ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাঁদের কেউই বঞ্চিত হননি। তাঁদের বঞ্চিত না হওয়ার যোগ্যতা, তাঁরা রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট, ‘সিস্টেম’বান্ধব।
এখন বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে উচ্চশিক্ষার আবেদন নেয়। সাধারণত দুটি বিষয়ে আবেদনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়নির্ভর। এক, বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনকারীর পক্ষ হয়ে মূল ট্রান্সক্রিপ্টগুলো (পাঠক্রম-মূল্যায়ন) সরাসরি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আদান-প্রদানটি অনলাইনভিত্তিক। ব্যতিক্রম সামান্য। নিজেরই একটি অভিজ্ঞতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমার বর্তমান কর্মস্থলে আবেদনপত্রের শর্তে বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ, রেজিস্ট্রার অফিসের স্বাক্ষর-সিলমোহরসহ সম্প্রতি উত্তোলন করা মূল কপিগুলো (ফটোকপি বা ডিজিটাল কপি) নিজেই সংগ্রহ করে পাঠানোর নির্দেশনা ছিল।
অতীতের ভীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনই করিনি। অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে আবেদনসহ নির্ধারিত ফি ও ডাক খরচ পাঠানোর পর আমার ঠিকানাতেই পাঠানো হয়েছে ট্রান্সক্রিপ্টগুলো। বিষয়টি চাকরি-সংক্রান্ত হওয়ায় পিএইচডির ট্রান্সক্রিপ্টই যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। যেভাবে চাওয়া হবে, সেভাবেই দলিলপত্র দিতে হবে।
প্রতিবেশী ভারতও এখন শতভাগ অনলাইন পদ্ধতিতে ছাত্রদের সব একাডেমিক তথ্যসহ ট্রান্সক্রিপ্টের আবেদন, যাচাই-বাছাই, সত্যায়ন ও সরবরাহ করে। পদ্ধতিটির নাম ‘ট্রুকপি’। কানাডায় ‘মাইক্রেডস’। এআরইউসিসির মাধ্যমে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এই নেটওয়ার্কে যুক্ত। অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলোর নেটওয়ার্ক ‘ডিজিটারি’। যুক্তরাষ্ট্রের প্ল্যাটফর্ম একাধিক—‘ব্যানার’, ‘অ্যালুসিয়ান’, ‘পিপলসফট’, ‘পার্চমেন্ট’। সম্প্রতি এগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও যুক্ত হয়েছে, যা খুব সহজে জাল-ভেজাল শনাক্ত করতে পারে। সমন্বিত প্ল্যাটফর্মটির পরিচিতি এসআইএস বা ‘স্টুডেন্টস ইনফরমেশন সিস্টেম’।
বাংলাদেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র পরিষেবাও প্ল্যাটফর্মনির্ভর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক নিয়মকানুনের সঙ্গে মিল রেখে ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করছে। ফলে গ্র্যাজুয়েটরা এক-দুই দিনের মধ্যে বিদেশে উচ্চশিক্ষার আবেদন করতে পারছেন; নির্ঝঞ্ঝাটে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। তবু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভোগান্তি-বিড়ম্বনা টিকিয়ে রাখছে কেন?
● হেলাল মহিউদ্দীন, ভিজিটিং প্রফেসর, মন্টক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র