স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন
Published: 26th, March 2025 GMT
আজ ২৬ মার্চ, স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকী। মনে পড়ছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরের দৃশ্য। আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখছি, এক গাড়ি পাকিস্তানি সৈনিক ঢাকা কলেজের সামনের একটি তেলের পাম্পের ওপর ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামানোর জন্য একটি কিশোর ছেলের দিকে বন্দুক তাক করে ধমক দিচ্ছে। ভোর হওয়ার একটু আগেই আমরা মাইকে ঘোষণা শুনেছি, যেই বাড়ি পতাকা না নামাবে, সেই বাড়িই ধূলিসাৎ করে দেওয়া হবে।
২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর পিলখানা থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছিল।
বাবুপুরা বস্তি আর নিউমার্কেট এলাকায় আগুনের শিখা। মানুষের চিৎকার শুনছিলাম। শেষ রাতের দিকে আমাদের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্যাংক চলে গেল।
নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মাত্র দুদিন আগে, ২৩ মার্চ বাড়ির ছাদে আমরা নিজ হাতে সেলাই করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মনে হচ্ছিল, স্বাধীন হয়ে গেছি। কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের ডাকের পর সারা দেশের প্রশাসন, এমনকি ব্যাংকগুলোও তাঁর নির্দেশে চলছিল। ৫ মার্চ ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে জেনারেল ইয়াকুব তাঁর পদত্যাগপত্রে জেনারেল ইয়াহিয়াকে লিখেছিলেন, ‘কার্যত শেখ মুজিব এখন সারা দেশের সরকারপ্রধান। এমন সময়ে নিরস্ত্র জনগণের ওপর সামরিক আক্রমণের ফল হবে বিপর্যয়কর।’ ইয়াহিয়া অবশ্য সামরিক আক্রমণের পথই বেছে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
২৬ মার্চ সকালে আমাদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকাটি নামালাম; কিন্তু ফেলে দিইনি, লুকিয়ে রেখেছিলাম। বুঝতে পারলাম, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আরও অনেক দিন সংগ্রাম করতে হবে। মনে পড়ল ভিয়েতনাম, কিউবা—এসব দেশ বছরের পর বছর যুদ্ধ করেছে। সেই লুকানো পতাকা যে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধের পর আবার বাড়ির ওপর ওড়াতে পারব, তা সেদিন কল্পনাও করতে পারিনি।
আমরা অনেক সময়ে ভুলে যাই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশ–পরবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে আমরাই প্রথম সংগ্রাম করে স্বাধীন হতে পেরেছি। তৃতীয় বিশ্বের আরও অনেক জাতি বছরের পর বছর সংগ্রাম করেও স্বাধীন হতে পারেনি। সশস্ত্র যুদ্ধের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি আমাদের ছিল না। সেই জনযুদ্ধে বিজয় সম্ভব হয়েছিল। কারণ, স্বাধীনতার পক্ষে পুরো জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ। আর সে ঐক্য গড়ে উঠেছিল আগের দুই দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, ধর্ম, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি প্রশ্ন ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের থেকে আমাদের ক্রমে আলাদা করেছে এবং আমাদের জাতীয় সংগ্রামের মূল এজেন্ডা তৈরি করে দিয়েছে। ১৯৬০–এর দশকের বিভিন্ন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আমাদের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার স্ফূরণ ঘটায়। ১৯৬৯-৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণাকালে নজিরবিহীন জনসংযোগের মাধ্যমে গোটা জাতিকে শেখ মুজিব স্বাধিকারের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেন। পূর্ববঙ্গকে বাংলাদেশ বলে উল্লেখ করতে থাকেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকেরা যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আমাদের ওপর সামরিক হামলা শুরু করে, তখন সংঘবদ্ধ জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগিয়েছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ বিশ্ববাসী আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। আবার অনেক দেশে; যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার আমাদের সমর্থন দেয়নি; কিন্তু আমেরিকার কংগ্রেস ও গণমাধ্যম সমর্থন দিয়েছিল। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েও বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিল। আমরা এসব অভূতপূর্ব জনসমর্থন পেয়েছিলাম। কারণ, মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসী একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার জন্য সংগ্রাম হিসেবে দেখেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কী ধরনের রাজনীতি, সরকার, সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেখতে চাই, তারও একটি ধারণা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বিপরীত এক ব্যবস্থা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। পাকিস্তানে ছিল অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসন, আমরা স্বপ্ন দেখেছি বাংলাদেশে হবে বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসন। পাকিস্তান ছিল ইসলামিক রিপাবলিক। সেখানে ধর্মের অপব্যবহার করে রাজনীতি করা হতো। ধর্মের নামে হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল—রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। সব ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকবে। ধর্মের নামে সংঘাত হবে না। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল ২২টি অতি ধনী পরিবার। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি শোষণ ও বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ গড়ে তুলবে। এসব আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল।
গত পাঁচ দশকে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। আবার আমাদের অনেক স্বপ্ন, অনেক আকাঙ্ক্ষা এখনো অধরা রয়ে গেছে। আমরা গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধ হয়নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কমেনি; বরং বেড়েছে। কিন্তু আমাদের আন্দোলন ও যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। সেই লক্ষ্য আমরা অর্জন করেছি অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে।
অনেকেই মাঝেমধ্যে বলেন, আমরা স্বাধীন হয়ে কী পেলাম? এর উত্তরে আমি বলি, স্বাধীনতাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পেরেছে বলেই আজ আমরা একটি গর্বিত জাতি হিসেবে পৃথিবীতে জায়গা করে নিতে পেরেছি। স্বাধীনতা আমাদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন এনেছে। স্বাধীনতা আমাদের জনগণের মনে স্বাবলম্বী ও উদ্যোক্তা হওয়ার স্পৃহা গড়ে দিয়েছে। আমরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়েছি, প্রতিবাদী হয়েছি। আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো ব্যবস্থাই আমরা বেশি দিন সহ্য করিনি। ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছি। গত বছরের গণ–আন্দোলনেও আমরা একটি স্বৈরাচারী শাসন উৎখাত করেছি। আমরা বারবার সংগ্রাম করে অন্যায্য ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছি। আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছি।
স্বাধীনতা আমাদের চেতনায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, সেটিই বিরাট এক প্রাপ্তি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স গ র ম কর ক ব যবস থ স ব ধ নত র জন ত র জন য আম দ র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
খাদি কাপড়ের জিআই স্বীকৃতিতে আনন্দে ভাসছেন কুমিল্লাবাসী
কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক খাদি কাপড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আনন্দিত জেলার মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, অবশেষে পেয়েছেন সেই সুখবর। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বীকৃতির এই সনদ দেওয়া হয়।
কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকার রামঘাটলা থেকে শুরু করে রাজগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত ৩০০ খাদি পোশাকের দোকান। কান্দিরপাড়ের খাদি বসুন্ধরা দোকানের স্বত্বাধিকারী জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, শৈল্পিক ছোঁয়ায় কুমিল্লার খাদি এখন দেশ-বিদেশে বেশ সমাদৃত। ঐতিহ্যের খাদিতে এখন লেগেছে আধুনিকতা ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। শত বছরের বেশি পুরোনো খাদির আরও অনেক আগেই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। অবশেষে স্বীকৃতি মিলেছে, এতেই আনন্দিত সবাই।
একই এলাকার খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক তপন পাল বলেন, ‘কুমিল্লার প্রতিটি মানুষ খাদির এমন স্বীকৃতিতে আনন্দিত। শত বছর পার হলেও এখনো দেশ-বিদেশে খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা।’
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদিশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য আওয়াজ ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সে সময় ভারতবর্ষের মানুষ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে খাদি পোশাক ব্যবহার শুরু করেছিলেন। খাদের (গর্তে) চরকায় বসে এ কাপড় তৈরি করা হয় বলে এর নামকরণ হয় ‘খাদি’। শুরুতে মহাত্মা গান্ধী নিজেও কুমিল্লায় এসে খাদের চরকায় বসে খাদি কাপড় তৈরিতে উৎসাহ দেন।
এই গবেষক আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নিলে কুমিল্লার খাদিশিল্প সংকটে পড়ে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাল ধরেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, জেলা প্রশাসনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় গত বছর কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লার খাদি ও বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের জিআই স্বীকৃতির জন্য তখন থেকেই কাজ শুরু হয়। কুমিল্লার ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত তিনটি পণ্যের মধ্যে দুটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। যে একটি বাকি আছে, সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি পাবে বলে তিনি আশাবাদী।