জুলাই আন্দোলনে বিভিন্ন অংশীজন, সাধারণ মানুষসহ নানা জায়গা থেকে সহায়তা আসার কথা জানিয়েছেন সেই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। জুলাই অভ্যুত্থানের এই শীর্ষ নেতা বলেন, আন্দোলনে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর একটা ভূমিকা ছিল। বেশির ভাগ আন্দোলন ভন্ডুল হয়ে যায় নেতৃত্বের কাড়াকাড়ি অথবা ব্যানারবাজির কারণে। এই আন্দোলনে এই বিষয়গুলো ছিল না।

আন্দোলনে ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ সংগঠন) বিদ্রোহী একটা অংশেরও ভূমিকা ছিল বলে জানান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়কের দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়াদের আমরা বিদ্রোহী বা বিপ্লবী ছাত্রলীগ বলি। ছাত্রলীগের বিদ্রোহী অংশ বের না হলে আন্দোলনটা বড় হতো না।’

জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা ছিলেন নাহিদ ইসলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বই ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।

জুলাই–আগস্টের উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মরণ করে নাহিদ বলেন, আন্দোলনে সব ছাত্রসংগঠনের একটা বোঝাপড়া একদম শুরু থেকেই ছিল। তারা (ছাত্র সংগঠনগুলো) তাদের মতো করে লোকবল পাঠিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও একধরনের অলিখিত সমঝোতা ছিল। যদিও কখনো বসে পরিকল্পনা করা হয়নি।

অনুষ্ঠানে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, আমরা যারা এই আন্দোলনে সামনের দিকে ছিলাম, আমার জায়গা থেকে, কথা বলার সময় এখনো আসেনি। সেই সময়টা আরও পরে আসবে, যখন সব কথা বলা যাবে। আবার এটাও সত্য যদি আমরা এখন কিছু কথা বলে না রাখি, তাহলে অনেক ঘটনার বিভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন (ব্যাখ্যা) হবে বা হচ্ছেও। সেই জায়গা আসিফ (উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ) এই কাজটা করেছেন। এটা সবার জন্যই সহায়ক হবে। আসিফের বইতে মোটামুটি একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। এই আন্দোলনটা একটা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে, আবার পরিকল্পনার বাইরে গিয়েও ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছে। মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কানেক্ট করতে হবে, এটাই ছিল এই আন্দোলনের মূল পরিকল্পনা। শুরুতেই আন্দোলনের নেতৃত্ব ও কৌশলের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল।’

নাহিদ বলেন, গত ৭-৮ বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রদের পক্ষের বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে একেবারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জায়গা থেকে বিভিন্ন সময়ে তাঁরা আন্দোলন করেছেন। তাঁদের একটা ছাত্রসংগঠন ছিল ছাত্রশক্তি। এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আখতার হোসেন (এখন এনসিপির সদস্যসচিব) ক্যাম্পাসে পরিচিতমুখ ছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের শুরুতে বোঝাপড়া ছিল যে আখতার হোসেন সামনের দিকে থাকবেন না। এমনকি এমন ব্যাপারও ছিল যে তিনিও সামনের দিকে থাকবেন না।.

..আন্দোলনের পরিসর বিস্তৃত করার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয়টা নেওয়া হয়েছিল।

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘একটা স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান এবং নানা মানুষের অংশগ্রহণ ও অবদান ছিল। আমরা নিজেরাও জানি না, কোথা থেকে কত সহযোগিতা তখন এসেছে। আমি বললে সেটা আমার গল্পই হবে আসলে। আসিফ যখন বইটা লিখছেন, তখন এটা আসিফেরই গল্প। আমাদের প্রত্যেকেরই এই অভ্যুত্থানে আলাদা আলাদা গল্প আছে। এই আলাদা আলাদা গল্পগুলো একটা কালেকটিভ স্টোরি (সামগ্রিক গল্প) তৈরি করবে। আমরা নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গল্প বলছি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরাও নেমে এসেছিলেন। আমি তো এখনো জানি না কুমিল্লা, নরসিংদী বা ঢাকার বাইরে আন্দোলনটা কীভাবে সংগঠিত হয়েছে। তাঁদের গল্পগুলো আরও বেশি করে আসা দরকার।’

এক দফার সিদ্ধান্ত মানুষই নিয়েছে

নাহিদ ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেন, ১৬ জুলাই তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, আন্দোলনটা সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে যাবে এবং নিয়ে যেতে হবে। কারণ ওই সরকারের হাতে ইতিমধ্যেই রক্তের দাগ লেগে গিয়েছিল। এরপর তাঁদের যে ৯ দফা, তার মধ্যে এক দফার বার্তাটা ছিল। কিন্তু তাঁরা প্রথমেই এক দফার দিকে যাননি।

এর কারণ বলতে গিয়ে নাহিদ বলেন, এক দফা বা সরকার পতনের বিষয়টা জনগণের ভেতর থেকে আসতে হয়। মানুষ যখন চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে, তখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক দফার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু তার আগেই মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল। শহীদ মিনারে আসলে এক দফার বাইরে অন্য কিছু বলার ক্ষমতা কারও ছিল না। এ ছাড়া ৫ আগস্ট কিন্তু গণভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ছিল না। কর্মসূচিটা ছিল ‘লং মার্চ টু ঢাকা’, ঢাকায় আসতে হবে। ঢাকায় এসে কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত মানুষই নেবে।

আন্দোলনের সময় গত বছরের ২৩ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) যে সংবাদ সম্মেলন হয়, সে প্রসঙ্গও তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ডিজিএফআই থেকে বলা হয়েছিল যেন আমরা বলি এটা বিএনপি–জামায়াতের আন্দোলন এবং সব অগ্নিসন্ত্রাস তারা করছে। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে থেকে আমি আরও বলি  সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিরোধীদলের নেতা–কর্মীদেরও নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরা এটার নিন্দা জানাচ্ছি। ফলে এখানে একধরনের মিথষ্ক্রিয়া ঘটেছে এবং এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনটা পরিণতির দিকে গেছে। ’

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদার (এখন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক) আন্দোলনে মাঠের কর্মসূচির বিষয়টি মূলত দেখতেন বলে জানান নাহিদ। তিনি বলেন, এই দুজনের সঙ্গে রিফাত রশিদ (এখন এনসিপির নেতা), হাসিব আল ইসলাম (এখন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতা) ও আবদুল কাদের (এখন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতা) সমন্বয় করতেন। পেছন থেকে সহযোগিতা করেছেন মাহফুজ আলম (বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা) ও আখতার হোসেন। পরে এসে যুক্ত হন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী (এখন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক)।

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আরেকটা ফ্যাসিবাদ তৈরি হবে না, এ রকম একটা রাষ্ট্রকাঠামো বা সমাজব্যবস্থা তৈরি করার জন্য কাজ করতে হবে। জুলাই থেকে আমরা শুরু করেছি, শিখেছি। এই গণতান্ত্রিক লড়াইটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ন হ দ ইসল ম উপদ ষ ট অন ষ ঠ স গঠন এনস প সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার

অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় ওই চারজনের কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবের শুনানি শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বহিষ্কৃত সদস্যরা হলেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ কবির হোসেন, রফিকুল ইসলাম রফিক ও তরফদার আবদুল মুকিত। তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আদালতের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ গফুর বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হওয়াতে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ সমিতির নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে নন। বৃহস্পতিবার ওই চার সদস্যকে বহিষ্কারের বিষয়টি নোটিশ দিয়ে জানানো হবে।’

সমিতি সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ কবির হোসেনের (জনি) কাছে ৩৫ লাখ টাকায় শহরের বারান্দীপাড়া কদমতলা এলাকায় জমি বিক্রি করেন ইমরান হাসান। জমি রেজিস্ট্রির আগে সব টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও সৈয়দ কবির হোসেন ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। বাকি ২৫ লাখ টাকা না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকেন। পরে তিনি আরও ১৭ লাখ টাকা দেন। বাকি ৮ লাখ টাকা চাইলে হুমকি দিতে থাকেন কবির হোসেন। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ইমরান হাসান আইনজীবী সমিতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।

সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে কবির হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কবির হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

এ বিষয়ে আইনজীবী কবির হোসেন বলেন, ‘বহিষ্কারের বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে যে বিষয়ে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই বিষয়ে অভিযুক্ত আমি নই। তারপরও আইনজীবী সমিতি আমার অভিভাবক; তারা যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’

অন্যদিকে অভয়নগরের নওয়াপাড়ার জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশন পাওনা টাকা আদায়ে আবদুর রাজ্জাককে মামলার আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক আটটি চেকের মামলা পরিচালনা করেন। এসব মামলার রায় ও আপিল বাদীর অনুকূলে যাওয়ার পর আটটি চেকের ৪১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নেন আবদুর রাজ্জাক। এ টাকা জয়েন্ট ট্রেডিং কর্তৃপক্ষকে না দিয়ে তিনি ঘোরাতে থাকেন। চলতি বছরের ৪ জুন তিনি ১৫ লাখ টাকার একটি চেক দেন। চেকটি ব্যাংকে জমা দিলে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় নগদায়ন করা যায়নি। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওহাব গত ২৮ জুলাই আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে যশোর আইনজীবী সমিতি‌ বরাবর অভিযোগ করেন।

এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুর রাজ্জাককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় যশোর আইনজীবী সমিতি। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় আবদুর রাজ্জাককে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম রফিক তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণ ও মামলা করতে টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে মামলা না করায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আইনজীবী তরফদার আবদুল মুকিতের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ