দক্ষিণ এশিয়ায় আবহাওয়া সতর্কতায় বিদেশ নির্ভরতার চ্যালেঞ্জ
Published: 22nd, March 2025 GMT
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ২১০ কোটি মানুষ বসবাস করে। অঞ্চলটি তাপপ্রবাহ, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন, ভূমিধস, মৌসুমি বৃষ্টি, বজ্রপাত, টর্নেডো, ধূলিঝড়, শৈত্যপ্রবাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার মতো চরম আবহাওয়ার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা ক্রমে বাড়ছে, যা কার্যকর আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নয়নের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলছে। এ অঞ্চলের অনেক দেশ তাদের আবহাওয়া পূর্বাভাসের জন্য মূলত বহিরাগত প্রযুক্তি ও সমাধান প্রদানকারী বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল।
বহিরাগত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থায় বেশ কয়েকটি গুরুতর সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
প্রথমত, বেশির ভাগ দেশ উন্নত আবহাওয়া মডেল, স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণ এবং পূর্বাভাসের সরঞ্জামগুলোর জন্য বাণিজ্যিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এটি ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই নয়। অধিকন্তু, এই মডেলগুলো সবসময় স্থানীয় জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে নির্ভুল পূর্বাভাস অনেকটা অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, প্রায় সব দেশ আধুনিক আবহাওয়া মডেলিং পরিচালনার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং অবকাঠামো (এইচপিসি) এবং তাৎক্ষণিক তথ্য সংযোজন ও বিশ্লেষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। উচ্চ রেজলিউশনের আবহাওয়া পূর্বাভাস তৈরি করতে গেলে প্রচুর পরিমাণে তথ্য বিশ্লেষণ করতে হয়, যা শক্তিশালী কম্পিউটিং ক্ষমতা ছাড়া সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, তথ্যপ্রবাহ এবং আন্তঃদেশীয় সমন্বয়ের ঘাটতি দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলছে। অধিকাংশ দেশই আবহাওয়া, সমুদ্রবিজ্ঞান, হাইড্রোলজি এবং জলবায়ুসংক্রান্ত রিয়েল টাইম তথ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্য কোনো সমন্বিত কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ পরিচালনা করে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনেক সময় দেরিতে সরবরাহ হয়, যা দুর্যোগ প্রস্তুতির জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
চতুর্থত, দক্ষ আবহাওয়াবিদ, জলবায়ু বিজ্ঞানী এবং ডেটা বিশ্লেষকদের সংখ্যা এ অঞ্চলে খুবই সীমিত। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। এ ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবহাওয়া সংস্থার মধ্যে সহযোগিতার ঘাটতি দক্ষ জনশক্তি তৈরির পথে একটি বিরাট বাধা।
পঞ্চমত এবং প্রধানত অনেক অঞ্চলে মাফিয়া সিন্ডিকেটের কার্যক্রমও একটি বড় বিপদ। সরকারের প্রকল্পগুলোতে যন্ত্রপাতি ক্রয় প্রক্রিয়ায় অবৈধ তৎপরতা এবং দুর্নীতি প্রায় পরিলক্ষিত হয়। সিন্ডিকেটগুলো প্রায়ই কম মূল্যে নিচু মানের অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো তৈরিতে বেশি প্রলুব্ধ হয়। বিদেশি প্রযুক্তি ক্রয়, বিদেশ গমন, টেন্ডার এগুলোতে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট সবাইকে জিম্মি করে রাখে। তারা প্রতিষ্ঠান, দেশ ও প্রজন্মের বারোটা বাজায়।
এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও স্বনির্ভর করে তুলতে স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। স্থানীয় জলবায়ু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পূর্বাভাস মডেল তৈরি করা হলে পূর্বাভাসের নির্ভুলতা বৃদ্ধি পাবে।
উন্নত কম্পিউটিং অবকাঠামোতে বিনিয়োগও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে উন্নত পূর্বাভাসের জন্য বিশাল তথ্য সেট বিশ্লেষণ সহজ হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আবহাওয়া বিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান এবং পূর্বাভাস প্রযুক্তিতে উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে।
পাশাপাশি ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউট (নোয়ামি), সাউথ এশিয়ান এবং সাউথ এশিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (সামা)-এর মতো সংস্থাগুলোকে কাযর্কর রাখতে হবে।
আঞ্চলিক তথ্য বিনিময় ব্যবস্থার উন্নয়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে তথ্য ভাগাভাগির একটি কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে রিয়েল টাইম আবহাওয়া ও সমুদ্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য সহজলভ্য হয়। সার্ক, বিমসটেক এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সমন্বিত আবহাওয়া তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে তথ্যপ্রবাহ এবং পূর্বাভাসের নির্ভুলতা বাড়বে। যদিও বহিরাগত প্রযুক্তি সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীলতা কমানো জরুরি। তবে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া সংস্থা যেমন ডব্লিউএমও, ইসিএমডব্লিউএফ, কোপারনিকাস ডেটা ব্যবহার করার কৌশলগত সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা যেন যথাযথ কাজে লাগানো সম্ভব হয়।
উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত ডেটা সেট তৈরি এবং বৈশ্বিক মানসম্পন্ন পূর্বাভাস প্রস্তুত করা সম্ভব হবে, যা স্থানীয় পূর্বাভাসের নির্ভুলতা বাড়াতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস মডেলের সঙ্গে স্থানীয় মডেলগুলোর সমন্বয় ঘটানো গেলে আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা আরও কার্যকর হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও আত্মনির্ভর করতে বহিরাগত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক ও মানবসম্পদ শক্তিশালী করা অপরিহার্য। উন্নত কম্পিউটিং অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা বাড়ানো এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চল একটি স্বনির্ভর, কার্যকর ও জলবায়ু সহনশীল পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে।
ড.
mohan.smrc@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প র ব ভ স ব যবস থ র ওপর ন র ভরশ ল সহয গ ত অবক ঠ ম ক র যকর র জন য সমন ব জলব য
এছাড়াও পড়ুন:
পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা ভিনগ্রহের বস্তু নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ইলন মাস্ক
গত জুলাই মাসে শনাক্ত হওয়া রহস্যময় ‘৩আই/অ্যাটলাস’ নামের আন্তনাক্ষত্রিক বস্তুর পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। আমাদের সৌরজগতের মধ্যে থাকা বস্তুটি এমন আচরণ করছে, যা বিজ্ঞানীরা আগে কখনো দেখেননি। কারও ধারণা এটি ধূমকেতু, আবার কারও মতে ভিনগ্রহ থেকে আসা মহাকাশযান। উৎস ও পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে না পারলেও বস্তুটি পৃথিবীর জন্য কোনো হুমকি নয় বলে ধারণা করছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী অভি লোব অভিযোগ করেছেন, নাসা বস্তুটির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করছে। বিশাল আকারের অতিদ্রুতগামী মহাজাগতিক বস্তুটি অস্বাভাবিক রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণ করছে, যা বিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। অনেকের ধারণা, ৩আই/অ্যাটলাস কোনো কৃত্রিম উৎস থেকে তৈরি হতে পারে। এবার এই বিতর্কে নাম লিখিয়েছেন মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলন মাস্ক।
জনপ্রিয় মার্কিন পডকাস্ট দ্য জো রোগান এক্সপেরিয়েন্সে ইলন মাস্ক ৩আই/অ্যাটলাস নামের আন্তনাক্ষত্রিক বস্তু সম্পর্কে নিজের ভাবনা প্রকাশ করেছেন। বস্তুটি কোনো ভিনগ্রহের মহাকাশযান হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইলন মাস্ক বলেন, ‘আপনি যদি এটিকে সম্পূর্ণ নিকেল দিয়ে তৈরি করেন, তবে তা হবে একটি অত্যন্ত ভারী মহাকাশযান। এটি এমন একটি যান হতে পারে, যা একটি মহাদেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। তার চেয়েও খারাপ কিছু ঘটাতে পারে। যদি আমি ভিনগ্রহের কোনো প্রমাণ সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে কথা দিচ্ছি আপনার অনুষ্ঠানে আসব। আর এখানেই তা প্রকাশ করব।’
অভি লোবের দাবি, আন্তনাক্ষত্রিক বস্তুটি পৃথিবীর ওপর নজরদারি করতে পাঠানো ভিনগ্রহের কোনো মহাকাশযান হতে পারে। অস্বাভাবিক লেজযুক্ত বস্তুটি প্রতি সেকেন্ডে চার গ্রাম নিকেল নিঃসরণ করছে; যদিও সেখানে কোনো লোহার উপস্থিতি নেই। ধূমকেতুর ক্ষেত্রে এমন আচরণ আগে দেখা যায়নি।
জো রোগান তাঁর আলোচনায় ধূমকেতুর রহস্যময় বৈশিষ্ট্যের ওপর জোর দেন। ধূমকেতুর গ্যাসের মেঘে নিকেলের উপস্থিতি উল্লেখ করেন। এই ধাতু পৃথিবীতে প্রধানত শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত সংকর ধাতুতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে ইলন মাস্ক নিকেলের উপস্থিতির একটি পার্থিব ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, অনেক ধূমকেতু ও গ্রহাণু প্রাথমিকভাবে নিকেল দিয়ে তৈরি। পৃথিবীতে যেখানে নিকেলখনি দেখা যায়, সেখানে আসলে অতীতে নিকেলসমৃদ্ধ কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু আঘাত করেছিল।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া