যুক্তরাষ্ট্র কি চীন-রাশিয়া বিভক্তির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে? ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর ডানপন্থি পণ্ডিত টাকার কার্লসনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র না বুঝে চীন ও রাশিয়াকে জোট বাঁধার দিকে ঠেলে দিয়েছে। দুটি শক্তিকে বিভক্ত করাকে তাঁর প্রশাসন অগ্রাধিকার দেবে।
হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তিনি আশা করছেন, দ্রুত ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটবে। ইউরোপীয় সংঘাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনা এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, এমনকি যদি এর অর্থ ইউক্রেনকে নিজের সুবিধার জন্য বিপদেও ঠেলে দেওয়া হয়, তবে এটি চীনা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ স্থানান্তরের প্রেক্ষাপটে দেখা যেতে পারে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক ফোনালাপের পর ট্রাম্প ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবে আমি দেখেছি, আপনি প্রথমেই যা শিখবেন তা হলো, আপনি রাশিয়া ও চীন একত্র হোক– তা চাইবেন না।’
ট্রাম্প যে ইতিহাসের কথা উল্লেখ করেছেন তা হলো, নিক্সন যুগের কৌশল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে চীনের সঙ্গে জোট বাঁধতে চেয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় দুটি কমিউনিস্ট সত্তার মধ্যে বিভাজনকে প্ররোচিত করা হয়েছিল। যদি মস্কো ও বেইজিংয়ের মধ্যে ফাটল তৈরি করাই চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়; আমার বিশ্বাস, ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি নির্বোধ ও অদূরদর্শী।
আজকের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে আলাদা, যেখানে চীন-সোভিয়েত বিভক্তি ঘটেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের প্রধান কৌশলগত লক্ষ্যগুলো অভিন্ন করে নিয়েছে, যার মধ্যে প্রধান হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা উদারপন্থি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়া উভয়েই সামরিক শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমানভাবে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। যেমন দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান ঘিরে চীন, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোকে ঘিরে রাশিয়া। এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা সরকারগুলোর গঠিত ঐক্যবদ্ধ অবস্থান শুধু দুটি দেশকে একে অপরের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখন পুতিন ও শি জিনপিং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নিদর্শন হিসেবে ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ ঘোষণা করেন। তখন থেকে চীন রাশিয়ার জন্য একটি অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। আমদানি ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই দেশটি শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার।
২০২৪ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সর্বোচ্চ রেকর্ড অর্জন করেছে। রাশিয়া নিজেদের তেল ও গ্যাসের প্রধান ক্রেতা হিসেবে এখন চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা চীনকে রাশিয়ার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে এবং মস্কোকে বেইজিং থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার যে কোনো মার্কিন প্রচেষ্টা অর্থনৈতিকভাবে অবাস্তব করে তোলে।
এর অর্থ এই নয়, রাশিয়া-চীন সম্পর্ক নষ্ট হবে না। মতবিরোধ ও ভিন্ন নীতির ক্ষেত্রগুলোও রয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে ফাটল তৈরিতে সফল হতে ট্রাম্প কাজে লাগাতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মার্কিন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা এবং বেইজিংয়ের যে কোনো সম্প্রসারণবাদী প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা রাশিয়ার স্বার্থে কাজ করতে পারে। যেমন ভারতের সঙ্গে মস্কোর কৌশলগত সম্পর্ক, যা চীন কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গে দেখে। বিশেষ করে যেহেতু চীন-রাশিয়া সীমান্তে এখনও বিতর্কিত অঞ্চল রয়েছে।
ট্রাম্পের লেনদেনমূলক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী পররাষ্ট্রনীতি ইউরোপে ডানপন্থি দলগুলোকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ইইউ মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। আর তা মার্কিন প্রশাসনের দেওয়া নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির ওপর অন্যদের আস্থা দুর্বল করে দিতে পারে। অন্যদিকে বেইজিং এটিকে মার্কিন প্রভাব হ্রাসের লক্ষণ হিসেবে দেখতে পারে, যা চীনকে কৌশল অবলম্বনের জন্য আরও সুযোগ করে দেবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষত তাইওয়ানের কথা বলা যায়।
লিংগং কং: যুক্তরাষ্ট্রের অবার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি প্রার্থী; দ্য কনভারসেশন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।
অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।
একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।