সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা: অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত
Published: 24th, March 2025 GMT
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কবি ফয়েজ আহ্মদ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জাতীয় প্রেস ক্লাব ভবনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কামানের গোলায় আহত হয়ে প্রথমে তাঁর গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে, পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় চলে যান। সেখান থেকে কলকাতায় গিয়ে চেষ্টা করেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। কিন্তু তাঁর ‘চীনপন্থি’ তকমা এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি চলে যান জলপাইগুড়ি। পরে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আহ্বানে কলকাতায় এলে তাঁকে বলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিতে। ফয়েজ আহ্মদ প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তিনি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হতে চান। তাজউদ্দীন তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যে ফ্রন্টেই আপনি অংশ নেন, আপনার পরিচয় হবে মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করলেও আপনি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সম্মানই পাবেন।’ ফয়েজ আহ্মদ তাঁর স্মৃতিকথা ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’তে এসব কথা তুলে ধরেছেন।
কথাটি মনে পড়ল গত ২১ মার্চ সমকালের একটি প্রতিবেদন পড়ে। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকার সাম্প্রতিক এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক এমএনএ ও এমপিএর বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় থাকছে না। তাদের পরিচয় হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। একই পরিচয় পাবেন ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলী, ফুটবল দলের খেলোয়াড়, বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠকরা। জামুকার সিদ্ধান্তটি উপদেষ্টা পরিষদ পাস করলেই তারা সবাই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ থেকে হয়ে যাবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, এতে নাকি কারও মর্যাদা বা সুনাম ক্ষুণ্ন হবে না। মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁকে সহায়তাকারীর মধ্যে পার্থক্য কী– উপদেষ্টার হয়তো তা বোধে আসছে না। যদি আসত, তাহলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি অন্তত দশবার ভাবতেন।
দেশে অতীতে অনেকে রাষ্ট্রপতি-মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, ভবিষ্যতেও হবেন। তবে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান তারাই পেয়েছেন, যারা একাত্তরে জীবনের মায়া ত্যাগ করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আজ দেখা যাচ্ছে, তাদের অনেকের স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যে মানুষটি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ, যাঁকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নাকি এখন থেকে আখ্যায়িত হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে! আমি কখনও আওয়ামী লীগ করিনি। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শেও বিশ্বাসী নই। তবে একটি কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করতে দ্বিধা করি না যে, বঙ্গবন্ধু না হলে আমরা হয়তো এই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হতে পারতাম না। তা ছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে যারা সফল করে তুলেছিলেন, সেই মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী-কর্মকর্তা, সাংবাদিক, সেক্টর কমান্ডারসহ যারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছেন, তারা সবাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সম্মানীয়। সে সম্মানের আসন থেকে তাদের নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
১৯৭১-এ প্রবাসী বাঙালিরাও অবদান রেখেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রন্থে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর আবু সাঈদ চৌধুরী দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে লন্ডনে এসে আত্মনিয়োগ করেছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে। বিবিসিতে সে সময় কর্মরত প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান তাঁর বই ‘ইতিহাস কথা কয় ও নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের অবদানের কথা। বিএনপি নেতা ড.
এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সমকালকে তিনি বলেছেন, “আমরা ইতিহাসের সত্যটা জানি। কোনো আইন বদল করে কারও অবদান বদলে দেওয়া যাবে না। এটি করার প্রয়োজন নেই। এগুলো ‘অপ্রয়োজনীয় কাজ’।” তিনি বলেছেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত, তাদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক হবে না।’ জাতির এই বিবেকের বক্তব্যের সঙ্গে এতটুকু দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাধীনতার ইতিহাস ইচ্ছামতো সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফল ভালো হয়নি। তারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমানকে ‘পাকিস্তানের চর’ আখ্যা দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে। সে অপপ্রচার সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জিয়ার অবস্থান অম্লান হয়ে আছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, তাঁর শাসনামলের শত সমালোচনা থাকলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অবদান কখনোই মুছে ফেলা যাবে না।
একটি কথা বলতেই হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কাজকর্ম ‘নেই কাজ, তো খই ভাজ’ প্রবাদকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তারা আসল কাজ বাদ দিয়ে এমন সব কাজে হাত দিচ্ছে, যেগুলো তাদের করার কথা নয়। তাদের প্রধান দায়িত্ব সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা না করে তারা নানা বিষয়ে এমন সব উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটিও তেমনি একটি অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত। সরকারের উচিত দ্রুত এই হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক
ও রাজনীতি বিশ্লেষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ র স ব ধ নত র রহম ন সরক র র প রব স মন ত র অবদ ন সহয গ
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।
জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।
‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়
শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।
এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।
জনমতে এগিয়ে মামদানি
ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।
কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।
ভূমিধস পরিবর্তন
একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।
এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।
এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’
কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।