নারীর অধিকারকে দেখতে হবে মানবাধিকার হিসেবে
Published: 9th, March 2025 GMT
নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে দেখলেই সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। পাশাপাশি নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভয়ের ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। নারী–পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে হবে।
আজ রোববার বেলা ১১টায় ঢাকার ধানমন্ডি ডব্লিউভিএ অডিটরিয়ামে ‘আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করি: আদিবাসী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও কাপেং ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ আয়োজন করে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সভাপতি ফাল্গুনী ত্রিপুরা। সেখানে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে অন্যান্য নারীর মতো আদিবাসী নারীরাও রাজনৈতিক সংঘাত, দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, এমন নানা সমস্যা মোকাবিলা করে চলেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের কথাই প্রাধান্য পায়। নারীর অধিকার যে মানবাধিকার, পুরুষেরা এ বিষয়টি বিবেচনায় আনলে সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভয়ের ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। নারী উন্নয়নে প্রান্তিক নারীদের কথা মূলধারায় যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের ৫৪টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা যুগ যুগ ধরে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আদিবাসী নারীদের বিভিন্ন সময়, বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করা হয় বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুলেখা ম্রং। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে বাঙালি কিংবা বসতি স্থাপনকারীদের অবশ্যই আদিবাসী নারীর প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। নারীদের নিয়ে সমাজে যেসব অপসংস্কৃতির চর্চা হয়, তা বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমি বলেন, আদিবাসী প্রান্তিক নারী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে আদিবাসী কোটার কথা তুলতে হবে। তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়া নিজেদেরই আন্দোলন করে মূলধারায় যুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আদিবাসীদের রক্ত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সমাজকে টিকিয়ে রাখে নারী। সমতল কিংবা পাহাড়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর সর্বপ্রথম এই গণ–অভ্যুত্থানকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান বলে নারীদের আলাদা করা হয়। দেশের রাজনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিকরা এই গণ–অভ্যুত্থানকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান না বলে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান বললেই পারতেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের সাহসিকতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, নারীরা সাহসিকতার জন্য নানা ধরনের পুরস্কার পাচ্ছেন, কিন্তু কল্পনা চাকমার গল্প কোথায়? তাঁর পুরস্কারটি কোথায়?
নারীদের ওপর চলমান সহিংসতা রোধে স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার টিকে থাকার কোনো মোরাল গ্রাউন্ড (নৈতিক ভিত) নেই।’
জাতীয় নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘আমাদের জন্মই আজন্ম পাপ। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী যে বৈষম্যহীন সমাজ আমরা চেয়েছিলাম, সেখানে বর্তমানে নারীদের উপস্থাপন বলে দেয় এ দেশে আবারও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।’ অবিলম্বে তিনি নারী সংস্কার কমিশনের কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য লুনা নূর মনে করেন, দেশে গণতন্ত্র ও সহনশীলতার চর্চা না থাকলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেমন আদিবাসী নারীর অস্তিত্ব স্বীকার করা সম্ভব নয়। বর্তমানে তৌহিদি জনতার সংবিধানবিরোধী স্লোগান নারী–পুরুষের সমতা নিশ্চিতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আদিবাসী সমাজে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারী নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুলেখা ম্রং। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেখানে ১১টি সুপারিশ প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে আদিবাসী নারীদের মানবাধিকার নিশ্চিত, আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিরাপত্তা জোরদার করা, দোষীদের শাস্তি ও ভুক্তভোগীদের সহায়তা । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিতসহ কর্মসংস্থানে কোটা সংরক্ষণ জরুরি। জাতীয় ও স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন ও মন্ত্রণালয় গঠন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পাহাড়ে সম্পদশালী দরিদ্র ও দারিদ্র্যের কথা
পাহাড় ও সমতলের দারিদ্র্যে ভিন্নতা আছে। সমতলের প্রান্তিক মানুষ সম্পদের অভাবে দরিদ্র। আর পাহাড়ে মানুষ সম্পদের মধ্যে থেকেও দরিদ্র। অর্থাৎ তাঁরা সম্পদশালী দরিদ্র, সমতলের দরিদ্ররা সম্পদহীন দরিদ্র।
পাহাড়ে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি ভূমি, ভূপ্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে গাছ-বাঁশ, নদ-নদী, খাল-ঝিরি-ঝরনায় প্রাকৃতিক পাথর ও বহু সম্পদের সম্ভার রয়েছে। প্রকৃতি প্রদত্ত এই সম্পদ অবারিত। চাইলেই আহরণ করা সম্ভব। কিন্তু এত বিশাল সম্পদের ভান্ডারে যুগ যুগ ধরে বসবাস করেও যুগে যুগে পাহাড়ের মানুষ, বিশেষ করে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা দরিদ্র। অথচ সমতল থেকে অনেক মানুষ এই পাহাড়ে এসে সম্পদ আহরণ করে বিত্তবৈভবের অধিকারী হয়েছেন। বিপরীতভাবে অধিকাংশ পাহাড়ি নিঃস্বই থেকে গেছেন।
রাঙামাটিতে গত ২৫ এপ্রিল আয়োজিত একটি সেমিনারে ঘুরেফিরে এই সম্পদশালী দরিদ্রের কথাই আলোচনায় উঠে এসেছে। সেমিনারের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি বিকাশে করণীয়’।
সেমিনারের আয়োজক বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট। সেমিনারে তিন পার্বত্য জেলার চিন্তাশীল ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করেন। নির্ধারিত আলোচনার বাইরেও অনেকে আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক অভিঘাত ও দারিদ্র্য নিয়ে মতামত দেন; বরং বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশের বিষয়টি আলোচনায় গৌণ হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের দারিদ্র্য নিয়ে বেশি আলোচনায় উঠে এসেছে। তিন পার্বত্য জেলার ১১টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি। দারিদ্র্যও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বেশি।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, রাঙামাটিতে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৩ জনের মধ্যে প্রায় ৫৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, বান্দরবানে ৪ লাখ ৮১ হাজার ১০৬ জনে ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও খাগড়াছড়িতে ৭ লাখ ১৪ হাজার ১১৯ জনে ৩৫ দশমিক ৯২ শতাংশ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। পাহাড়ি জনসংখ্যা রাঙামাটিতে ৫৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বান্দরবানে ৪১ দশমিক ১৪ ও খাগড়াছড়িতে ৪৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
প্যানেল আলোচক পুলক জীবন খীসার মতে, পাহাড়ের বৌদ্ধরা বৌদ্ধধর্মীয় তত্ত্বের জ্ঞানভিত্তিক কর্মবাদী দর্শন সম্পর্কে জানেন না। অথচ উন্নত দেশের মানুষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী না হয়েও বৌদ্ধধর্মীয় তত্ত্বের চতুরার্য সত্য ও প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতিকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে প্রয়োগ করে সাফল্য অর্জন করছে। উন্নতির শিখরে উঠে গেছে।
যেমন উন্নয়ন–পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নে সমস্যা চিহ্নিত করা, সমস্যার কারণ নিরূপণ করা, সমাধানের পথ খুঁজে বের করা এবং সমস্যার সমাধান করা—সবই বৌদ্ধধর্মীয় তত্ত্বের আলোকে করা হয়। যেমনটা বৌদ্ধধর্মে বলা হয়, পৃথিবীতে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের উপায়ও আছে। অথচ পাহাড়ি বৌদ্ধদের এই তত্ত্বকর্মে প্রয়োগের বোধজ্ঞান নেই।
প্রাচীনকালে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু অধিবাসীরাও প্রাচীন সময় থেকে দরিদ্র; যদিও তাঁরা একসময়ে সুখী-সমৃদ্ধ সোনালি অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করেন। এখনো সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় অঞ্চল।
পাহাড়ি ভূমিতে পরিবেশবান্ধব ফলদ-বনজ ও সবজিবাগান, ফলকেন্দ্রিক শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা, বনায়ন ও বনশিল্প উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা, পাহাড়ে গবাদিপশুর খামার, ঝিরি-ঝরনায় ছোট ছোট বাঁধ নির্মাণ করে মাছ চাষ ও হাঁস–মুরগির পালন, নারীদের কুটির শিল্পের দক্ষতাকে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে নিয়ে আসা—এ রকম সম্পদ ও সম্ভাবনা সর্বত্র রয়েছে। কিন্তু এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চল দেশের দারিদ্র্য সূচকে বরাবরই অত্যন্ত নিচের স্তরে রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি।
পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের ২০২২ সালের দারিদ্র্য মানচিত্রে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার ১৯ দশমিক ২ শতাংশ হলেও তিন পার্বত্য জেলায় ৪৮ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে অতিদরিদ্র্যের সংখ্যা বান্দরবানে ২৫ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে প্রায় ১৬ শতাংশ ও রাঙামাটিতে সাড়ে ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা অনুযায়ী দৈনিক আয় ২ দশমিক ১৫ ডলার, অর্থাৎ ২৬২ টাকার নিচে হলে অতিদরিদ্র। আবার জাতীয় দারিদ্র্যসীমার মানদণ্ডে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সেবা ক্রয়ের সামর্থ্য মাসিক ৮ হাজার ৮২২ টাকার নিচে হলে অতিদরিদ্র ধরা হয়। যদিও দারিদ্র্য মানচিত্রের তথ্যে বিতর্ক রয়েছে। যেমন তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার বান্দরবানে ২০১৬ সালে ছিল ৬২ শতাংশ, সম্প্রতি প্রকাশিত মানচিত্রে হয়েছে ২৫ শতাংশ। খাগড়াছড়ির দারিদ্র্যের হার ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশে নেমেছে।
প্রবীণ-নবীন অনেকের সঙ্গে সম্পদের মধ্যে থেকেও দারিদ্র্য দূর করতে না পারার কারণ নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁরা বহুমাত্রিক কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দ্বিতীয়ত, শিক্ষা তথা গুণগত শিক্ষার সমস্যা, তৃতীয়ত, ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন—এ প্রধান তিনটি বিষয়সহ আরও অনেক কারণ তুলে ধরা হয়। বস্তুত অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পাহাড়িদের আর্থসামাজিক উদ্যোগ ও অবস্থা, কোনোটাই স্থিতিশীল নয়। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে মানুষের বিশাল আশা–আকাঙ্ক্ষা ছিল।
পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে, সবাই আত্মোন্নয়নে মনোনিবেশ করবেন। ১৯৯৭ সালে চুক্তির পর কয়েক বছর পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণও ছিল। আজ পাহাড়িদের যা উন্নয়ন স্থিতি, অধিকাংশই সেই সময়ের কয়েক বছরের মধ্যে হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। মানুষের উন্নয়নযাত্রার উদ্যোগে একেবারে ভাটা না পড়লেও স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। শুধু খেয়েপরে বেঁচে থাকার কাজ ছাড়া মানুষ স্থায়িত্বশীল পরিকল্পনা নিয়ে মাঝারি ও বৃহৎ পরিসরে উন্নয়নে হাত দিতে পারছে না। কিছু করতে গেলেই নানামুখী চাপ ও ভয়ের মুখে পড়তে হয়। এই অবস্থায় পার্বত্য অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমানো যায়নি। অশান্ত ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রধান পিছুটান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর্থসামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার নিম্নহার একটি বড় বাধা। বিশেষ করে সম্পদের মধ্যে থেকেও দরিদ্র থাকা পাহাড়ি মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রধান বাধা বলা যেতে পারে। পার্বত্য চুক্তি পরে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এখানকার মানুষ দাবি করেছিলেন, পাহাড়ে দারিদ্র্য দূর করতে হলে শিক্ষাকেন্দ্রিক উন্নয়ন জরুরি। এখানে সম্পদের অভাব নেই, দক্ষ মানবসম্পদের অভাব আছে। মানুষ সম্পদ আহরণ করে নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারছে না। তাঁদের দারিদ্র্য কমানো যাচ্ছে না।
দুর্গম এলাকার প্রতিটি পাড়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করা সম্ভব নয়। সেখানে ছোট ছোট কয়েকটি পাড়া নিয়ে শিক্ষা ক্লাস্টার করে আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। ওই আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আশপাশের পাড়াগুলোর যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ সব উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হোক। এভাবে ২৫ থেকে ৩০ বছরের জন্য স্বল্প ও মধ্য মেয়াদের উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মানে সৃজনশীল জনশক্তি। তাঁরাই বিদ্যমান সম্পদ কাজে লাগিয়ে নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করে নিতে সক্ষম হবেন।
পার্বত্য চুক্তির পরে হাজার হাজার কোটি টাকা উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় চাহিদা ও বাস্তবতার আলোকে উন্নয়ন হয়নি। আবাসিক শিক্ষাব্যবস্থাকে নিউক্লিয়াস করে শিক্ষাকেন্দ্রিক উন্নয়ন বাস্তবায়ন হয়নি। এতে করে গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করা যায়নি। প্রথম আলোর ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বরের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাহাড়ে প্রাথমিক শিক্ষাতেই ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। বিবিএসের ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, ২ শতাংশের কম শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যেতে পারছে। শিক্ষার এই শোচনীয় অবস্থার কারণে সম্পদশালী দরিদ্ররা দরিদ্র রয়ে গেছেন। তাঁদের ধরে রাখা দারিদ্র্য দূর করার জন্য অনিশ্চিত সময়ের গন্তব্যে উন্নয়ন চলমান।
জাতীয় উন্নয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা বলে একটি কথা আছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণায় না হলে জাতীয় উন্নয়ন ধারার উন্নয়নে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর সুযোগের চেয়ে বঞ্চনা তৈরি হয় বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও জাতীয় উন্নয়ন ধারণায় অধিকাংশ উন্নয়নের পরিকল্পনা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এসব উন্নয়নে স্থানীয় মানুষের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। অনগ্রসর স্থানীয় মানুষেরা জানা নেই, শোনা নেই এমন উন্নয়নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
ধরা যাক, রুমা থেকে থানচি একটি সড়ক নির্মাণ করা হবে। মোট ৩০ কিলোমিটারের সড়কে মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, খুমি ও খেয়াং জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউ জানেন না সড়কের গতিপথ বা অ্যালাইনমেন্ট সম্পর্কে। নির্মাণ উপকরণ স্থানীয় পাথর, গাছ বা অন্য কিছু হবে—তাঁদের কিছুই জানানো হয়নি। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণে পাহাড় কাটতেই হবে। তাহলে পাহাড় কাটার ফলে পানির উৎস বা ঝিরি-ঝরনা কী হবে? এই ঝিরি–ঝরনাগুলো কেন্দ্র করে পাড়া গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে যাবে সড়ক। সড়ক হওয়ার পর এই বনাঞ্চল কারা রক্ষা করবে?
এই বনাঞ্চলই পানির উৎস ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে। অর্থাৎ সড়ক নির্মাণে আর্থসামাজিক উন্নয়নে কী কী সুযোগ ও ঝুঁকি তৈরি হবে, সেই সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের ন্যূনতমও জানানো হয়নি। এর ফলে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত স্থানীয় লোকজন সড়ক নির্মাণ হওয়ার কারণে সৃষ্ট কোনো সুযোগ আহরণ করতে পারেননি। বনাঞ্চলের গাছ-বাঁশ, ঝিরি–ঝরনার পাথরসহ সব সম্পদ ও সুযোগের সুবিধাভোগী হয়েছেন অন্য এলাকা থেকে আসা মানুষজন। একদিকে স্থানীয় প্রান্তিক মানুষ স্থানীয় সম্পদ হারাচ্ছেন, তাঁদের জনগোষ্ঠীর হিসেবে করা উন্নয়নে আহরণযোগ্য সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে উন্নয়নে সৃষ্ট পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাঁদের। উন্নয়নের শিকারে পরিণত হচ্ছেন তাঁরা। এ জন্য পাহাড়িদের মধ্যে একধরনের উন্নয়ন ফোবিয়া বা ভয় তৈরি হয়েছে। উন্নয়নের কথা বললে কার জন্য উন্নয়ন জানতে চান।
পাহাড়ে সম্পদশালী দরিদ্রদের এটি খুবই সাধারণ চিত্র। সম্পদ ও সুযোগ আছে, সক্ষমতা নেই। আহরণ ও ব্যবহার করতে না পেরে দারিদ্র্য গোছাতে পারছে না। আবার জাতীয় উন্নয়নের ভাবধারার উন্নয়নে স্থানীয় সম্পদ ও সুযোগ হারিয়ে বিশাল একটি অংশ আরও বেশি প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে। দারিদ্র্য কমানো যাচ্ছে না পাহাড়ে। প্রকৃতপক্ষে এই সম্পদশালী দরিদ্রদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। সমতলের সম্পদহীন দরিদ্রদের উন্নয়নের ভাবনায় পাহাড়ে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হবে না। স্বাধীনতার ৫৫ বছরে তা অনেকটা প্রমাণিত সত্য। তবে সবার আগে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
বুদ্ধজ্যোতি চাকমা প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি